
বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে গত জুনে। দেশের আরও কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যেই জনসাধারণের উন্মুক্ত হবে এই মেগা প্রজেক্ট বা প্রকল্প গুলো। এগুলো চালু হলে মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়ে বদলে যাবে দেশের সার্বিক চিত্র, স্বরূপ বদলাবে অর্থনীতির। পাশাপাশি সড়ক ও রেল যোগাযোগে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। সহজতর হবে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা।
ঢাকা মেট্রোরেল
‘ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে চালু হওয়া ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ প্রায় ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এবছরের ডিসেম্বরেই উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। ইতিমধ্যেই এমআরটি লাইন-৬ এর আগারগাঁও থেকে উত্তরা অংশের সার্ভিস ট্রান্সফার, মেইন পাইল চেক বোরিং, পাইল ক্যাপ, টেস্ট পাইল, আই-গ্রিডার, প্রিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিং-এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মের ছাদ, ইস্পাতের ছাদ, হলঘরের ও আইকনিক স্টেশনের কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। গতবছরের মে মাসে মাঝামাঝিতে জাপান থেকে আনা রেল ইঞ্জিন গুলো প্রথমবারের মতো ট্রাইল দিয়েছে এই পথে। আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে ৯টি স্টেশন। দীর্ঘ এ পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার। ৯টি স্টেশনের মধ্যে ৮টির বৈদ্যুতিক ও মেকানিকের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে শেষ সময়ের প্রস্তুতি।
মেট্রোরেল ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণে সক্ষম হবে। ট্রেন চালানোর জন্য প্রয়োজন হবে ঘণ্টায় ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট- ডিটিএমসিএল-কে মেট্রোরেলর তদারকি ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘জাইকা’-এর অর্থায়নে পরিচালিত হওয়া এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুন। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা ছিল। তবে প্রথমদিকে রুটিন ও সময় অনুযায়ী কাজ চললেও করোনা মহামারীর মধ্যে কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হয়। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
কর্ণফুলী টানেল
কর্ণফুলী নদীর নিচে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’টি বছর শেষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে। টানেলের কিছু কিছু অংশের পুরো কাজ-ই ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আবার কিছু কিছু অংশে চলছে বড়ো ধরনের কাজ। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৮১ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পটিতে থাকবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেলর সুড়ঙ্গ, আনোয়ারা ও পতেঙ্গা প্রান্তে ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারায় ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ। মোট টানেল প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। দুই টিউবের মধ্যে ৪ লেনের রোড নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি টিউবের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। যার মধ্য দিয়ে ৮০ কিলোমিটার পার ঘণ্টা বেগে গাড়ি চলাচল করতে সক্ষম হবে।
পতেঙ্গার নেভাল অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে এই টানেলটি ১৮ থেকে ৩২ মিটার গভীরতায় নেমে কর্ণফুলী পার হয়েছে। অপর প্রান্তের সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝের এলাকা দিয়ে আবার মাটির উপরে উঠে এসেছে। আনোয়ারা প্রান্তে দিয়ে পটিয়া-বাঁশখালী সড়কের চাতুরী চৌমুহনী পয়েন্টে সরাসরি ওঠা যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সংযোগ স্থাপন করবে এই পাতাল পথটি। ফলে ভ্রমণ ও পণ্য আমদানিতে সময়-অর্থ কম লাগবে এবং দেশের পূর্বপ্রান্তের শিল্প কারখানা গুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমের যেকোনো অঞ্চলে পরিবহন সহজ হবে।
আরও পড়ুন# বলপয়েন্ট কলম যেভাবে এলো!
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
নগর বাসীর যানজট নিরসনে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকা পর্যন্ত সড়কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে। চার লেনের এ উড়াল সড়কের মূল লেনের দৈর্ঘ্য হবে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। সংযোগ সড়ক সহকারে মোট প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও রেল ইস্টিশন পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অংশটি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সেতু কর্তৃপক্ষ। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাওলা থেকে বনানী, মহাখালী হয়ে তেজগাঁও পৌঁছাবে সেতুর প্রথম অংশ। তেজগাঁও থেকে মগবাজার, কমলাপুর হয়ে সায়েদাবাদ পৌঁছাবে দ্বিতীয় অংশ এবং মগবাজার থেকে ঢাকা-চট্রোগ্রাম রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত পৌঁছাবে তৃতীয় অংশ। ইতিমধ্যে প্রথম অংশের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। বাকি অংশ গুলোর কার্যক্রম চলছে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী মাত্র ১৫ মিনিটেই পৌঁছানো যাবে।
২০১১ সালে চালু হওয়া প্রকল্পটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় কয়েক মেয়াদে সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
পদ্মাসেতু রেলওয়ে প্রকল্প
পদ্মাসেতু বহুমুখী প্রকল্পের সড়ক অংশের উদ্বোধন হলেও রেল পথের সুবিধা পেতে আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ঢাকা কেরানীগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত মোট ১৭২ কিলোমিটার রেলপথের প্রায় ৫০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৪ সালের মধ্যে পুরো কাজ সম্পন্ন হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড’ প্রকল্পটির দায়িত্বে রয়েছে। পদ্মা সেতু রেলওয়ে চালু হলে রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগে যুগান্তরকারী পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে রাজধানীর সাথে দক্ষিণ বঙ্গের রেল যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে যশোর-পাবনা-ইশ্বরদী হয়ে যমুনা সেতু-সিরাজগঞ্জ-গাজিপুর-ঢাকা। দীর্ঘ এ পথের দৈর্ঘ্য ৩০০ কিলোমিটারের বেশি। যশোর থেকে এ পথে ঢাকায় আসতে সময় লাগে প্রায় ৯ থেকে সাড়ে ৯ ঘণ্টা। আবার দীর্ঘদিন ধরে যমুনা সেতুর রেলওয়ে পথটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকায় এ অংশে রেলের গতি কম রাখা হয়। পদ্মা সেতু রেলওয়ে প্রকল্প সম্পন্ন হলে এ দীর্ঘ পথের দূরত্ব কমে আসবে মাত্র ১৭২ কিলোমিটারে। আবার পদ্মা সেতুতে রেল চলতে পারবে প্রায় ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে। তাই যাত্রী পরিবহণ তো বটেই পণ্য আমদানিতে এ পথে সময়-অর্থ সাশ্রয় হবে কয়েক গুণ।
প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ রেল পথটি দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এবং ভাঙ্গা থেকে নড়াইল হয়ে রুপদিয়া যশোর পর্যন্ত। যশোর থেকে বেনাপোল ও খুলনার দিকে দুটি লাইন চলে গেছে।
প্রিয় পাঠক, এই ছিল উদ্বোধনের অপেক্ষায় ৪টি মেগা প্রজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত! আপনি কোন কোন মেগা প্রজেক্ট এর জন্য বেশি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন, কমেন্ট করে জানাতে পারেন!