অর্থনীতিআন্তর্জাতিকফিচারব্যবসা-বাণিজ্য

যেভাবে চরম অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কা!

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট চরম আকারে পৌঁছেছে। ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। এই বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যদি কিনতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকর। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে যেমন জ্বালানি, ওষুধ, খাদ্যের অভাব অন্যদিকে দিনে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং নাগরিক জীবনকে একেবারে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এই পরিস্থিতি নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশার জন্ম দিয়েছে। নাগরিকদের এসব ছোট খাটো বিক্ষোভ ও আন্দোলন এক পর্যায়ে বড় সহিংসতায় রূপও নিয়েছে। সব মিলিয়ে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা এখন নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও চরম রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কা

সংকট শুরু যেভাবে

শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যম আয়ের একটি দেশ। আগে সামাজিক সূচকে শ্রীলঙ্কার অবস্থানে ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নত রাষ্ট্রের কাছাকাছি। শিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা কেবল দক্ষিণ নয়, পূর্ব এশিয়ার মধ্যেও অনেক এগিয়ে ছিল। তবে শ্রীলঙ্কার বর্তমানের এই সংকট হঠাৎ করে আসেনি। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দুরাবস্থা ও দুরদর্শিতার অভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বড়ো দুইটি জোগানদাতা হলো পর্যটন খাত থেকে আসা আয় ও রেমিটেন্স। ২০১৯ সালে আসা করোনা মহামারিতে এই দুটি খাত-ই চরম ভাবে ক্ষতগ্রস্থ হয়েছে। করোনার লকডাউনে বিদেশ গমন বন্ধ থাকায় বিদেশী পর্যটন হারায় দেশটি। আবার লকডাউনে দির্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় বিদেশি রেমিটেন্স ও ঠিকিঠাক মত আসেনি। মূলত এই সময় থেকেই সংকটের সূচনা হয়। এরপরে বড়ো যে বাঁধাটি এসে দাঁড়ালো তা হলো, তখনকার প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসের ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেওয়া কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি!

করোনা মহামারির প্রথম দিকেই যখন পর্যটন ও রেমিটেন্সের সংকট শুরু হয় ঠিক তখন-ই কর হ্রাসের বাস্তবানয় করেন রাজাপাকসের। এরপর থেকে বাজারের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল শ্রীলঙ্কার ঋণ ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম একেবারেই কমে যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমান প্রায় ৭০ ভাগ কমে আসে। মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে বেশ কয়েকটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করে, যেমন মাত্তালা কলম্বো পোর্ট সিটি উন্নয়ন প্রকল্প, রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোতেও প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জিত হয়নি। কিন্তু ভারি হয়েছে ঋণের বোঝা! একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভা নেয়, অন্যদিকে বড়ো বড়ো ঋণের বোঝা অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তুলেছে।

আরও পড়ুন#  এটিই কি তবে দারিদ্র সংকট?

নাগরিকদের বিদ্রোহ

গত মার্চ থেকে গ্যাস-বিদ্যুত-পানির সংকট দেখা দিলে নাগরিকরা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। রাস্তায় নামে। তাদের আন্দলোন সহিংসতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। রাজাপকসের সমার্থক ও দলের লোকেরাও এ আন্দলোনে অংশ নেয়। এক পর্যায়ে সংসদ বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার আরও কয়েকটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে বোঝাতে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামায়। এতে কারে কিছু নাগরিক আহত হওয়ার ঘটনাও সামনে আসে। শেষ পর্যায়ে রাজাপাকসসেকে পদত্যাগ করতে হয়।

বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা যেমন

এবছরের ১২ এপ্রিল শ্রীলঙ্কা নিজেদের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বিষয়ে ঋণদাতাদের সাথে আলোচনা করে কিছু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কিস্তি স্থগিত করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায় শ্রীলঙ্কার চলতি বছরের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ৭০০ কোটি ডলার আর এর বিপরীদে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার রয়েছে মাত্র ২০০ কোটি ডলার। এই বৃহৎ তফাত নিয়ে অর্থনীতিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো বড়ো একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে সরকার সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ে, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাচ্ছে সাথে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানিতে কমিয়ে ফেলছে কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত গুলো অপ্রতুল।

সংকট উত্তরোণের পথ

রাজাপাকসের কীটনাশকের বিকল্প উৎস সরবরাহ না করে কৃত্রিম কীটনাশকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি কৃষি ক্ষাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেই দেশের কৃষিক্ষাতের স্বনির্ভরশীলতা খুব জরুরি একটি বিষয়।

যেহেতু বৈদেশিক রিজার্ভের সংকটে আপদানি শিল্প বন্ধের পথে ফলে সংকট আরও কঠিন হচ্ছে। প্রথমত কঠিন বিষয়কে কিছুটা প্রশমন দিতে দেশের কর্ষি খাতের স্বনির্ভরতা ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন দেশের পর্যটন শিল্প ও আমদানি-রপ্তানি পন্যের দিকে গভীর নজর দিতে হবে।

অনেকে বলছেন, শ্রীলঙ্কাকে হয় তার ঋণ পুনর্গঠন করতে হবে, নতুবা একটি ত্রাণ প্যাকেজ তৈরি করে নিয়ে আলোচনার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দ্বারস্থ হতে হবে। তবে শুল্ক বাড়িয়ে, করের হার হ্রাস, বৃদ্ধি করে খুব একটা লাভজনক অবস্থার সৃষ্টি হবে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক পুনঃগঠন করা সম্ভব হবে, এমনটা ভাবাও অনুচিত। দীর্ঘ সময় ধরে সুপরিকল্পিত ভাবে কাজ করলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চাকাকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।