অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: হার না মানা এক অভিনেত্রীর গল্প!
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: মানসিক অসুস্থতা আর প্রতিকূলতা পেরুনোর যত সংগ্রাম!
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি (Angelina Jolie) আমাদের অনেকেরই প্রিয় অভিনেত্রী। আবেদনময়ী আর অসম্ভব সুন্দরী এই ভদ্রমহিলা কিন্তু স্রেফ অভিনয়ের ক্ষেত্রে আটকে থাকেননি। হয়েছেন অনেক কিছু। অনেক ক্ষেত্রে সেরা। তাইতো কারও জন্য তিনি প্রিয় ফ্যাশন আইকন। কারো প্রিয় মডেল। আবার কারো বা আদর্শ। যাকে দেখে শেখা যায় অনেক কিছু। গড়া যায় নিজেকে।
কিন্তু আপনি জানেন কি, কতটা সংঘাতময় ছিল অ্যাঞ্জেলিনা জোলির জীবন? জানেন, কত কত টানাপোড়েন কাটিয়ে এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন তিনি? আমি নিশ্চিত, অনেকেই জানেন না।
চলুন ছোট্ট করে আজ প্রিয় মানুষটি সম্পর্কে জানি।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি : হার না মানা এক অভিনেত্রীর গল্প!
এক বছর বয়সেই বাবার ছেড়ে চলে যাওয়া:
কোনো এক সন্ধ্যার বেভারলি হিলস হোটেল।
অস্কার পুরষ্কারজয়ী জন ভয়েটের (Jon Voight) সাথে অভিনেত্রী মার্সেলিন বার্ট্রান্ডের (Marcheline Bertrand) পরিচয় হয় সেখানে। মন্ত্রমুগ্ধ জন ভয়েট পরবর্তীতে ম্যান’স জার্নাল (Men’s Journal) কে জানান, ‘তার প্রতি আমার মুগ্ধতা এত বেশি ছিল যে কথোপকথনের মাঝে তাকে বলে বসেছিলাম, “তুমি কি জানো, তোমার দুটো সন্তানের পিতা হতে পারব আমি,” কথাটা শুনে চোখের পলক পড়েনি তার। আমিও অপলক তাকিয়ে ছিলাম। তারপর সত্যিই দুটো সন্তান হলো আমাদের।”
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, তাদের সম্পর্কটা টেকেনি। জন ভয়েট অন্য একজনের প্রেমে পড়ায় মার্সেলিন বার্ট্রান্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার। মার্সেলিনের কোলে তখন এক বছর বয়সী কন্যাসন্তান। আর এই কন্যাসন্তানই হচ্ছেন আমাদের সবার প্রিয় অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
২০১৪ সালে Elle কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জোলি বলেন, ‘কখনও ভাবিনি সন্তান হবে আমার, কখনও ভাবিনি প্রেমে পড়ব, এমনকি এটাও ভাবিনি কোনো সঠিক মানুষের সাথে দেখা হবে আমার। যখন একটা ব্রোকেন হোম থেকে আসবেন আপনি— বলা যায় একপ্রকার মেনেই নেবেন যে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যাপার স্রেফ রূপকথা ছাড়া আর কিছু নয়। আর সেগুলো খুঁজেও বেড়াবেন না তখন।”
অভিনয় জীবনের প্রথম ছবিতে তার নাম অভিনেত্রী হিসেবে তার নাম ছিল অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ভয়েট। কিন্তু পরবর্তীতে নাম থেকে “ভয়েট” অংশ ছেঁটে ফেলেন তিনি। জন্মদাতার নাম ব্যবহার করে কাজ পেতে ইচ্ছুক ছিলেন না তো তাই। তার ভাষায়, ‘নামের ওই অংশের সাথে ঠিক একাত্মতা বোধ করছিলাম না আমি। আর ওই অংশটুকুর পরিচয়ে কেউ আমাকে কাজ দিক, তাও চাইনি।’
#আরও পড়ুন: সৌন্দর্যের রানি ঐশ্বরিয়ার নতুন মুভির ট্রেইলার প্রকাশ!
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এর হাইস্কুলে উত্যক্ত হওয়া:
তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীকে দেখে আমরা ধারণা করতে পারি বা ধরে নিতেই পারি, সারাজীবন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন তিনি। তাই না? জনপ্রিয় অভিনেতা আর অভিনেত্রী বাবা-মায়ের সন্তান। জনপ্রিয় হতেই পারে। কিন্তু না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হাইস্কুল জীবন একটুও প্রীতিকর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তার জন্য। বেভারলি হিলস হাইস্কুলে ভয়ংকর বাজে সময় কেটেছিল অ্যাঞ্জেলিনা জোলির। পারিবারিক বন্ধু সিস রান্ডল (Cis Rundle)— যিনি কিনা জোলির মায়ের বন্ধু ছিলেন— দেখাশোনা করতেন জোলির।
‘তার স্কুলের ছেলেমেয়েরা তার ঠোঁটের কারণে প্রচুর হাসিতামাশা করতো তাকে নিয়ে। মেয়েগুলোও খুব নিষ্ঠুর আচরণ করতো,’ রান্ডল Radar কে জানালেন। ‘প্রশস্ত কাঁধ আর দীর্ঘ পায়ের কারণে, গ্যাজেলের (Gazelle এক প্রকার হরিণ) মতো চলাফেরা করতো সে।’ রান্ডলের মতে, জোলির মা মার্সেলিন প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তায় ভুগতেন তাকে নিয়ে। এজন্য নয় যে, তার মেয়ে উত্যক্ত হচ্ছিল কিংবা নিপিড়নের শিকার হচ্ছিল। বরং এজন্য যে, খাওয়াদাওয়া ই করত না সে। একবার তো এই না খাওয়ার জন্য তাকে হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়েছিল তাকে!
জোলির বড় ভাই জেমস হাভেন (James Haven) একবার বলেছিলেন, ‘খাবারের প্রতি খুব একটা মনযোগ দেয় না সে।’ আর তাই ২০০৭ সালে মায়ের মৃত্যুর পর বোনকে নিয়ে খুব বেশি দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন জেমস। খাওয়াদাওয়ার প্রতি জোলির এমন অনীহা এখনও দেখা যায়। ২০১৯ এ মার্ভেলের মুভিতে অভিনয় করার আগে গুজব উঠেছিল তাকে নিয়ে। তিনি নাকি ‘মোটে ১০০ পাউন্ডও নন!’
ভাবুন তবে!
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এর আত্ম-ক্ষতির অভ্যেস:
জন ভয়েট এর ভাই চিপ টেইলরের মতে, তার ভাই (জন ভয়েট) বেশ ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন একবার। যখন তিনি জানতে পারলেন তার কিশোরী কন্যা নিজেকে কাটাছেঁড়া করতে শুরু করেছে। যা অবশ্য কখনওই অস্বীকার করেননি জোলি। বরং আশ্চর্যজনক সত্য হচ্ছে, তিনি তার ছুরি-প্রীতির ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট ছিলেন বরাবর। ছুরি সংগ্রহে দারুণ আগ্রহ তার। বারবারা ওয়াল্টার্সকে একবার তিনি বলেছিলেন, প্রথম সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে শয়নকক্ষে ছুরি রাখতেন তিনি। ব্যবহারও করতেন ওই ঘরে। এমনকি খারাপ সময়ে সেই ছুরিগুলোই নিজের উপরে চালাতেন তিনি। নিজেই নিজের শরীরে কাটাকুটি করতেন।
তার ভাষ্যমতে, ‘এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম আমি, যখনই একটুখানি কোণঠাসা মনে হতো নিজেকে, কাটাকুটি চালাতাম। অনেক দাগ আছে সেগুলোর।’
জোলির এই আত্ম-ক্ষতির অভ্যাস চলে গিয়েছিল। বা তিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন একটা সময়। ২০০২ সালে যখন তিনি তার প্রথম সন্তান ম্যাডক্স (Maddox) কে ক্যাম্বোডিয়া থেকে দত্তক নেন। পরের বছর কসমোপলিটান বা Cosmopolitan কে জানান, ‘ছুরিগুলো বাড়িতেই আছে, হাতের নাগালের বাইরে। তবে আছে। আর হ্যাঁ, যখন আমার বয়স ১৪ ছিল, নিজেকে কাটতাম আমি আর ওই পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। আর ঐ পর্যায়ে আবার যাইনি আমি, যাচ্ছিও না, বিশেষ করে এখন তো একদমই নয়। কারণ এখন ম্যাডক্স আছে আমার কাছে।’
মাকে সাহায্য করতে অভিনয় জগতে আসা কিন্তু হিমশিম খাওয়া:
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি যখন তার প্রথম মুভিতে অভিনয় করেন, তখন হয়তো দৈনন্দিন খরচের ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না তার। কিন্তু পরবর্তীতে একটু বড় হওয়ার পর যখন অভিনয় জগতে ফিরে আসেন, তখন একটা ঘর বা সংসার চালানোর সংগ্রাম সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, এই ইন্ডাস্ট্রিতে তার আবার ফিরে আসার একটাই কারণ। মাকে সংসার চালাতে সাহায্য করা।
‘যখন আমি অভিনয় করা শুরু করলাম… এটা ছিল আমার জন্য একটা চাকরির মতো,’ বললেন জোলি। ‘এটা ছিল একটা সৃজনশীল চাকরি… (কিন্তু) আপনি অল্পবয়সী, আর আপনি ঠিক জানেন না আপনি আসলে কে— অথচ ঠিকই একটা মাইক্রোফোন আপনার চেহারার সামনে এনে ধরা হয়, আর আপনার বয়স হতে পারে ১৭ কি ১৮, তবু মানুষজন আপনার কাছে মতামত জানতে চায়। এমন সব মতামত বা মন্তব্য যা এখনও আপনার মাঝে তৈরি হয়নি। যা এখনই তৈরি হওয়া উচিৎ নয়, অন্তত পুরোপুরি তো নয়ই।’
জোলি খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলেন, বাবা-মাকে অনুসরণ করে পারিবারিক ব্যবসায় (অভিনয়) আসা ঠিক চাট্টিখানি কোনো কথা ছিল না। মাকে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের চাইতে বেশি উপার্জন তিনি করতে পারছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারকা জীবনের বোঝা বা দায়িত্ব বেশ চেপে বসেছিল তার কাঁধে। তাই তো অকপটে জোলি স্বীকার করেছিলেন, ‘শোচনীয় অবস্থা হচ্ছিল খুব। পুরোপুরি অসুখী ছিলাম আমি।’
#আরও পড়ুন: সফল পরাণ: হাওয়ায় ভাসছেন অভিনেত্রী মীম
সুপার মডেল জিয়া কারাঞ্জির চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে ভয়ংকর বিষণ্নতায় ভোগা:
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির প্রথম স্বামী ছিলেন জনি লী মিলার (Jonny Lee Miller)। তিনি ছিলেন Hackers মুভিতে জোলির সহ অভিনেতা। ১৯৯৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা দু’জন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে স্বামীসহ অন্য সবার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন জোলি। গুটিয়ে যান নিজের মাঝে। ট্রাজিক সুপার মডেল জিয়া কারাঞ্জির চরিত্র ‘Gia‘ তে অভিনয় করার কারণে এমনটা ঘটে তখন। HBO TV এর মুভি Gia এর কথা বলছি এখানে।
‘জিয়ার সাথে যথেষ্ট সাদৃশ্য ছিল আমার। ফলে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এটা হতে পারে আমার ভেতরের দানবদের জন্য একটা প্রায়শ্চিত্ত। কিংবা হতে পারে আমাকে পুরোপুরি উল্টোপাল্টা করে দেয়ার একটা মাধ্যম,’ AP news কে বলেছিলেন জোলি।
দুঃখজনক ভাবে, পরের কথাটাই সত্য হলো। মুভিটাতে কাজ করার ফলে জোলি এতোটাই আত্মঘাতী হয়ে গিয়েছিলেন যে, অনুশোচনা-মুক্ত অবস্থায় কীভাবে মারা যাওয়া যায় সে নিয়ে একটা পরিকল্পনা এঁটে বসেছিলেন তিনি।
The Herald কে জোলি বলেছিলেন, ‘শুনতে উন্মাদের প্রলাপ শোনাবে, কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন আমি নিজেকে মেরে ফেলার জন্য কাউকে ভাড়া করার কথা ভাবছিলাম।’
সৌভাগ্যক্রমে যে আততায়ীকে ভাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন জোলি, তার মন নরম হয়ে গিয়েছিল। জোলির ভাষ্যমতে, লোকটা খুব করে চেয়েছিল জোলি যাতে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এক মাস সময় নিয়ে ভাবে। সিদ্ধান্তটা যাতে ভেবে দেখে কিছুদিন। ‘আর এক মাস পর আমার জীবনের অন্যান্য জিনিসগুলো বদলে গেল। আর আবার বাঁচতে লাগলাম আমি,’ জোলি বললেন।
‘Gia’ এর জন্য বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছিলেন তখন তিনি। ভালো ভালো প্রতিক্রিয়া শুনতে পাচ্ছিলেন। এমনকি Golden Globe এ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন পর্যন্ত। আর এই সবকিছু তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করেছিল তাকে। Made in Atlantis কে দেয়া সাক্ষাৎকারে জোলি বলেছিলেন, ‘হঠাৎ করেই মনে হলো মানুষ বুঝতে পারছে আমাকে। আর কোনো একভাবে বদলে গেছে জীবন।’
প্রায় প্রতিটা সম্ভবপর নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা:
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি তার জীবনে প্রায় সবধরনের নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেছিলেন। আর তা কখনোই লুকোননি তিনি। এ বিষয়ে Vanity Fair কে বলেছিলেন, ‘হেরোইন আমার জীবনে সবসময় খুব কাছের ছিল।’
১৯৯৮ সালে Daily Mail কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বেশ অকপটে জানান, ‘কোক, হেরোইন, এক্সট্যাসি, এলএসডি প্রায় প্রতিটা সম্ভবপর ড্রাগ নিয়েছি আমি। ডিজনিল্যান্ডে যাওয়ার আগে এলএসডি নেয়ার কথা মনে আছে আমার। আর এর প্রভাবেই সেখানে যাওয়ার পর আমি ভাবতে লাগলাম, মিকি মাউস হচ্ছে এক মধ্যবয়স্ক বেঁটে লোক। যে কিনা কস্টিউম পরে আছে। আর প্রচন্ড ঘৃণা করে নিজের জীবনকে। এই ড্রাগগুলো বেশ বিপদজনক হতে পারে যদি পজিটিভলি এগুলোর কাছে না যান আপনি।’
জোলির দাবি, তিনি অনেক আগেই ড্রাগস নেয়া ছেড়ে দিয়েছেন। যদিও তার সরবরাহকারীর মত সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১৪ সালে নেশাদ্রব্য পাচারকারী ফ্র্যাঙ্কলিন মেয়ার পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর বলেন, জোলি তার নিয়মিত গ্রাহক। তার কাছে হেরোইন আর কোকেন বিক্রি করেছিল সে। এমনকি একটা ভিডিয়ো ক্লিপও দেখায় সে কর্তৃপক্ষকে। পরে সেটা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়।
Lara Croft: Tomb Raider এ একত্রে অভিনয় করার সময় বাবার সাথে সাময়িক মিটমাট:
২০০১ সালের মুভি ‘Lara Croft: Tomb Raider‘। এক ভিডিও গেমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল এই মুভিটি। এতে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নাম ভূমিকা মানে Lara Croft এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আর তার দীর্ঘদিন ধরে হারিয়ে যাওয়া পিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জন ভয়েট। বাস্তব জীবনে যিনি কিনা জোলির জন্মদাতা। জোলির ভাষ্যমতে এই মুভিতে কাজ করার সময় বাবার সাথে মেশার বা সত্যিকার একটা বন্ধন তৈরি করার সুযোগ হয়েছিল তার। সুযোগ হয়েছিল নিজেদের মধ্যকার প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়া সম্পর্ককে একটুখানি হলেও ঝালাই করে নেয়ার।
কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। টেকেনি বেশিদিন। Irish Examiner কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জোলি বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল, আমরা একজন অন্যজনকে বুঝতে পারছিলাম। মজার ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু এরপর তিনি খুব দ্রুত তার নিজের পুরোনো স্বভাবে ফিরে গেলেন। হয়ে গেলেন আবার আগের মতো প্রচন্ড জাজমেন্টাল।’
জাতিসংঘের এক মিশনের জন্য দেশ ছাড়ছিলেন তখন জোলি। সেই সময়ই জন ভয়েটের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হয় আবার।
জোলির মতে, ভয়েট তাকে বিদায় দেয়ার জন্য তার সাথে এয়ারপোর্টে এসেছিলেন তখন। পথে কন্যাকে একটা রহস্যময় চিঠি দিয়েছিলেন তখন। ‘তিনি বললেন, “এটাই আমার সত্য। আর এটা অপরিবর্তনীয়,” ‘জোলি স্মৃতিচারণ করলেন। ‘আমি জানতাম না তিনি ঠিক কী লিখেছিলেন চিঠিতে। তাই বলেছিলাম, “লটা অসাধারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি, পরে দেখা হচ্ছে।” তারপর চিঠিটা খুললাম আমি। ওখানে তিনি লিখেছিলেন, আমি একজন খারাপ ব্যক্তি। পড়ে খুবই মন খারাপ হলো আমার। শতখানেক জবাব ভাবলাম চিঠিটার, তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম এই লোকটার মতামতের কোনো মূল্য নেই তো আমার কাছে। তাই কিছু যায় আসে না।’
দুঃখজনক। আর তবু নিজের অবস্থান বোঝানোর জন্য জোলি আরও বললেন, ‘আমি আমাদের দু’জনকে পিতা আর কন্যা হিসেবে দেখি না এখন আর।’
Lara Croft এর পরবর্তী মুভি “Lara Croft Tomb Raider: The Cradle of Life” এ জন ভয়েট তার চরিত্রে অভিনয় করেননি আর।
জন ভয়েটের আক্রমণাত্মক সাক্ষাৎকার আর তা নিয়ে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ক্ষোভ:
২০০২ এ ম্যাডক্সকে দত্তক নেয়ার কয়েক মাস পর স্বামী বিলি বব থর্নটন (Billy Bob Thornton) এর সাথে জোলির ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বিলি ছিলেন তার দ্বিতীয় স্বামী। ১৯৯৯ সালে “Pushing Tin” মুভিটি করার সময় পরিচয় হয় তাদের। পরবর্তী বছর লাস ভেগাসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেন তারা। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বড়ো বড়ো ট্যাবলয়েডে বেশ হইচই হয়েছিল তখন। হওয়া স্বাভাবিক, যদি একটা জুটি একইরকম দেখতে লকেট গলায় ঝোলায় যে লকেটে কিনা আবার তাদের রক্ত মেখে রাখা। তাই না?
ম্যাডক্সকে তারা একত্রে গিয়ে দত্তক নেন। কিন্তু এরপর জানান যায় থর্নটন ঠিক ব্যাপারটার জন্য প্রস্তুত নন। তিনি ঠিক মানসিকভাবে বাবা হওয়ার জন্য প্রস্তত ছিলেন না তখন। Vanity Fair কে এ তথ্য জানান জোলি। ব্যাপারটা সামলে নেন জোলি। প্রস্তুতি নিতে থাকেন একক অভিভাবক হয়ে সন্তানকে সামলানোর।
কিন্তু ঠিক সেই সময় তার জন্মদাতা জন ভয়েটের আরেকটা আক্রমণ আসে তাকে লক্ষ্য করে। যা ম্যাডক্সের দত্তক নেয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি বিগড়ে দিতে পারতো।
Entertainment Weekly কে দেয়া এক বিশাল মাত্রার প্রচারিত সাক্ষাৎকারে জন ভয়েট বলেন, তিনি জানতেন এই বিয়ে টিকবে না। প্রথম থেকেই ভাগ্য নির্ধারিত ছিল এই সম্পর্কের। কারণ তার কন্যার (জোলির) “বেশ গম্ভীর মানসিক সমস্যা” আছে।
পরের বছর বারবারা ওয়াল্টার্সকে এক সাক্ষাৎকারে জোলি বলেছিলেন, ‘তার এই কাজের ফলে সবচেয়ে বাজে বা কঠিন একটা ব্যাপার ঘটতে পারতো আমার সাথে। আমার সন্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারতো আমার। তারা (কর্তৃপক্ষ) সিদ্ধান্ত নিতে পারতো: “সে (ভয়েট) ঠিক বলেছে, মেয়েটা উন্মাদ, এখন চলো তার কাছ থেকে বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে আনি আমরা।” আর সেটা হতো ক্ষমার অযোগ্য।’
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি কাউকে বিশ্বাস করেন না:
বাবার সাথে তার এমন জটিল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও যখন ব্রাড পিটের (Brad Pitt) সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন জোলি, অনেকেই অবাক হয়েছিল। তাছাড়া একটু অদ্ভুত ছিল তাদের সম্পর্কের শুরুটা। তাই ব্যাপারটা আলোচ্য বিষয় ছিল অনেকদিন। তাছাড়া খোলাখুলি ভাবে জোলি বলেছিলেন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটু সমস্যায় ভোগেন তিনি। কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। ২০০৭ সালে দেয়া Vogue এর একটা সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। এই কথাটা শুনে আপনি ভাববেন হয়তো আমার থেরাপি নেয়া উচিৎ। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে এক উদ্ভট শব্দ।’
জোলি প্রকাশ করেছিলেন সবচাইতে কাছের মানুষকেও বিশ্বাস করতে দ্বিধা বোধ করেন তিনি। ঠিক স্বস্তি পান না। ‘আমি বলতে পারি যে আমি আমার মাকে বিশ্বাস করব, কিন্তু আমি এটাও জানি না তিনি এমন কিছু করে বসবেন কিনা যেটা আমার জন্য ভালো হবে বলে তিনি ভাবেন,’ বলেছিলেন জোলি। ‘আমি বিশ্বাস করি যে ব্রাড কখনও এমন কিছু করবে না… আমি জানি না। আমি কাউকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করি না।’
ব্রাড পিটের উপর তার বিশ্বাস পরবর্তীতে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। যখন গুজব উঠেছিল, ব্রাড পিট তার “Allied” মুভির সহ অভিনেত্রী ম্যারিয়ন কোটিলার্ড (Marion Cotillard) এর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। পিট-জোলির বিয়ের কয়েক বছর পরের ঘটনা এটা। গুজবটা বেশ শক্তভাবে ছড়িয়েছিল। সত্যও প্রমাণ হয়েছিল একটা সোর্সের মাধ্যমে।
জোলি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর ভাড়া করেছিলেন তখন। স্বামী ব্রাড পিটের উপর নজরদারি করার জন্য। ঐ সোর্স থেকে বলা হয়, ‘তিনি (জোলি) অনুভব করেছিলেন সে (পিট) অভিনয়ের সেটে কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে বসেছেন। আর দেখা গেল তা-ই সত্যি।’
যদিও অমন কোনো প্রতারণা শেষমেশ প্রমাণ হয়নি। আর তাদের সত্যিকার ছাড়াছাড়ির পেছনে ওটা দায়ীও ছিল না। দায়ী ছিল অন্যকিছু। যা জোলির ভাষ্যমতে, ‘পরিবারের ভালো থাকাটা। আর এটাই ছিল তখন সঠিক সিদ্ধান্ত।’
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এর একাধিক শারীরিক সমস্যা:
কৈশোর বয়স থেকেই ক্ষুধামন্দায় ভুগে এসেছেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। প্রায়ই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতেন এই খাবারের প্রতি অনীহার কারণে।
২০১৩ সালে জোলি The New York Times এর মাধ্যমে প্রকাশ করলেন, ডাবল ম্যাসটেকোমি এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। কারণ ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন তিনি। ‘আমার মাঝে এক ত্রুটিপূর্ণ জিন রয়েছে। BRCA1 নামক এই জিন তীব্রভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সার আর ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। আমার ডাক্তাররা ধারণা করছেন যে, আমার ব্রেস্ট ক্যান্সারের ৮৭% আর ওভারিয়ান ক্যান্সারের ৫০% ঝুঁকি রয়েছে। অবশ্য প্রতিটা নারীর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকির মাত্রা ভিন্ন।”
পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল অনেকটা কোনো সায়েন্স ফিকশন মুভি থেকে তুলে আনা কোনো দৃশ্যের মতো। কিন্তু জোলি তার ব্রেস্ট সার্জারী করিয়েছেন। ঝুঁকি নিয়েছেন। এতে নিজেকে একটুখানিও কম নারী মনে হয়নি তার। সাহসী, তাই নয় কি?
দুই বছর পর এক রক্ত পরীক্ষায় ক্যান্সারের লক্ষণ দেখতে পেয়ে তিনি তার ওভারি আর ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণ করান। সহজ কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না সেটা। কিন্তু তিনি তা পেরেছেন।
ব্রাড পিটের সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর নিজেকে গুটিয়ে নেয়া:
ব্রাড পিটের সাথে জোলির ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর, নিজের মাঝে বেশ গুটিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন নিজেকে। তার কোনো বন্ধু ছিল না যার কাছে সব খুলে বলা যায়। ব্রাড পিট ই ততদিন পর্যন্ত একমাত্র বন্ধু ছিলেন।
তাই পিটের সাথে সব শেষ হওয়ার পর অনেকেই তাকে নিয়ে ভাবনা প্রকাশ করেন। অবশ্য প্যানডেমিক এর বিচ্ছিন্নতার সময় তিনি তার পুরোনো বন্ধু ও অভিনেত্রী এলেন পম্পেও (Ellen Pompeo) এর সাথে আবার যোগাযোগ করেন। বন্ধুত্ব ফিরে যায় আগের অবস্থানে।
বিগত কয়েক বছর ধরে মায়ের অভাব ভোগ করা:
সবকিছুর মাঝেও যে একটা মানুষকে জোলি খুব ভালোবাসতেন আর ভরসা করতেন, সে হচ্ছে তার মা মার্সেলিন বার্ট্রান্ড। ক্যান্সারের সাথে লড়ে ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা এই অভিনেত্রী ছিলেন, জোলির জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভরসার জায়গা। যেখানে গিয়ে সব বলে ফেলা যায়। স্বান্তনা পাওয়া যায়। তাই বিগত কয়েক বছরে মাকে প্রচণ্ড মিস করেছেন তিনি।
মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ২০১৭ সালে Elle France এ জোলি বলেছেন, ‘একজন চমৎকার নানি হতে পারতেন তিনি। এই সময়টায় তাকে আমার সাথে পাওয়ার জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি আছি আমি। তাকে খুব দরকার ছিল আমার।’
এই দুর্বলতা, অসুস্থতা, বাবার অসহযোগী আচরণ, শারীরিক সমস্যা, মানসিক অসুস্থতা, একাকীত্ব সব কাটিয়েও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি হয়েছেন একজন সফল ব্যক্তিত্ব। সফল একজন মা। মানবতাবাদী এমন একজন যাকে দেখে উৎসাহিত হওয়া যায়।
সবকিছু চাপিয়ে তিনি আমাদের সবার প্রিয় অ্যাঞ্জেলিনা জোলি হয়েছেন। স্রেফ একজন সফল অভিনেত্রী যার আবেদন এখনও কমেনি একটুখানিও, তিনি নন। তিনি একজন আদর্শ। একজন অসাধারণ মা। শক্তিশালী নারী। একজন চমৎকার মানুষ।
References:
- Angelina Jolie’s Demons Revealed: A Secret Hospital Stay, Self-Harm, & Incest Rumors
- Angelina Jolie Biography
- Sex and the Single Mom
- All about Angelina Jolie
- Jolie Talks about Gia Similarities
- Angelina Jolie reveals drama of how she tried to hire a hitman to kill her
- Why Brad And Angelina’s Relationship Was Doomed From The Moment They Met
- The Tragic Real-Life Story Of Angelina Jolie
- Short Story Of Angelina Jolie