আতর, টুপি ও জায়নামাজের গল্প!

ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। এই আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে চলে কেনাকাটার ধুম। ঈদকে কেন্দ্র করেই সেজে ওঠে বাহারি রকমের দোকান-পাট। দোকানীরা সেরে নেয় কাঙ্খিত বিকিকিনি। শুধু জামা কাপড় বা ঘরের টুকটাক জিনিসই নয়, ঈদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি হিসেবে চলে আতর, টুপি ও জায়নামাজ কেনার প্রস্তুতি। ঈদের দিনটিতে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা নিজেকে একটু পরিপাটি রাখতে চান। মূলত ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করেই চলে আতর, টুপি ও জায়নামাজ কেনাবেচার ধুম। সদ্য কেনা ভাঁজ ভাঙা পাঞ্জাবিতে আতরের সুবাস, নতুন টুপি আর হাতে জায়নামাজ এটিই মূলত চিরচেনা বাঙালি মুসলমানদের ঈদগাহে যাওয়ার রূপ। যা বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্যের সাথে মিলে-মিশে একাকার।
আতরের ইতিহাস:
ভেষজ উৎস থেকে উৎপাদিত একটি প্রাকৃতিক সুগন্ধীর নাম হলো আতর। পারসিয়ান ইতিহাস থেকেই আতর শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হলো সুগন্ধি। মুসলমানদের কাছে আরত হলো জনপ্রিয় ও অধিক ব্যবহৃত সুগন্ধি। মুসলমানরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিশেষ করে ঈদ, মিলাদ মাহফিল বা নামাজ আদায় করতে যাবার আগে আতর ব্যবহার করে থাকেন। আতর পুরুষদের একটি হালাল সুগন্ধি। আবার মৃত ব্যক্তিরও একমাত্র প্রসাধনও হলো এই আতর। মিশরীয়রা সুগন্ধী তৈরিতে প্রাচীনকাল থেকেই বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। তারা বিভিন্ন গাছ ও ফুল থেকে নির্যাস সংগ্রহ এবং বিভিন্ন তেলের সাথে মিশিয়ে আতর তৈরি করতেন। পরে বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক আল শেখ আল-রইস নানা রকমের সুগন্ধি তৈরীর প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবন করেন ও পাতন প্রক্রিয়ার সাহায্যে তিনি সুগন্ধি তৈরি করতেন। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোয় সুগন্ধির অস্তিত্ব পাওয়া যায় আবার চরক আর সুশ্রুত সংহিতায়ও সুগন্ধির উল্লেখ পাওয়া যায়।
টুপির ইতিহাস:
ইসলাম ধর্মে কাপড়ের কিছু দিয়ে মাথা আচ্ছাদন করে রাখার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। ইসলাম ধর্মে পুরুষ-নারী, শিশু সহ সকলকেই নির্বিশেষে মাথায় কাপড় আচ্ছাদনের বিধান দেওয়া হয়েছে। যদিও মাথা ঢেকে রাখেন নারীর ওড়না বা হিজাব দিয়ে, তবে টুপি পরিধান করা পুরুষের জন্য একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের আওতাগত। তবে টুপি ছাড়াও মুসলিম পুরুষেরা মাথায় পাগড়ি পরতে পারেন। টুপি মাথার উপরি অংশের প্রায় পুরোটাই জুড়ে থাকে তবে কপাল ঢেকে রাখে না। এর মূল কারণ হলো মেঝেতে কপাল ছুঁইয়ে সিজ্দা করেন মুসলমানরা। আর সিজ্দা করার জন্য কপাল উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজন হয়।
আবার ধর্মীয় কারণে বহু স্থানে ও দেশে টুপি পরিধানে প্রচলন আছে। সৌদি আরবে ধর্মীয় কারণে টুপি পরা হয়, একসময় টুপিকে সৌদি আরবে কালানসুয়া বলা হতো। কিন্তু এখন এদেশে টুপিকে তাকিয়া বলা হয়ে থাকে। সুফিদের হাত ধরেই বাঙালিদের মধ্যে টুপির প্রচলন শুরু হয়। তবে এ নিয়ে আছে নানা জনের নানা ধরণের মতবাদ। দেশে টুপির নকশায়ও রয়েছে পরিবর্তন ও তারতম্য। সৌদি আরব, পারস্য, রোমান, আফ্রিকার বহু দেশে টুপি পরার প্রচলন আছে। এছাড়া চীনে বহু বছরের একটি পুরাতন প্রথা এটি। সংস্কৃতি, রাজনীতি আর ধর্ম এই তিনটি কারণে টুপি ব্যবহৃত হয় ভিন্ন দিক থেকে। তবে ধর্মীয় কারণে মুসলিমদের কাছে টুপির আলাদা ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। সুঁই-সুতার কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হয় হরেক রকমের টুপিতে। যা বাংলার কারুশিল্পকে ধারণ করে।
জায়নামাজের ইতিহাস:
জায় অর্থ মাটি বা জমি আর নামাজ এই শব্দ দুটোই ফারসি। অর্থাৎ জায়নামাজ এসেছে ফারসি শব্দ থেকে। মুসলমানরা নামাজের সময় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করেন। তবে জায়নামাজ বিছানো বাধ্যতামূলক নয়। মূলত নামাজের স্থলের ধুলো থেকে রক্ষার জন্য এর ব্যবহার রয়েছে। নামাজের স্থান পবিত্র রাখা মূলত নামাজের অন্যতম ফরজ। সে অনুযায়ী জায়নামাজকেও পবিত্র রাখতে হয়। এটির আকার এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে মুসল্লিরা স্বচ্ছন্দে তাতে নামাজ আদায় করতে পারে। জায়নামাজ তৈরি করা হয় এক বা একাধিক ব্যক্তির উপযোগী করে। আর একাধিক ব্যক্তির ব্যবহার উপযোগী জায়নামাজ সাধারণত মসজিদ, ঈদগাহ এমন বড় আকারের জামায়াতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে আবার এক ব্যক্তির জন্য ব্যবহার উপযোগী জায়নামাজ ব্যক্তিগত ভাবেই ব্যবহৃত হয়।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জায়নামাজে নামাজ পড়তেন ও সেই জায়নামাজকে বলা হতো খুমরাহ। এই খুমরাহ মূলত খেজুরগাছের আঁশ থেকে তৈরি হতো। আরবের অধিবাসীরা এখন যেগুলো ব্যবহার করে, সেগুলোকে সাজ্জাদা বা মুসল্লা বলে। রাজা-বাদশাহরা বিভিন্ন সময়ে রাজশিল্পীদের দিয়ে জায়নামাজের নকশা করিয়েছেন। শ্রেষ্ঠ বয়ন শিল্পীরাই সেগুলো বুনতেন। আর রাজা-বাদশাহরা সেই অনিন্দ্য সুন্দর জায়নামাজে নামাজ পড়তেন। আবার অনেক সময় এই জায়নামাজ হয়ে উঠেছিল শিল্পীর ক্যানভাস। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইতালির রেনেসাঁ শিল্পী জিওভান্নি বেল্লিনি, ভিত্তোরে কারপাচ্চিও এবং লোরেঞ্জো লোত্তো তুরস্কের জায়নামাজকে তাঁদের ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করেন। ইরানে চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই দারুণ সব জায়নামাজ তৈরি করা হয়েছে। পারস্যের গালিচা শিল্পীরা বুনেছেন নানা ধরনের ও রকমের জায়নামাজ। জায়নামাজের নকশায় মিহরাবের উপস্থিতি বিদ্যমান। এই মিহরাব নানাভাবে ঘুরেফিরে এসেছে জায়নামাজে। দেশে দেশে এর বিষয়টির আলাদা ছিল না। এমনকি এখন চৈনিকরা যে কারখানা ভিত্তিক জায়নামাজের উৎপাদন করছে, সেখানেও নকশায় মিহরাবের উপস্থিতি রয়েছে।
অলংকরণের জন্য জায়নামাজে অনেক রকম নকশা দেওয়া হয়ে থাকে। এতে বিভিন্ন লতাপাতা, ফুল ও অপ্রাণীবাচক নকশা অঙ্কন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও মসজিদের ছবিও নকশায় হিসেবে জায়নামাজে ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় মেহরাবের ছবি জায়নামাজের অঙ্কিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অবশ্য জায়নামাজ বিছানোর সময় মেহরাবের উপরের দিক কিবলার দিকে করে রাখা হয়। জায়নামাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে নানা ধরনের উপাদান। এখনো যেমন হাতে বোনা হয় আবার তেমনি কারখানায়ও তৈরি হয়ে থাকে। এর আকার-আকৃতিতেও অনেক রকমের। সাধারণভাবে জায়নামাজের মাপ হলো আড়াই ফুট চওড়া ও চার ফুট লম্বা। আসলে একজন মানুষের হাঁটু গেড়ে বসতে যেটুকু পরিসরের প্রয়োজন হয় সেটাই মূলত জায়নামাজের মাপ। আমাদের দেশে এখন দেশি ও বিদেশি জায়নামাজ পাওয়া যায়। তবে একসময় ছোট ছোট মাদুর তৈরি করা হতো নামাজ আদায়ের জন্য। কিন্তু এখন সেসব প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার জায়গায় এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জায়নামাজ। এই জায়নামাজ ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। এটি মুসলমানদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
আতর, টুপি ও জায়নামাজ প্রাপ্তি স্থান:
মূলত ঈদকে কেন্দ্র করেই রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আতর, টুপি ও জায়নামাজের দোকান সাজানো হয়। এসময় রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তান, পল্টন, নিউ মার্কেট, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, সদরঘাট, চকবাজার, ইসলামপুর, ওয়াইজ ঘাট, মিটফোর্ড, ফার্মগেট, পল্টন, মতিঝিল, লালবাগ, রামপুরা, উত্তরা, বনানী, মিরপুর, শান্তিনগর, মালিবাগ সহ বিভিন্ন এলাকায় ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আতর, টুপি ও জায়নামাজের দোকানে থাকে উপচে পড়া ভিড়। এসব দোকানগুলোতে নানা ডিজাইনের টুপি, আতর ও জায়নামাজ সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। ঈদে এর চাহিদা থাকলে শেষের দিনগুলোতে তা আরও বেড়ে যায়, জমে ওঠে আতর, টুপি ও জায়নামাজের কেনাবেচা আর বিক্রেতারা পার করেন ব্যস্ত সময়। ঈদ ছাড়া অন্য সময়ে সাধারণত ইসলামী অনুষ্ঠান, মাহফিল, ওয়াজ প্রভৃতি উপলক্ষ্যে বা মসজিদের সামনে দোকানীরা টুপি, আতর ও জায়নামাজের দোকান সাজিয়ে বসেন।
সুগন্ধি আতরের দাম:
অনেক ধর্মপ্রাণ মুসল্লী সারাবছর আতর ব্যবহার করলেও ঈদে আতরের চাহিদা ও কদর থাকে আকাশ ছোঁয়া। হালকা ও কড়া সুবাসের আতর বাজারে পাওয়া যায়। প্রসাধনী হিসেবে আতরের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি। আতর সাধারণত তোলা হিসাবে বিক্রি করা হয়। অধিক দামের কারণে অল্প পরিমাণে ক্রেতারা কিনে থাকেন। তবে বাজারে কমদামি আতরেরও প্রচলন রয়েছে যার মান খুব একটা ভালো নয়। সৌদি আরবের উদ আতরের এক তোলার দাম সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। আল হারমাইন শেখের এক তোলা ২০ হাজার টাকা, কস্তুরি আতরের এক তোলা ১৪ হাজার টাকা ও মুস্তাহ আল তাহারা এর এক তোলা আতর সাড়ে ৪ হাজার টাকা দামের হয়ে থাকে। তবে বেশি বিক্রি হয় আলিফ, আল ফারহান, আল ইসরাত, জান্নাতুল নাঈম, আল রিসাব, জান্নাতুল ফেরদাউস, শাইখা, হাজরে আসওয়াদ, সুলতান, রজনীগন্ধা, বকুল, সুরভি ও বেলি ফুলের আতর। এছাড়া সৌদি আরবের আল রিহাব কোম্পানির আতর ৬ মিলিগ্রাম ১৮০ থেকে ২৫০ টাকায়, ভারতের আল নাঈম কোম্পানির ৮ মিলিগ্রাম বোতলের আতর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় পাওয়া যায়। দেশি কোম্পানি ফারহানের আতর ৬ মিলি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় এবং আলিফ কোম্পানির আতর ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে। সাধারণত বিত্তবান ক্রেতারা সবসময় দামি আতর কিনে থাকেন।

টুপির বাহারি দাম:
সারাবছর টুপির চাহিদা থাকলেও ঈদে এর চাহিদা একটু বেশিই। তখন দেশি কারখানাগুলোতেও থাকে টুপি তৈরির ব্যস্ততা। এছাড়া গ্রামের নারীরা টুপিতে তোলে বাহারি নকশা। দেশি টুপির পাশাপাশি বিদেশি টুপিও বিক্রি হয়। পেশোয়ারি টুপির দাম সবচেয়ে বেশি। এটির সর্বোচ্চ দাম ১৫ হাজার টাকা। আল-ফারুকের টুপি, ফিরোজের টুপি, দেশি জালি টুপি প্রভৃতির চাহিদা টুপির বাজারে সবচেয়ে বেশি। বাহারি ডিজাইন, নকশা, জরি-সুতার ভরাট কাজ এবং ছোট্ট পুঁতি বসানো প্যাঁচের নকশার মতো কাজের কারণে টুপির দামের তারতম্য হয়ে থাকে। সাধারণত দেশি বিভিন্ন টুপির দাম ১০০ থেকে ৪০০ টাকা। এছাড়া সুলতান সোলেমানি টুপির দাম ২৫০০ টাকা, রুমি টুপি ২০০০ টাকা, ওমানি টুপি ১২০০ টাকা, মিসরীয় টুপি ১০০০ টাকা, মুম্বাই টুপি ৭০০ টাকা, পাকিস্তানি সিন্ধি টুপি ১০০০ টাকা, পাকিস্তানি আলকব টুপি ৫০০ টাকা এবং আফগানি টুপির দাম ৫০০ টাকা। দেশি টুপির তুলনায় বিদেশি টুপির দাম তুলনামূলক বেশি।

জায়নামাজের দাম:
কাপড়, বুনন, কোমলতা ও নকশার উপর জায়নামাজের দাম নির্ধারিত হয়। পাকিস্তানি ও তুর্কি জায়নামাজ ক্রেতারা পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে। তুর্কি জায়নামাজের দাম সবচেয়ে বেশি যা পাওয়া যায় ৩৫০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকায়। তবে আমাদের দেশি জায়নামাজের দাম তুলনামূলক কম, ১৫০-৫০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়। এছাড়া পাকিস্তানি জায়নামাজ ৫০০-২০০০ টাকা, বেলজিয়ামের ৮০০-৫০০০ টাকা, তুরস্কের ৫০০-৩০০০ টাকা, মধ্যপ্রাচ্যেরগুলো ৮০০-২০০০ টাকা এবং চীন ও ভারতের জায়নামাজ ৫০০-১০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়৷ তবে স্থান ভেদে ও দরদামের ভিত্তিতে দামের পার্থক্য হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন: মন খারাপ দূর করে কলা!
পরিশেষে বলা যায়, আতর, টুপি, জায়নামাজ বাঙালি মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মিশে আছে। এসব জিনিসকে ইসলামে পবিত্র বলে মানা হয়। আবার এই জিনিসগুলোর সাথেই বাংলা ঐতিহ্যের একটি মেলবন্ধন পাওয়া যায়।