এপিজে আবদুল কালাম : ভারতের মিসাইল ম্যান!
ভারতবর্ষের বুকে জন্ম নেওয়া যেসকল কৃতি সন্তান পৃথিবীতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে গিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন ডক্টর এপিজে আবদুল কালাম। এপিজে আবদুল কালাম এমন একজন মানুষ সমগ্র ভারত জুড়ে যাকে অপছন্দ করার মতন সম্ভবত একজনও নেই। চলুন আজ জেনে নিই ভারতের মিসাইল ম্যান নামে খ্যাতি পাওয়া এই মানুষটির জীবনের গল্প!
এপিজে আবদুল কালাম
ভূমিকা:
এপিজে আবদুল কালাম ছিলেন ভারতের পরমাণু অস্ত্র তৈরির মূল কারিগর। এজন্যে তাকে ‘মিসাইল ম্যান অব ইন্ডিয়া’ উপাধি দেওয়া হয়। ছিলেন ভারতের ১১ তম রাষ্ট্রপতি। তিনি ছিলেন একজন মুসলিম। ভারতে সংখ্যালঘু রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয়।
জন্ম ও পরিচয়:
১৯৩১ সালের ১৫ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি বা বর্তমান তামিলনাড়ুর রাজ্যের সমুদ্র তীরবর্তী বিখ্যাত তীর্থস্থান রামেশ্বরমে এপিজে আবদুল কালাম জন্মগ্রহণ করেন। সেখানকার এক দরিদ্র তামিল মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। এপিজে আবদুল কালামের পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল আবেদীন আবদুল কালাম। তার পিতা জয়নুল আবেদীন ছিলেন সামান্য একজন নৌকা মালিক ও মসজিদের ইমাম এবং মাতা আশিয়াম্মা ছিলেন একজন গৃহবধূ। যদিও কালামের বংশপঞ্জি থেকে জানা যায় তার পূর্বপুরুষেরা বৈদেশিক বাণিজ্যের মতোন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করার কারণে ছেলেবেলা থেকেই আবদুল কালামকে অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। এই সময়ে সংসারে সাহায্য করার জন্য ছেলেবেলায় তিনি খবরের কাগজও বিলি করেছেন। ছেলেবেলা থেকেই কালাম ছিলেন একজন পরিশ্রমী মানুষ। পিতা ও মাতার জীবন দর্শন তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর পিতা রামেশ্বরম ও ধনুষ্কোডির মধ্যে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের নৌকায় পারাপার করাতেন। কালামের পরিবার ছিলো অত্যন্ত গরিব। অল্প বয়স থেকেই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাকে কাজ করা শুরু করতে হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করার পর পিতাকে সাহায্য করার জন্য তাকে সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করতে হয়। বিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন সাধারণ মানের ছাত্র। কিন্তু তাঁর শিক্ষাগ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি পড়াশোনা করতেন ও অঙ্ক কষতেন।
শিক্ষাজীবন:
এপিজে আবদুল কালাম আজাদ ছিলেন স্কুলের অতি সাধারণ এক শিক্ষার্থী। তিনি পড়াশোনায় খুব তুখোড় ছিলেন না। তবে অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। এপিজে আবদুল কালাম তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন রামনাথপুর স্কোয়ারটজ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে। এই বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তিনি তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফ কলেজে ভর্তি হন।
আরও পড়ুন# সিম কার্ড পরিষ্কার করবেন কীভাবে!
এখানে তার পড়াশোনার বিষয় ছিল পদার্থবিজ্ঞান। যদিও পাঠ্যক্রমের শেষ পর্যায়ে তিনি পদার্থবিদ্যা বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। ১৯৫৪ সালে সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তার পরের বছর তিনি তৎকালীন মাদ্রাজ বা বর্তমান চেন্নাই এসে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে বিমান প্রযুক্তি বা এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভর্তি হন।
এইখান থেকে বিমান প্রযুক্তির পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে কালাম ভারতীয় বায়ুসেনাতে (বিমান বাহিনী) যোগদানের চেষ্টা করেন। যদিও খুব অল্পের জন্য তিনি সেপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম:
মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক সম্পন্ন করে বিমান বাহিনীতে যোগদানের জন্যে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৬০ সালে এপিজে আবদুল কালাম ভারতীয় ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা বা DRDO’র অ্যারোনোটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্টের একজন জুনিয়র বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন।
এইখান থেকেই তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের সূচনা হয়। বেশ কিছুদিন এখানে কাজ করবার পর তিনি প্রখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী ড: বিক্রম সারাভাই-এর অধীনে ভারতীয় জাতীয় মহাকাশ গবেষণা কমিটিতে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সাল নাগাদ নিজের অদ্ভুত কর্ম দক্ষতার কারণে কালাম ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বা ইসরোতে বদলি হন। এইখানে তার কর্মজীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। ইসরোতে নিজের মেধাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগিয়ে কালাম ভারতবর্ষের মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বিকাশ আনতে থাকেন। ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপনকারী যান এস.এল.ভি ৩ তাঁর তত্ত্বাবধানেই রোহিণী নামক কৃত্রিম উপগ্রহকে কক্ষপথে স্থাপন করে। ভারতের রকেট প্রযুক্তি এপিজে আবদুল কালামের হাত ধরেই পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। সরকার থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সমর্থন জোগাড় করে তিনি এই ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। পেশাদারী কর্মজীবনের শেষের দিকে তিনি পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল বা পিএসএলভি তৈরি করার দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান এবং সফলতার মুখ দেখেন।
রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম:
২০০২ সালে তৎকালীন শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বিরোধীদল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সর্বাত্মক সমর্থনে এপিজে আবদুল কালাম ভারতবর্ষের ১১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময়ে তিনি কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছেই বিরাগভাজন হননি। বরং তার বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং অসামান্য জীবনদর্শন তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল স্তরে একজন আইকন হিসেবে তুলে ধরেছিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে কর্মভার সামলানোর সময়ে তিনি দেশের পক্ষে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণও করেছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি হয়েও নিজের পরিবারের সদস্যদের কোন প্রকার আর্থিক বা দাপ্তরিক সহায়তা দেননি। রাষ্ট্রপতি ভবনে তিনি অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় সব অনুষ্ঠান বাতিল করে দেন। তার সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে জমকালো কোন অনুষ্ঠানও হতো না। তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অপ্রয়োজনীয় অর্থব্যয় পছন্দ করতেন না। তিনি মনে করতেন এসব টাকা জনগণের কল্যাণার্থে ব্যয় করা উচিত। এজন্যে একজন মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনের ইফতার পার্টির আয়োজন বন্ধ করে দেন। তার পরিবর্তে এই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন।
জাতীয় অগ্রগতিতে অবদান:
ভারতের জাতীয় অগ্রগতিতে আব্দুল কালামের অবদান বলে শেষ করার মতো না। ভারত আজ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যতোটুকু স্বনির্ভরতা এবং উন্নতি সাধন করেছে তার অনেকটার জন্যেই এপিজে আবদুল কালামকে কৃতিত্ব দান করতে হবে। এপিজে আবদুল কালাম একদিকে যেমন ডিআরডিওতে কর্মরত থাকাকালীন ভারতের সামরিক সুসংহত নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থেকেছেন, অন্যদিকে তেমন অসামরিক মহাকাশ গবেষণা কর্মসূচির ক্ষেত্রেও দেশকে বহুলাংশে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন# শিনজো আবের বর্ণাঢ্য জীবন: উত্থান, বিতর্ক ও মৃত্যু
ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং অসামরিক মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে মহাকাশযান বহনকারী রকেট উন্নয়নে তার বিপুল অবদানের জন্য তাকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়। সর্বোপরি ১৯৯৮ সালে ভারতের পরীক্ষামূলক পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ পোখরান-২ তে কালাম প্রধান সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক পরিচালকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন সময় তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব শান্তির পক্ষে জোরদার প্রশ্ন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিবেশনে তার প্রদত্ত বিশ্বশান্তি সম্পর্কিত বক্তৃতাটি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে!
এপিজে আবদুল কালাম রচিত গ্রন্থসমূহ:
এপিজে আবদুল কালাম বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থটি হলো তার লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, ‘Wings of fire’. এই বইতে তিনি তার জীবনের নানান ঘাত প্রতিঘাত ও চড়াই উৎড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তার রচিত ‘টার্নিং পয়েন্টস’, ‘ইগনাইটেড মাইন্ডস’, ‘ফোর্জ ইউর ফিউচার’ ইত্যাদি বইগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
জীবদ্দশায় এপিজে আবদুল কালাম অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি রামানুজন পুরস্কার, বীর সাভারকর পুরস্কার, হুভার মেডেল, ইন্দিরা গান্ধী আওয়ার্ড ফর নেশনাল ইন্টিগ্রেশন ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ১৯৮১ সালে তিনি লাভ করেন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মভূষণ পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পুরষ্কারে ভূষিত হন এ মহান বিজ্ঞানী!
মৃত্যু:
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জুলাই, সোমবার, মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানে বসবাসযোগ্য পৃথিবী বিষয়ে বক্তব্য রাখার সময় ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬:৩০ নাগাদ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। তাকে বেথানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন# হুমায়ূন আহমেদ : বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র
কালামের মৃতদেহ ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে শিলং থেকে গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে একটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানে নয়াদিল্লির পালাম বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তিন বাহিনীর প্রধান কালামের মরদেহে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। এরপর জাতীয় পতাকায় ঢেকে কালামের দেহ ১০, রাজাজি মার্গে তাঁর দিল্লির বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া হলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবসহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিরা শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
ভারত সরকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কালামের মৃত্যুতে তাঁর সম্মানে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা করে।
শেষ কথা:
জন্মিলে মরতে হবে, এ কথা আমরা সবাই জানি। এই অমোঘ বাণীকে সত্যি করে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ভারতের মিসাইল ম্যান। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন কোটি ভারতীয়র হৃদয়ে। আজও ভারতবাসী তাদের এই মহান নেতার স্মৃতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।