ঐতিহ্যফিচারলোকসংস্কৃতি

হাওয়াই মিঠাই: বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিঠাই!

অনেককিছুই বদলে গেছে কালের পরিবর্তনের কারণে। আবার মানুষের খাদ্যাভাসেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শুধু তাই নয় রকমারি খাবারের মধ্যে বিশেষ করে ফেরি করে বিক্রি করা খাবারে এসেছে অনেক পরিবর্তন। ফেরি করা খাবারের মধ্যে তিলের খাজা, শন পাপড়ি, পাপড় প্রভৃতি রকমারি খাবার বাংলায় প্রচলিত। তারমধ্যে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি মিঠাইয়ের নাম হলো হাওয়াই মিঠাই। গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে এটি মিঠাই হিসেবেই জনপ্রিয়। এক সময় গ্রামাঞ্চলে এই সুমিষ্ট খাবারটির ব্যাপক প্রচলন ছিল। শিশুদের পছন্দে খাবারটি শীর্ষ তালিকায় থাকলেও খেতে ভোলেন না বিভিন্ন বয়সের মানুষ। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই হাওয়াই মিঠাই আর খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্ত এখনো তা বিলীন হয়ে যায়নি।

হওয়াই মিঠাই:

হাওয়াই মিঠাই হলো এক প্রকার মিষ্টি জাতীয় খাদ্যবিশেষ। এটি একটি সুপরিচিত মিষ্টি। এটির প্রধান ও মজাদার বৈশিষ্ট্য হলো মুখে দিলেই এটি দ্রুত মিলিয়ে যায়, এজন্যই এর নাম রাখা হয়েছে হাওয়াই মিঠাই। অর্থাৎ ওজনে একদম হালকা আর বিশাল এক টুকরো মুখে ঢোকানোর সাথে সাথেই হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায় বলেই এই মুখরোচক খাবারটির নাম হাওয়াই মিঠাই। এটি বানানোর সাথে সাথেই মুখে দিয়ে খেতে হয়। তবে পেট ভরে না এ মিঠাইয়ে, কিন্তু খেতে ভারি মিষ্টি। শুধুমাত্র মুখের স্বাদ মেটায়।

এটি দেখতে অনেক বড়োসড়ো মনে হলেও নিমিষেই এটি মুখের ভেতরে দিলে গলে যায়। বিশেষ করে গ্রামের শিশুরা এই হাওয়াই মিঠাই দেখে ও খেয়ে বেশি আনন্দ পায়। এটি দেখে মনে হয় কাঠির মাথায় যেন এক টুকরো গোলাপি কিংবা সাদা রঙের মেঘ।

ছোটো-বড়ো সকলের কাছেই এটি পছন্দের খাবার বিধায় কোথাও বেড়াতে গেলেই প্রায় সব ছোট শিশুরা এমনকি বড়োরাও এই কাঠির মাথায় এক টুকরো মেঘ খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আবার অনেকেই মজা করে হাওয়াই মিঠাইকে বুড়ির মাথার পাকা চুলও বলে থাকেন। বাংলাতে হাওয়াই মিঠাইয়ের যেমন অনেকগুলো নাম, ঠিক তেমনি ইংরেজিতেও এর অনেকগুলো নাম রয়েছে। যেমন: কটন ক্যান্ডি, ফেয়ারি ফ্লস, ক্যান্ডি ফ্লস বা স্পুন সুগার ইত্যাদি।

হাওয়াই মিঠাই এর ইতিহাস:

ইটালিতে চিনি দিয়ে তৈরি এই মজার খাবারের প্রচলন শুরু হয় চৌদ্দ শতকের দিকে। সেই সময় মূলত ঘরোয়া ভাবেই সামান্য চিনির ঘন রসের সাহায্যে বিশেষ পদ্ধতিতে সুতোর মতো তৈরি করে বানানো হত হাওয়াই মিঠাই। যা আঠারো শতক পর্যন্ত এইভাবে তৈরি হয়েছে।

মার্কিন আবিষ্কারক উইলিয়ম মরিসন ও জন সি. ওয়ারটন হাওয়াই মিঠাই তৈরির জন্য ১৮৯৭ সালে প্রথম মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিনের সাহায্যেই চিনির যে সুতো তৈরি করা যেত সেগুলো আরও সূক্ষ্ম হয় এবং বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গেই শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তাড়াতাড়ি মিঠাই তৈরি হতে থাকে।

তবে মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই তখনও তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯০৪ সালে ব্যাপকভাবে এর প্রসার বাড়তে শুরু করে। সেই বছর মরিসন এবং ওয়ারটন তাদের মেশিনে তৈরি করা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাজির হন সেন্ট লুইসের বিশ্ব মেলায়। অবাক হওয়ার মত বিষয় হলো, মেলার প্রথম দিনেই তারা ২৫ সেন্ট করে ৬৮ হাজার ৬৫৫ বাক্স হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করেছিল, যেটি ছিল সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী অনেক বড়ো একটা অঙ্ক।

এরপর ক্রমেই বিশ্বজুড়ে খাবারটি ব্যাপক হারে জনপ্রিয়তা লাভ করে। খাবারটির চাহিদা ও জনপ্রিয়তার জন্য একাধিক কোম্পানি এগিয়ে আসে এবং বৃদ্ধি পায় এই মজাদার খাবাররের উৎপাদন ও বিপণনের কাজ। পরবর্তীকালে টটসি রোল অফ কানাডা লি. বিশ্বের সর্বাধিক হাওয়াই মিঠাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯২০ সালে মার্কিনরা দেখতে অনেকটা তুলার মতো এই মিঠায়ের নাম দেয় কটন ক্যান্ডি। তাদের কাছে এটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তারা এই হাওয়াই মিঠায়ের এতই ভক্ত হয়ে যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭ ডিসেম্বর দিনটি ‘জাতীয় কটন ক্যান্ডি ডে’ হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে।

ইউরোপ- আমেরিকার পরে আমাদের দেশে হাওয়াই মিঠাই তৈরি শুরু হয় এমন কথা জানা যায় না। কারণ বহুকাল আগেই এখানে চিনি দিয়ে তৈরি শনপাপড়ি তৈরি করা হতো। ইতিহাস অনুসারে, হাওয়াই মিঠাই আমাদের দেশে আগে থেকেই খুবই জনপ্রিয় ছিল। আগের দিনে কোথাও হাওয়াই মিঠাইওয়ালাদের হাঁকডাক পেলেই বাড়ির ছোটো ছেলে-মেয়েরা থেকে শুরু করে বড়োরাও এ খাবার কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করত।

আবার হাতে টাকা-পয়সা না থাকলে বাড়ির পুরোনো জিনিসপত্র যেমন- পুরোনো পিতলের জিনিসপাতি, পুরাতন কাপড়-চোপড় বা অন্য কিছু দিয়ে কেনা হতো এই মিষ্টি হাওয়াই মিঠাই। তখন হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে প্রচুর লাভও হত বিক্রেতাদের। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এ দেশে এই খাবার এত জনপ্রিয় না থাকলেও এর স্বাদ এখনও তুলনাহীন। উন্নত বিশ্বের মত আমাদের দেশে অবশ্য হাওয়াই মিঠাই আজও একইভাবে উৎপাদন এবং সুন্দর প্যাকেজিং এর মাধ্যমে বিপণন করা হয় না।

হওয়াই মিঠাই তৈরির প্রক্রিয়া:

সাধারণত হাওয়াই মিঠাই তৈরি করা হয় যন্ত্রের সাহায্যে। এই যন্ত্রের নিচের অংশে একটি মোটরচালিত চুলা থাকে। এখানেই মূলত সাদা চিনিকে তাপ দিয়ে গলানো হয়। অধিক তাপে গলে যায় চিনি। তাপ প্রয়োগের ফলে ঘন চিনি সিরায় পরিণত হয়। এরপর এই চিনির সিরার সঙ্গে মেশানো হয় ফুড কালার।

আবার ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষে গন্ধ ও স্বাদের জন্য নানা ধরনের সুগন্ধিও ব্যবহার করা হয়। আর যন্ত্রের ওপরের অংশে মোটরের সাহায্যে একটি চাকা তীব্র বেগে ঘুরতে থাকে। চাকাটিকে আবার আবৃত করে থাকে একটি অতি সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত পাতলা স্টিলের পাত। গরম ঘন চিনির সিরা ছিদ্রযুক্ত সেই লোহার পাত দিয়ে বের হওয়ার সময় সেগুলো তীব্র গতিতে অনেক সূক্ষ্ম সুতার মতো বের হয়। চিনির এই সূক্ষ্ম সুতার মতো অংশ বাইরের বাতাসের স্পর্শে এসে ঠান্ডা হয়ে যায়।

এরপর তা একটা সরু কাঠি দিয়ে সুন্দর করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সংগ্রহ করা হয়, যা মূলত হাওয়াই মিঠাইয়ে রূপ নেয়। কিন্তু একটি কাঠিতে পেঁচিয়ে হাওয়াই মিঠাই সংগ্রহের পর পরিমাণে দেখতে তা অনেক মনে হলেও সাধারণত এক কাঠিতে মাত্র ৩০ গ্রামের মতো চিনি থাকে। আর বাকি মানে ৭০ ভাগই থাকে হাওয়া বা বাতাস। চিনির পরিমাণ কম ও বাতাস বা হাওয়ার পরিমাণ বেশি হবার করাণেই সুস্বাদু ও সুমিষ্ট এই খাবারের নাম হাওয়াই মিঠাই।

যন্ত্রের সাহায্যে হওয়াই মিঠাই তৈরির প্রক্রিয়া
যন্ত্রের সাহায্যে হওয়াই মিঠাই তৈরির প্রক্রিয়া

দেশি-বিদেশি হওয়াই মিঠাই:

আমাদের দেশের হাওয়াই মিঠাইগুলো সাধারণত সাদা, গোলাপি আর নীল রঙের হয়। কিন্তু সাদা আর গোলাপি রঙের মিঠাইয়ের প্রচলন সবচেয়ে বেশি। তবে অন্য দেশে আরও অনেক রঙের হাওয়াই মিঠাইয়ের প্রচলন রয়েছে। চীন, জাপান আর কোরিয়ায় বিভিন্ন রঙের হাওয়াই মিঠাই দিয়ে নানা রকম খাদ্য শিল্পকর্ম করা হয়। শুধু রঙ নয়, রঙের মতো এর গন্ধ আর স্বাদেও থাকে রকমারি বাহার। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশগুলোতেও পাওয়া যায় স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ম্যাপল, আপেল, আম, গোলাপ ফুল, লেভেন্ডারসহ নানা গন্ধ আর স্বাদের হাওয়াই মিঠাই। তবে বাংলাদেশে এসবের প্রচলন নেই বললেই চলে। এখানে শুধুমাত্র চিনির দ্বারাই হাওয়াই মিঠাই তৈরী করে থাকেন দেশি হওয়াই মিঠাইওয়ালারা।

হাওয়াই মিঠাই এর প্রাপ্তিস্থান:

মিঠাই নেবে গো মিঠাই, হাওয়াই মিঠাই নেবে…,মিষ্টি মিষ্টি রংবেরঙের হাওয়াই মিঠাই…? অনেকটা এভাবেই গ্রামের মেঠো পথ ধরে বা শহরের অলিগলিতে হাঁকডাকিয়ে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে ফেরিওয়ালা বা হকাররা। শহরে বাঁশের কাঠিতে গুঁজে দেওয়া হয় হাওয়াই মিঠাইয়ের তুলতুলে বল। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন, কোথা থেকে সাদা, গোলাপি কিংবা নীল মেঘের ভেলা ভেসে ভেসে আসছে। শহরে মেলায়, স্কুল গেটে বা শপিং মলের বাইরে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা মিঠাই বিক্রি করে থাকে। এমনকি এই ছোট্ট ছোট্ট রঙিন মেঘের টুকরো দেখলে বড়রাও কিনতে বাধ্য হয়।

গ্রামে মেলা বসলে এখনও দেখা মেলে হাওয়াই মিঠাইয়ের। গ্রামে এখনও মাঝ বয়সী বা বৃদ্ধ ফেরিওয়ালারা টিন বা কাঁচের বাক্সে করে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করেন। অনেকের হাতে থাকে লোহার টুকরো, পুরনো জিনিস, ভাঙারি জিনিস দিয়ে দু-চারটা মিঠাই পাওয়া। আবার হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালাদের বিশেষ মৌসুম অর্থাৎ ধান কাটার মৌসুমে দেখা যায়। পিতল বা কাঁসার ঘণ্টার টিং টিং শব্দ তুলে শিশু-কিশোরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা। নানা ধরনের ছড়া ও শ্লোক কেটে মিঠাই বিক্রি করেন বলেই কচি-কাঁচার দল হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

কাঁচের বাক্সে হওয়াই মিঠাই
কাঁচের বাক্সে হওয়াই মিঠাই

হাওয়াই মিঠাই এর দাম:

আগে এক সময় ২৫ পয়সা থেকে ১ টাকায় পাওয়া যেত কয়েক পিছ হওয়াই মিঠাই। বর্তমানে এদেশে ৫ টাকা, ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২০ টাকা দামে পাওয়া যায় হাওয়াই মিঠাই। মূলত এক কেজি চিনি দিয়ে ৮০ থেকে ৯০টি হাওয়াই মিঠাই তৈরি করা হয়। প্রতি মিনিটে ৩টি থেকে ৪টি মিঠাই তৈরি করা হয়ে থাকে।

হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতাদের আর্থিক অবস্থা:

হাওয়াই মিঠাই জনপ্রিয় একটি খাবার। কিন্তু বার্গার, পিৎজা, হটডগ, স্যান্ডুইচসহ নানা ধরনের আধুনিক মুখরোচক বিদেশি খাবারের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী এ খাবারটি হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে এ ব্যবসা আর লাভের মুখ দেখছে না। আগে ৩০০-৪০০ টাকা সারাদিনে আয় হলেও এখন ২০০ টাকা আয় করতে মিঠাইওয়ালারা হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই স্বল্প লাভের কারণে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ অনেক কারখানার কারিগর সংখ্যা কমতে বসেছে। ফলে তারা আর্থিক সংকটে পড়ছেন। ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটির ঐতিহ্য ও জৌলুস ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি। অনেক সময় খাবারটি স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয় না। তাই সরাসরি ঋণ না দিয়ে কীভাবে ঐতিহ্য বজায় রেখে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হাওয়াই মিঠাই তৈরি করা যায় সেটা ভাবা উচিত। তাহলে ক্রেতারা আবার আকৃষ্ট হবেন এ খাবারটির প্রতি।

আরও পড়ুন:

পরিশেষে বলা যায় যে, হওয়াই মিঠাই বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি মুখরোচক খাবার৷ পুরাতন এই ঐতিহ্য বাংলায় আজও বহমান। তবে আধুনিক খাবারের ভিড়ে এই সুমিষ্ট ঐতিহ্যবাহী খাবারটি অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে, এই খাদ্য-শিল্পটিকে বাঁচাতে এখনই প্রয়োজনীর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নয়তো কালের বিবর্তনে হয়তো একসময় এ খাবারটি হারিয়ে যাবে।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।