কেন সূর্য কখনো নিভে না!

গ্রীষ্মকালের কড়া রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে মনে হয় আকাশের বুকে জ্বলছে আগুনের চুলা! কিন্তু, একটা আগুনের চুলার যতটা উত্তপ্ত হবার কথা সূর্য ততটা নয়। সূর্য যে পরিমাণ তাপ ও শক্তি জোগায়, সেটা আগুন জ্বালালে যে পরিমাণ উত্তাপ দরকার তা সূর্যের নেই। তবে সূর্য এত শক্তি, তাপ ও আলো কই থেকে পায়! কেন সূর্য কখনো নিভে না? তো চলুন আমরা আজকে, উনিশ শতকের সনাতন বা ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যাকে বাদ দিয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মাধ্যমে সূর্যের এই রহস্য ভেদ করব। জানব, কেন দেশলাইকাঠির মতো পুড়ে শেষ হয় না সূর্য?
সূর্য বিহীন পৃথিবীর জীবজগতের অস্তিত্ব ভাবা যায় না। সূর্যের ওপর নির্ভর হয়ে আছে পৃথিবীর সকল কার্যক্রম৷ এখনো পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়া চলার মূল কারণটাই সূর্য। সূর্য ছাড়া পৃথিবী হতো— অন্ধকার, নিষ্প্রাণ, বরফঠাণ্ডা—ঠিক এক পাথরের পিণ্ডের মতো।
পৃথিবীর পানি, বায়ু, তাপ, গাছপালা, পশু-পাখি কিংবা যাবতীয় সকল কিছুর মূলেই রয়েছে এই সূর্য। যেটা আমাদের পূর্বসূরীরাও বুঝে গিয়েছে এবং আমরা কিংবা আমাদের পরবর্তীরাও বুঝবে৷ সেই আদিকাল থেকে মানুষ সূর্যকে দেবতা মেনে এসেছে। তবে গত শতাব্দী পর্যন্ত এই সূর্য ঠিক কীভাবে পৃথিবী পরিচালনা করেছে তার অবশ্য সঠিক কোনো ধারণা আমাদের ছিল না।
#আরও পড়ুন: প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীর সমান ভর গিলা ব্ল্যাকহোল এর গল্প!
যাই হোক, আমাদের মূল বিষয়ে যাই যে— যদি ওই বিশাল আগুন ও গ্যাসের গোলাটা যদি তাপ দিয়ে শক্তি উৎপন্ন নাই করে, তবে শক্তি আসে কই থেকে!
আমরা জানি, তারাদের শক্তি তার নিজের ভেতর থেকেই হয়। ঠিক তেমনি সূর্যও নিজের শক্তি নিজের ভেতর থেকেই পায়। এখানে চুলার মতো আগুন না জ্বললেও, সূর্যটাই পুরো বিশাল একটা শক্তিশালী নিউক্লিয়ার ফিউশন চুল্লি।
নিউক্লিয়ার ফিউশন বা ‘কেন্দ্রিণ সংযোজন’ ঘটনাটা আসলে—কোনো পদার্থের দুইটা পরমাণু যখন একত্র হয়ে একটা নতুন ভারি পরমাণুর তৈরি হয়, সেটাই।
ফিউশন থেকে বের হয়ে আসে নিউট্রন, প্রোটন ও গামা রশ্মির বিপুল শক্তি। তবে দুইটা পরমাণুর পাশাপাশি অবস্থান হলেই ফিউশন ঘটে না, ফিউশন ঘটতে দরকার পড়ে সূর্যের কেন্দ্রের এক বিশেষ পরিস্থিতির।
যেহেতু, এই সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি কেলভিন বা প্রায় দেড় কোটি সেলসিয়াস বা তিন কোটি ফারেনহাইট। এই কেলভিন বা ফারেনহাইট একটি কঠিন বিষয় হলেও, এই উদাহরণটা ভাবুন— ফুটন্ত গরম লাভায় আপনি হাত রাখলেন। এবার এই লাভার গরমকে ১২ হাজার দিয়ে গুন করুন। এটাই মূলত সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা।
অন্যদিকে, সূর্যের কেন্দ্রের চাপ আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের চেয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি গুন বেশি। অথচ, ফিউশন ঘটতে হলে সূর্যের কেন্দ্রের এই ভয়াবহ তাপ আর চাপও যথেষ্ট নয়।
#আরও পড়ুন: মশার কাছে আপনাকে সুস্বাদু করে তোলে যে ভাইরাসগুলো!
সাধারণত সূর্যের প্রায় ৯০ ভাগই হাইড্রেজেন দিয়ে গঠিত, এটিই মূলত তার শক্তির উৎস। এছাড়া আমরা জানি, প্রতিটা হাইড্রেজেন পরমাণুতে একটা প্রোটন থাকে, যেখানে প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক। আরও জানি যে, একই রকমের চার্জে বিকর্ষণ ঘটে। তো, এই ধনাত্মক চার্জের প্রোটনগুলো পাশাপাশি আসলে বিকর্ষিত হয়। একে বলা হয় কুলম্ব বিকর্ষণী শক্তি।
তবে এই বিকর্ষণের শক্তিটা বেশ জোরালো, যার দরুণ এদের নিজে থেকে জুড়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু প্রচণ্ড তাপমাত্রায় তাদের রাখা হলে হয়তো জুড়ে যেতে পারবে। অবশ্যই সেই তাপমাত্রা এক হাজার কোটি কেলভিনেরও বেশি হতে হবে।
এখন কথা হলো, আমরা জেনেছি যে সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা মাত্র দেড় কোটি কেলভিন। তাহলে এরা জুড়ে যায় কীভাবে?
এই বিষয়টা ক্লাসিকাল ফিজিক্সের জ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা বেশ জটিল কিংবা অসম্ভব। এইজন্য প্রয়োজন পড়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার।
কোয়ান্টাম জগতে প্রোটন কেবল কণাই নয়, এরা তরঙ্গ বা ঢেউয়ের মতোও আচরণ করে। অর্থাৎ, কোয়ান্টাম জগতে প্রত্যেকটা পরমাণু একই সাথে কণা ও তরঙ্গেরও এক একটা প্যাকেট! এই কণা ও তরঙ্গের প্যাকেট হাইড্রেজেন পাশাপাশি আসলে এদের মধ্যে প্রোটন তরঙ্গের ঢেউ তৈরি হয়, একটা আরেকটার ওপর পড়ে। কিন্তু, এই তরঙ্গ মিলে গেলে প্রোটনেরা জুড়ে যাচ্ছে না। কেননা, একই রকম ধনাত্মক চার্জের কারণে প্রোটনেরা একে অপরকে বিকর্ষণ করে। তবে এইখানে অবশ্য একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে।
হাজার হাজার প্রোটনের ঢেউয়ের ভিড়ে, দুই একটা প্রোটন মাঝে মধ্যে অন্য একটা প্রোটনের কুলম্ব বিকর্ষণী শক্তিকে হারিয়ে দেয়, ফলে মাঝখানে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়। এরপর এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে অন্য একটি প্রোটনের সাথে জুড়ে যায়, কিছুটা চোরের মতো। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে কোয়ান্টাম টানেলিং।
#আরও পড়ুন: হৃদরোগ প্রতিকারে গবেষকরা দেখালো আশার আলো!
প্রোটনের এই ঢুকে যাওয়ার জন্য এক হাজার কোটি কেলভিনের দরকার পড়ে না, এর জন্য মাত্র দেড় কোটিই ঢের। আর যখন দুইটি প্রোটন জুড়ে যায়, তখন সৃষ্টি হয় শক্তির এবং সূর্যের ব্যাটারির চার্জ হয়! তবে এমন একটা প্রোটনের সুড়ঙ্গ করে অন্য আরেকটি প্রোটনের সাথে মিলিত হবার সম্ভবনা খুব নগন্য। ধরা হয়, একটা প্রোটনকে সুড়ঙ্গিত হতে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় কয়েকশ কোটি বছর।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে—তবে এটা কালেভদ্রে হওয়া ঘটনা যদি হয়, তবে প্রতিনিয়ত সূর্যের এত শক্তি আসলে কই থেকে আসে? কেন সূর্য শক্তি হারিয়ে কখনো নিভে যায় না?
প্রিয় পাঠক, সূর্য মাঝারি আকৃতির তারা হলেও সে কিন্তু অতোটাও ছোটো নয়। তার ভেতর থাকে হাজার হাজার প্রোটন। এদের মধ্যে যদি অল্প কিছুও এই বিক্রিয়ায় সফল হয় তবে তা দিয়েই আসতে থাকে পর্যাপ্ত শক্তির জোগান। অন্যদিকে, হাজার কোটি বছর ধরেও এত কম প্রোটন জোড়ে বলে প্রোটনের ভান্ডারও ফুরিয়ে যায় না।
তো পাঠক, এই সূর্যের কেন্দ্রে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুর প্রোটন এইভাবে জুড়ে গিয়ে তৈরি করে হিলিয়াম ও বিপুল শক্তির গামা ফোটন। সাধারণত ফোটন হলো আলোর কণিকা। তবে গামা ফোটন আমাদের দেখা আলোর চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
যাই হোক, তারপর কেন্দ্র হতে এই গামা শক্তি বের হয়ে আসতে থাকে এবং সূর্যের কেন্দ্র হতে নানা স্তর পেরিয়ে বাইরের স্তরে যেতে সময় লাগে প্রায় লক্ষ বছর!
এই দীর্ঘ সময় পথ পাড়ি দিয়ে, তার শক্তি অনেকটাই কমে যায়। তখন ক্ষয় হওয়া বেশিরভাগ শক্তিই বের হয়ে আসে ফোটন হয়ে আলোর আকারে। আর এই আলোই মূলত আমরা যে আলো দেখতে পাই সেটা। তবে সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে মাত্র আট মিনিট।
আমরা এতক্ষণ জানলাম, কোয়ান্টাম টানেলিং এর দ্বারা সূর্যের তাপ, আলো, শক্তি সৃষ্টি হবার গল্প। কিন্তু কথা হলো কেন সূর্য কখনো নিভে না।
#আরও পড়ুন: এবার গাড়ি চলবে সূর্যের আলোতে, বেঁচে যাবে জ্বালানি খরচ!
এটার উত্তরে যাওয়ার আগে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ না করলেই নয়। একটু আগে যে জানলাম, দুটো করে প্রোটন জুড়ে হিলিয়াম উৎপন্ন হচ্ছে। এই হিলিয়ামের একটা পরমাণুতে রয়েছে দুইটা প্রোটন ও দুইটা নিউট্রন।
তো, হিলিয়াম তৈরি করার সময় একটি প্রোটন ভেঙেই হয় একটা করে নিউট্রন, পজিট্রন, আর ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো এবং এই ভাঙনের ঘটনাটা ঘটে অত্যন্ত ধীরে। এইখানে weak force বা দুর্বল বল কাজ করে। মূলত এই দুর্বল বলের কারণে হিলিয়াম সৃষ্ট হওয়ার সময় প্রোটন ভেঙে যাওয়ার কাজটা ঘটে খুব আস্তে। আর এত আস্তে আস্তে ঘটে বলেই সূর্যের জ্বলেপুঁড়ে ফুরানোর বিষয়টাও পিছাচ্ছে কিংবা নিভে যাওয়ার ঘটনাটাও পিছিয়ে যাচ্ছে।
প্রতি সেকেন্ডে সূর্য প্রায় ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি কিলোগ্রাম ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করে। এই শক্তিরই একটা অংশকে আমরা পৃথিবীতে পেয়ে থাকি। যদি সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়া না থাকতো তবে অনেক আগেই সূর্যের এই আলো শেষ হয়ে যেত। একই সাথে কোয়ান্টাম টানেলিং ও দুর্বল বলের মতো দুইটি ধীর প্রক্রিয়া না থাকলেও ফুরিয়ে যেত সূর্যের জ্বালানি। নিভে যেত সূর্য। পৃথিবীটা হতো নিঃসঙ্গ প্রাণহীন এক গ্রহ।
আশা সবাই, কেন সূর্য কখনো নিভে না; এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। তবে মহাবিশ্বের কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। তেমনি আমাদের সূর্যকেও একদিন নিভে যেতে হবে, যখন তার ভেতরের জ্বালানি হাইড্রোজন সব ফুরিয়ে যাবে! কবির ভাষায়- “নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়!” তবে এই প্রক্রিয়ায় আরও সময় লাগবে ৫০০ কোটি বছর। অর্থাৎ সূর্য আরও ৫০০ কোটি বছর নিজে জ্বলে জ্বলে আমাদের সৌরজগতের সকল গ্রহকে আলো দেবে। ৫০০ কোটি বছর পর মহাকালের অতলে হারিয়ে যাবে সকল গ্রহকে নিয়ে।