
বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় [লিখিত] অনেক সময় দেখা যায় পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন লিখতে বলা হয়। প্রতিবেদনের যদিও অনেক প্রকারভেদ রয়েছে, চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে পত্রিকায় প্রকাশ উপযোগী প্রতিবেদনগুলো লিখতে বলা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিসিএস পরীক্ষার বাংলা অংশে চিঠিপত্রের ওপর যে প্রশ্ন হয়, সেটাতেও প্রায়শ সংবাদপত্রের জন্য প্রতিবেদন লিখতে বলা হয়। তাই, চাকরি প্রত্যাশীদের কথা বিবেচনা করে আমাদের আজকের এই পোস্ট। অনুলিপির এই পোস্টে আমরা— চাকরির পরীক্ষায় কীভাবে প্রতিবেদন লিখবেন, কীভাবে লিখলে ভালো মার্কস পাবেন এবং আপনার চাকরির সম্ভাবনা বাড়বে; ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানব! চলুন শুরু করা যাক!
চাকরির পরীক্ষায় কীভাবে প্রতিবেদন লিখবেন?
শুরুতে আমরা সাধারণত কী ধরনের প্রতিবেদন লিখতে বলা হয়, দেখে নিই!
কিছু পুরোনো প্রশ্নের নমুনা:
● নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও এর ফলে তৈরি হওয়া সমস্যা উল্লেখ করে সংবাদপত্রে প্রকাশের উপযোগী একটি প্রতিবেদন রচনা করুন।
● বাল্যবিবাহের কুফল ও বাল্যবিবাহ রোধে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনাসহ দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশের উপযোগী একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করুন।
● বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়নে গণমাধ্যমের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি প্রতিবেদন রচনা করুন।
● ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন’ বিষয়ে প্রকাশের উপযোগী একটি প্রতিবেদন লিখুন।
● ‘মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার’ বিষয়ে প্রকাশের উপযোগী একটি প্রতিবেদন লিখুন।
● বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ ও পরিণাম বর্ণনা প্রসঙ্গে এর প্রতিকারে পাঁচটি করণীয় বিষয় উল্লেখ করে সংবাদপত্রে প্রকাশের উপযোগী একটি প্রতিবেদন রচনা করুন।
● নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক এবং এর ফলে জনস্বাস্থ্যের হুমকি সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশের উপযোগী একটি প্রতিবেদন রচনা করুন।
আরও পড়ুন: যেসব দক্ষতা থাকলে চাকরি পেতে সুবিধা হবে!
প্রতিবেদনের শব্দের সংখ্যা ও লেখার সময়
সংবাদপত্রগুলোতে প্রতিদিন অনেক ধরনের ও অনেকগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এগুলোর ক্ষেত্রে শব্দ সংখ্যার কোনো নির্দিষ্টতা নেই। তবে গড়ে দেখা যায়, ২০০ – ১০০০ শব্দেরই প্রতিবেদনই বেশি প্রকাশ হয়। এছাড়া পত্রিকাগুলো লেখার সাথে ছবিও প্রকাশ করে। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় তো ছবি প্রকাশের উপায় নেই, ছবি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তাও নেই। চাকরির পরীক্ষায় প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে আপনাকে শব্দ সংখ্যা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেও হবে না! যত শব্দের মধ্যে আপনার প্রতিবেদনটা গোছালো হয়, প্রতিবেদনের মূল টপিক ভালোমতো উঠে আসে, তত শব্দই লিখতে পারেন। আর লেখার জন্য সময় আপনার চাকরির পরীক্ষার মোট সময়ের ওপর নির্ভর করে সেট করে নিতে হবে মনে মনে। যেমন- বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে আপনি প্রতিবেদনের জন্য ১৫ – ২০ মিনিট সময় বরাদ্দ করতে পারেন। এর চেয়ে বেশি সময় নিলে, আপনার অন্য প্রশ্নের উত্তর করতে ঝামেলা হতে পারে। আর বিসিএস পরীক্ষায় ২ পৃষ্ঠার বেশি সাইজের প্রতিবেদন না লেখা-ই ভালো!
প্রতিবেদনের ধরন বা প্রকারভেদ
প্রতিবেদন মূলত চার প্রকার-
১. সংবাদ প্রতিবেদন
২. অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
৩. বার্ষিক প্রতিবেদন
৪. বিশেষ প্রতিবেদন।
প্রতিবেদন সাধারণত সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের জন্য তৈরি করা হলেও অনেক সময় কোনো ঘটনা, আয়োজন বা ইভেন্ট নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনেও তৈরি করা হয়।
যিনি প্রতিবেদন লেখেন, তাকে প্রতিবেদক (Reporter) বলা হয়। প্রতিবেদক তার অনুসন্ধান শেষে যেসব তথ্য পান, তা লেখার মাধ্যমে তুলে ধরাই হলো প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনের প্রকারগুলোর সম্পর্কে আরও বিশদ জানা যাক:
সংবাদ প্রতিবেদন
কোনো এলাকার বিশেষ ঘটনা বা দুর্ঘটনার বিবরণ বা খবর পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করা হলে তাকে বলা হয় ‘সংবাদ প্রতিবেদন’।
অনুসন্ধানী বা তদন্ত প্রতিবেদন
কোনো বিষয়ের তথ্য, উপাত্ত, সিদ্ধান্ত, ফলাফল- এর যেকোনো একটি বা একাধিক বিষয়ের যথাযথ অনুসন্ধানের পর যদি এর বিবরণী প্রতিবেদন আকারে তৈরি করে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিভাগে পেশ করা হয়। তাহলে এটি হবে অনুসন্ধানী বা তদন্ত প্রতিবেদন।
বার্ষিক প্রতিবেদন
কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব কিংবা গৃহীত কার্যক্রম তুলে ধরে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হতে পারে। একে বলা যায় বার্ষিক প্রতিবেদন।
বিশেষ প্রতিবেদন
কোনো ঘটনা নিয়মিতভাবে ঘটতে থাকলে এর কারণ বের করে তা রোধের উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, সেটি হলো ‘বিশেষ প্রতিবেদন’। উল্লেখ্য, এ ধরনের প্রতিবেদনগুলোও যেহেতু সংবাদপত্রে কিংবা অনুরূপ প্লাটফর্মে প্রকাশিত হয়, এগুলাও এক ধরনের বিশেষ সংবাদ প্রতিবেদন!
আরও পড়ুন: ওয়ালটন প্লাজায় চাকরির সুযোগ!
কারা কোন ধরনের প্রতিবেদন লেখেন?
সাধারণত, তদন্ত প্রতিবেদন লেখেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা, বার্ষিক প্রতিবেদন লেখেন প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত কর্মকর্তারা এবং পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখেন সাংবাদিকেরা। তবে চাকরির পরীক্ষায় কিংবা বিসিএস পরীক্ষায় তদন্ত প্রতিবেদন, বার্ষিক প্রতিবেদন ও সংবাদ প্রতিবেদন এগুলোর কোনোটিই লিখতে দেওয়া হয় না। মূলত বিশেষ প্রতিবেদনই আসে পরীক্ষার প্রশ্নে। তাই আপনাকে বিশেষ প্রতিবেদন লেখায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
বিশেষ প্রতিবেদনের একটি নমুনা
চাকরির পরীক্ষার প্রতিবেদন লেখার সময় শুরুতে পত্রিকার সম্পাদক বরাবর একটি চিঠি লিখতে হয়। এরপর দ্বিতীয় অংশেই মূল প্রতিবেদনটি লিখতে হয়। সম্পাদক বরাবর লেখা চিঠিটির শুরুতে তারিখ দেবেন এবং নিচের স্বাক্ষর অংশে নিজের নাম ও ঠিকানা উহ্য রেখে সাংকেতিক নাম ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা ব্যবহার করবেন। প্রথম অংশ শেষ হলে একটি শিরোনাম দিয়ে দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ মূল প্রতিবেদন শুরু করবেন।
চাকরির পরীক্ষায় লেখা প্রতিবেদনের একটি নমুনা দেখা যাক:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
সম্পাদক
‘ক’ পত্রিকা
বিষয়: মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপানোর আবেদন।
জনাব,
আপনার বহুল প্রচারিত ‘ক’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি প্রতিবেদন পাঠালাম। ‘মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলে খুশি হব।
নিবেদক
‘জ’ আহমেদ
মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার
‘জ’ আহমেদ
চকবাজার [চট্টগ্রাম], ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২।
বর্তমানে সমাজ ও দেশের জন্য তরুণ প্রজন্মের মাদকাসক্তি একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকের নীল নেশা আজ তার বিশাল থাবা বিস্তার করে চলেছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এই মরণনেশা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করা না গেলে এই হতভাগ্য বাঙালি জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্ন অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশ আজ এক সর্বনাশা মরণনেশার শিকার।
সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক ড্রাগ ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের মাদকের ব্যবসা গড়ে তুলেছে। এসব মাদকের ব্যবহার পদ্ধতিও নানারকমের। ধূমপানের পদ্ধতি, নাকে শোকার পদ্ধতি, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ত্বকের নিচে গ্রহণের পদ্ধতি এবং সরাসরি রক্তপ্রবাহে অনুপ্রবেশ করানোর পদ্ধতি।
গবেষণা থেকে দেখা গেছে, নানান কারণে মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। যেমন- অবাঞ্ছিত আনন্দ লাভেরর বাসনা, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ইচ্ছা, মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রতিকূল পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীদের প্রভাব, পারিবারিক পরিমণ্ডলে মাদকের প্রভাব, কৈশাের ও যৌবনের বেপরােয়া মনােভাব, বেকারত্ব, হতাশা ও আর্থিক অনটন, মানসিক অশান্তি, মাদকের সহজলভ্যতা, নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। তাছাড়া কৌতূহল মেটাতে ও কুসঙ্গে পড়ে যারা একবার বা দুবার মাদক গ্রহণ করেছে, তারা আর এসব থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। নৈরাজ্যের তীব্র যন্ত্রণায় দগ্ধীভূত হয়েও যুবসমাজ বেছে নেয় মাদকাসক্তি এর মাধ্যমে ধীরস্থ আত্মহননের পথ।
মাদক সমস্যা সমাজে মানুষেরই সৃষ্ট শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই মাদক সমস্যা এক বিরাট বাধা। মাদকের অপব্যবহারে ব্যক্তি তাে বটেই, পুরাে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মাদকাসক্তির ফলে জনশক্তি দুর্বল ও নির্জীব হয়ে পড়ছে। মাদকের নিষ্ঠুর ছােবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ এবং অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
মাদকাসক্তির করাল গ্রাস থেকে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানো অতীব জরুরি। এ অবস্থা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে। কঠোর ব্যবস্থার মাধমে বন্ধ করতে হবে মাদকদ্রব্যের চোরাচালান। সুস্থ, সুন্দর, আনন্দ-উচ্ছল সমাজজীবন গড়ে তােলার লক্ষ্যে মাদকদ্রব্য ব্যবহার রােধ করার বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তির করাল গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব দল-মত নির্বিশেষে সবার। অন্যথায় এই জাতির পতন অবশ্যম্ভাবী!
**********
আরও পড়ুন: অভিজ্ঞতা ছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকে ৭০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি সুযোগ!
সংবাদপত্রের চিঠি ও প্রতিবেদনের পার্থক্য
সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য চিঠি লেখার ক্ষেত্রে মূল বিবরণ লিখতে হয় একটি বা দুটি অনুচ্ছেদে। চিঠি সাধারণত ১৫০ শব্দের মধ্যে হতে হয়। আর প্রতিবেদনের মূল বিবরণ লিখতে হয় একাধিক অনুচ্ছেদে। শব্দের সংখ্যা ২০০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত হতে পারে। সংবাদপত্রে চিঠির ক্ষেত্রে মূল বিবরণে কোনো উপশিরোনাম বা সাবহেডিং থাকে না। আর প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে উপশিরোনাম বা সাবহেডিং দিয়ে লিখলে ভালো হয়।
চাকরির পরীক্ষায় প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে সতর্কতা
● অবশ্যই নতুন পৃষ্ঠায় প্রশ্নের উত্তর লেখা শুরু করতে হবে। অর্ধেক লেখা পৃষ্ঠা থেকে শুরু করা যাবে না!
● পরীক্ষার খাতায় নিজের নাম ও ঠিকানা কোনোভাবেই উল্লেখ করা যাবে না। সাংকেতিক নাম ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা লিখতে হবে। অন্যথায় আপনার উত্তরপত্র বাতিল হতে পারে।
● সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠির পরেই প্রতিবেদনের মূল অংশ লেখা শুরু করতে হবে।
● মূল প্রতিবেদনে শিরোনামটি আরেকবার লিখতে হবে।
● প্রতিবেদনে কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান যুক্ত পারলে ভালো হবে।
● পরীক্ষায় খাতায় কোনো খাম আঁকার প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন: ২০ হাজার টাকা বেতনে টিএমএসএস এ চাকরির সুযোগ!
প্রিয় পাঠক, এই ছিল— চাকরির পরীক্ষায় কীভাবে প্রতিবেদন লিখবেন, কীভাবে লিখলে ভালো মার্কস পাবেন এবং আপনার চাকরির সম্ভাবনা বাড়বে; ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত। আশা করি, আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে আসবে। পোস্টটি ভালো লাগলে আপনাদের চাকরি প্রত্যাশী বন্ধুদের সাথেও শেয়ার করতে পারেন। এছাড়া এধরনের পোস্ট আরও পড়তে অনুলিপিতে যুক্ত থাকুন। ধন্যবাদ।