ব্যবসা-বাণিজ্যসংবাদ

দুর্নীতির বরপুত্র উপাধী পাওয়া কর্ণফুলী গ্যাসের এমডিকে শোকজ!

তিনি যতটা না পরিচিত কেজিডিসিএল’র (কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। তার চেয়েও বেশি খ্যাত হয়েছেন দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে। চাকরিসূত্রে তিনি এ উপাধি পেয়েছেন। বড় অর্জন বটে। অবশেষে সেই এম এ মাজেদকে শোকজ করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা থেকে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশের প্রেক্ষিতে এই শোকজ করা হয়।

এম এ মাজেদসহ দুর্নীতিবাজ কয়েকজন কর্মকর্তাকে শোকজ করার কথা পেট্রোবাংলার একজন পদস্থ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি তার নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।

এ বিষয়ে পে্ট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ আলতাফ হোসেন বলেন, তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক করণীয় গ্রহণ করা হয়েছে। আপাতত এর বেশি বলতে পারবো না। কি ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সময় হলেই সবকিছু জানানো হবে।

শোনা যায়, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই ঘুষ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেছেন এমএ মাজেদ। আইনকানুন তার কাছে নস্যি। টাকা ঢাললেই সবকিছু মেলে, রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানাতে পারঙ্গম তিনি। এমন অনেক অভিযোগ আছে যে, কোন কোম্পানির আবেদন কয়েক বছর ধরে ঝুলে রয়েছে। কেউ কেউ কর্ণফুলীতে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলেছেন তবুও সংযোগ পাননি। আবার ঘুষ ঢালায় একদিনেই সংযোগ পাওয়ার নজিরও আছে।

এখানে উল্লেখ্য, মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত শিল্প-৫১৫১) আবেদন করে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। পর দিনেই (২০ ডিসেম্বর) তাদের সংযোগ প্রদান করা হয়। অথচ, সব ধরনের আইন অমান্য করে মাত্র সেই সংযোগটিও প্রদান করা হয়েছে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ক্যাপটিভ পাওয়ারে। মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড ৯০০কিলোওয়ার্ট ক্ষমতার ক্যাপটিভের আবেদনটি বোর্ডে তোলার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু সেই বিধি নিষেধ না মেনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদ মোটা অংকের বিনিময়ে নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: ৪৩ কিলোমিটার সড়ক বানাতে পরামর্শ খাতে লেগেছে ১১০ কোটি!

পেট্রোবাংলা গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছে, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বোর্ড সভার অনুমোদন না নিয়ে নিজেই অনুমোদন করেছেন। যা আইনগতভাবে যথাযথ হয় নি।

একই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জালিয়াতির আরও অসংখ্য তথ্য প্রমান পাওয়া গেছে। তাতে দেখা গেছে কোম্পানিটি মিটার টেম্পারিং করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরির ঘটনা ঘটলেও ধামাচাপা দিয়েছেন এমএ মাজেদ সিন্ডিকেট। কোম্পানিটিতে পরীক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভাগ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মার্কেটিং বিভাগকে দিয়ে ত্রুটিপুর্ণ মিটার পর‌্যবেক্ষণ কমিটি গঠনও রহস্যজনক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার আস্থাভাজনদের রেখেছেন ওই কমিটিতে। যাতে সুবিধামতো রিপোর্ট দিয়ে ঘুষ হাতানো যায়।

এদিকে, কোটি ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বকেয়ার কারণে মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্সের একটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। নিয়ম রয়েছে ৫০ শতাংশ বকেয়া পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা কিস্তিতে আদায়ের শর্তে পুনঃসংযোগ দিতে পারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কিন্তু কোন টাকা আদায় না করেই পুনঃসংযোগ প্রদান করেছেন এই দুর্নীতির বরপুত্র।

অভিনব জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে মেসার্স ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত ৮০৬৫) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সংযোগ প্রদানে। প্রতিষ্ঠানটি সংযোগের জন্য আবেদন জমা দিলে ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর বোর্ডে তুলেছিলেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সেই বোর্ড ঐ সময়ে সংযোগটি অনুমোদন করেন নি। এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় জানার পরও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ডায়মন্ড সিমেন্টকে সংযোগ প্রদান করেছেন এমএ মাজেদ। এতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পরিপত্র অমান্য করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি উল্লেখ করেছে।

বোর্ডের সিদ্ধান্ত জালিয়াতিরও প্রমান মেলে তদন্তে। দেখা গেছে বোর্ডে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে এক রকম, আর কার‌্যপত্রে লেখা হয়েছে ভিন্নভাবে। ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ১৭৫তম বোর্ড সভায় ওঠে মেসার্স সায়মা সামিরা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড (সাদ মুছা গ্রুপ) নতুন সংযোগের আবেদন। পর্ষদের সভার পুর্বেই ওই গ্রাহকের অনুকূলে চাহিদাপত্র ইস্যু করার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কেজিডিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দুর্নীতির রামরাজত্ব তৈরি করেছেন।যা কিছু উদাহরণ সামনে এসেছে  সবই সামান্য। আরও বড় পুকুর চুরির ঘটনা থেকে গেছে অন্তরালে। শুধু সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে জালিয়াতি করে থেমে থাকেনি এই লোক। কোম্পানির সিনিয়র সিলেকশন কমিটির (২০২১ সালের ২১ ও ২২ ডিসেম্বর) সভায় ১৭ পদের বিপরীতে ১৩ জনকে সহকারী ব্যবস্থাপক থেকে উপব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতির সুপারিশ দেয়। তারপর নিজেই সেই পদোন্নতি আটকে রাখেন। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: প্রতিদিন ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে রাজধানীর গণপরিবহন!

আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ কমিটি তদন্তে অসংখ্য অনিয়মের পাশাপাশি কেজিডিসিএল’এ একটি সিন্ডিকেটের প্রমাণ পেয়েছেন। ৩১ পৃষ্ঠার রিপোর্টে কমিটি তার অসংখ্য দুর্নীতির তথ্য তুলে এনেছে। কমিটি বলেছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে পাশ কাটিয়ে নতুন সংযোগ ও পুনঃসংযোগ প্রদান করা হয়েছে। এতে একদিকে নিয়মকানুন লঙ্ঘিত হয়েছে, অপরদিকে কোম্পানি তথা রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

তদন্ত কমিটি সুপারিশে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদ, বিপণন উত্তর ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক (চ.দা) প্রকৌশলী সফিউল আজম খান, বিপণন দক্ষিণ ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান, জিএম (প্রশাসন) ফিরোজ খানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে কমিটি।

এদিকে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদকে একাধিকবার ফোন দিলেও সরকারি নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। এসএমএস দিলেও সাড়া দেন নি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কেজিডিসিএল অফিসে গেলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পাওয়া যায় নি।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।