ধামরাইয়ের রথযাত্রা: বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকউৎসব

লোকউৎসব বাংলার মানুষের প্রাণের সাথে মিশে আছে। সময়ের দাবি অনুযায়ী লোকউৎসবের সৃষ্টি। আদিম স্তরে লোকউৎসবের চল ছিল। লোকউৎসবের সাথে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার, বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হতো। বাংলায় পহেলা বৈশাখ, গাজন উৎসব, অম্বুবাচী, পুণ্যাহ ,পৌষপার্বণ ইত্যাদি লোকউৎসবের প্রচলন রয়েছে। রথযাত্রা তেমনই বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকউৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের আনন্দের উৎসব হলো রথযাত্রা। যা বাংলার মানুষের সাথে মিশে আছে। বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকার ধামরাইয়ের রথযাত্রা উপমহাদেশের বিখ্যাত রথযাত্রা। ৩৫০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে।
রথযাত্রার সূচনা:
রথযাত্রা বাংলার প্রাচীন একটি লোকউৎসব। ভারতের ওড়িষ্যার পুরীতে শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দির রয়েছে। যা পুরী জগন্নাথ মন্দির নামে পরিচিত। বাংলায় জগন্নাথ দেবের পূজার প্রচলন রয়েছে৷ জগন্নাথ দেবের সঙ্গে বড়ভাই বলরাম ও ছোট বোন সুভদ্রাও পূজিত হয়। জগন্নাথ শব্দের অর্থ হলো জগতের নাথ। জগন্নাথ দেব শ্রী কৃষ্ণের একটি রূপ। মূলত জগন্নাথ দেবের পূজার দিন রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। প্রচলিত আছে, যে ব্যক্তি জগন্নাথ দেবের রথের দঁড়ি স্পর্শ করেন তিনি স্বর্গলাভ করেন। তাই রথাযাত্রা উৎসবকে হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র উৎসব বলে মনে করা হয়।
ধামরাইয়ের রথযাত্রা এর সূচনা:
অত্যন্ত প্রাচীন এবং উপমহাদেশ খ্যাত ধামরাইয়ের এই রথযাত্রা উৎসব। ধামরাই রথযাত্রার কাহিনিসূত্র হচ্ছে, রাজা যশোপাল একদিন হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতে ধামরাই এলাকার পাশের গ্রামে যান। রাস্তায় হাতি একটি মাটির ঢিবি দেখে থমকে যায় ও আর চলতে চায় না। রাজা স্থানীয় লোকজনকে ওই মাটির ঢিবি খনন করার জন্য নির্দেশ দেন ও সেখানে একটি মন্দির ও কতগুলো বিগ্রহ পাওয়া যায়। এর মধ্যে শ্রী শ্রী বিষ্ণু দেবের বিগ্রহের মতো শ্রী শ্রী মাধবের বিগ্রহও ছিল। রাজা ভক্তি ভরে বিগ্রহ সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং পরে ধামরাই সদরে ঠাকুরবাড়ি পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রী রাম জীবন রায়কে তিনি ওই মাধব বিগ্রহ নির্মাণের দায়িত্ব দেন।
মূলত তখন থেকে শ্রী মাধবের নামের সঙ্গে রাজা যশোপালের নামটি যুক্ত করায় বিগ্রহের নতুন নাম হয় শ্রী শ্রী যশোমাধব। সেদিন থেকে সেবা পূজার আয়োজন করা হয় আর আজও ধামরাইয়ে শ্রীমাধব-অঙ্গনে পূজা-অর্চনা চলে আসছে। আর শ্রীমাধবকে কেন্দ্র করেই পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠছে ধামরাইয়ের বিখ্যাত শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা ও মেলা। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর উদযাপিত হয় বাংলার ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথের মেলা।
ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী রথ তৈরি:
আগে ছিল বাঁশের রথ পরে তা কাঠের রথ হিসেবে তৈরি করা হয়। ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিঙ্গাইর থানার বিভিন্ন কাঠশিল্পী যৌথভাবে এ নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। তারাই মূলত দীর্ঘ ৬০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি তৈরি করেন। ছয় তলা বিশিষ্ট এ রথটি ত্রিতলবিশিষ্ট ছিল, যার ১ম ও ২য় তলায় চার কোণে চারটি প্রকোষ্ঠ ও তৃতীয় তলায় একটি প্রকোষ্ঠ ছিল।
ধামরাইয়ের রথ অত্যন্ত সুন্দর করে সাজানো হয়। রথ কাঠের সুন্দর কারুকাজ অঙ্কিত হয়। তাছাড়া রঙ-তুলির আঁচড়ে রথের রথ হয়ে ওঠে আরও নান্দনিক। আবার রথটি হিন্দু দেব-দেবীর নানা ছবিতে সজ্জিত করা হয়। যা লৌকিক বাংলার ধারা বহন করে।
১৯ শতকে জমিদাররা রথযাত্রার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ৬০ ফুট দীর্ঘ রথ নির্মাণ করে ছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলায় এই রথটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন আবার নতুন রথ নির্মাণ করা হয়। রথের দায়িত্বভার প্রথম থেকেই বহন করে আসছিল রায় মৌলিক সম্প্রদায়। কিন্তু বর্তমান যশোমাধব পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয় ধামরাই রথযাত্রা।

ধামরাইয়ের রথযাত্রা তিথি:
আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় রথযাত্রা শুরু হয়। কথিত আছে শ্রী শ্রী যশোমাধব যাত্রাবাড়ি মন্দিরে তার শ্বশুরালয়ে যান ও সেই মন্দিরে অবস্থান করেন। এ সময় ভক্তরা রথের দঁড়ি টেনে দুধ-কলা ছিটিয়ে নিয়ে যায়। নয় দিন পর উল্টোরথে চেপে যশোমাধব দেব নিজ মন্দিরে প্রবেশ করে।
ধামরাইয়ের রথযাত্রার শোভাযাত্রা:
শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার পূজা উপলক্ষে রথযাত্রা আয়োজন করা হয়ে থাকে এবং রথ টানা হয়। তবে ধামরাইয়ের রথযাত্রা মূলত শ্রী শ্রী যশোমাধব দেবের উপলক্ষে একই তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। ধারনা করা হয়, সুদীর্ঘ ৩৫০ বছর ধরে এ রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। বাংলা ১০৭৯ বঙ্গাব্দ থেকে ধামরাইয়ের রথযাত্রা ও রথের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথ যাত্রাকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় বর্ণীল এক শোভাযাত্রার। নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সকলে এ রথযাত্রার শোভাযাত্রার অংশ নেয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে ধামরাই এলাকা ও আশেপাশের এলাকার প্রতি ঘরে ঘরে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনের আসা শুরু হয়। যাত্রাবাড়ি মন্দিরে গিয়ে এ শোভাযাত্রা শেষ হয়। তাছাড়া রথের দিন হাজার হাজার ভক্ত সমাগম ঘটে। রথযাত্রার শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকের সমাগম ঘটে তাছাড়া ঐতিহ্যবাহী এই লোকউৎসব দেখতে ও শোভাযাত্রায় অংশ নিতে বিদেশ থেকেও অনেক মানুষ আসে। হাজার হাজার ভক্ত, পূণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর সমাগমে আনন্দমুখর এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। নারীদের উলুধ্বনি ও পুরুষদের শঙ্খধ্বনির সুমিষ্ট শব্দে মুখরিত হয় চারিদিক। এছাড়া ঢোল, কর্তাল, হারমোনিয়াম, ঢাক বাজিয়ে কীর্তন করা হয়। ভক্তরা মূলত পূণ্য লাভের আশায় এ শোভাযাত্রায় অংশ নেয় তবে তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রী শ্রী যশোমাধব দেবের রথের দঁড়ি স্পর্শ করা। নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে প্রতি বছর দিনটিকে পালন করা হয়। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ধরমাইয়ের ঐতিহ্যবাহী রথের মেলা:
বাংলাদেশের লোক উৎসবের অন্যতম একটি উৎসব হচ্ছে ধরমাইয়ের ঐতিহ্যবাহী রথের মেলা। প্রতিবছরই রথযাত্রার সাথে রথের মেলাও অনুষ্ঠিত হয়৷ এ মেলা লোকায়ত মানুষকে প্রাণবন্ত করে, আরও উজ্জীবিত করে। মাসব্যাপী চলতে থাকা এই রথের মেলায় হাজার হাজার মানুষ আসে। ধামরাইয়ের রথযাত্রা শুধুর থেকে বর্তমান সময় অব্দি এ মেলার আয়োজন করা হয়। এ লোকউৎসবকে কেন্দ্র করে আজও এখানে মানুষের ঢল নামে। উপমহাদেশের বিখ্যাত এই রথযাত্রা ও রথের মেলা দেখতে আসার আগ্রহ সবারই থাকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেe সকল মানুষ এ মেলায় অংশ নেয়, আনন্দে গা ভাসায়। মাসব্যাপী আয়োজিত এই রথের মেলার জন্য সারাবছর ধামরাই ও এর আশেপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। কারণ এ মেলাকে কেন্দ্র করেই সারাবছর ধরে তারা প্রস্তুতি নেন। কিছুটা লাভের আশায় এবং আরও একটু আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য তারা মেলায় দোকান সাজিয়ে বসেন। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন মেলা উপলক্ষে। পৌরসভা এলাকা জুড়ে এ মেলা বসে। মাসব্যাপী এ মেলা উপলক্ষে গ্রামীণ ও কুটির শিল্পমেলার আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ কুটির শিল্পকে উজ্জীবিত করার জন্য এ আয়োজন করা হয়। গৃহিণীরা রথের মেলায় আসলে একটু চোখ বুলিয়ে নেন তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কি কি এসেছে।
শিশুরাও এ মেলায় আসতে বেশ আগ্রহী কারণ মেলা উপলক্ষে আনা হয় নাগর দোলা। দোকানীরা সাজিয়ে বসে নানা রকমের খেলনার দোকান। এছাড়া মাটির বিভিন্ন খেলনা যেমন- মাটির পুতুল, মাটির টানা গাড়ি, খেলনাবাটি, মাটির ব্যাংক প্রভৃতি পাওয়া যায়। পাপড় ভাজা, বাদাম ভাজার সমাহার থাকে এ মেলায়। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য আরও অনেক খেলনা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বেলুন। এছাড়া বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিস, বাঁশি, নকশী করা পাখা, তালপাতার পাখা, মাটির গহনা, মাটির জিনিস, কাঠের তৈরী জিনিস প্রভৃতি পাওয়া যায়। এ মেলায় আসে হস্ত শিল্পের বিশাল সম্ভার। তাছাড়া শাড়ি-কাপড়, ওড়না, থ্রি-পিচ, ধুতি, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, গামছা, নকশা করা কাঁথা, ব্যাগ প্রভৃতি পাওয়া যায়। আবার এ মেলায় শঙ্খ, শাঁখা-সিঁদুর, আলতা, বিভিন্ন কসমেটিকস পাওয়া যায় আর বেদিনীরা চুড়ি, কাঁচের চুড়ি আনে বিক্রির জন্য। এ মেলায় কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন তৈজসপত্র পাওয়া যায়। কাঁসারীরা বিভিন্ন কাঁসার জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেন। রসগোল্লা, মতিপালের বিখ্যাত মিষ্টি, অমৃতী আর জিলাপির ঘ্রাণে চারিদিকের পরিবেশ আরও সুমিষ্ট হয়ে ওঠে। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য যেমন খই, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, ছাঁচের মিষ্টির মধ্যে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ প্রভৃতি পাওয়া যায়।

এছাড়া মেলা উপলক্ষে দেশবিখ্যাত সার্কাস দল সার্কাস দেখায় যেমন- মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল কাঠের বৃত্তের মধ্যে ঘোরানো হয়। পুতুল নাচ এ মেলার অন্যতম মূল আকর্ষণ। তাছাড়া বাউলগানের আসর বসে, যা বাংলার মানুষের শেকড়ের গান। মেলা উপলক্ষে বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়। ফলে মেলা হয়ে ওঠে আরও উৎসব মুখর।
আরও পড়ুন: বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের চিত্রকথা!
পরিশেষে বলা যায়, ধামরাইয়ের রথযাত্রা বাংলার মানুষের শেকড়ের লোকউৎসব। অসাম্প্রদায়িক পুরাতন এ লোকউৎসবে মানুষ আসে প্রাণের টানে। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত রথের মেলা বাঙালীর মূল আকর্ষণ। তাই ধামরাইয়ের এই রথযাত্রা ও রথের মেলা বাঙালীর প্রাণের উৎসব হয়ে টিকে থাকুক হাজার বছর।