নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – দেশ, মাটি ও স্বজন হারানোর আখ্যান!

দেশভাগ নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। এই সম্পর্কিত ২-৩ টা বই পড়ার পর দেশভাগ সম্পর্কিত আরও বই খুঁজতে শুরু করলাম। আমার যতো পরিচিত বইপড়ুয়া আছে, তাদের বেশিরভাগ বলল, “সবার আগে ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ বইটি পড়ো”। যথারীতি বই কিনতে গেলাম, বাংলাবাজার। কিন্তু বাংলাবাজারে পাওয়া গেল না। তারপর বহু খুঁজে পেতে দুটি খণ্ডে সমাপ্য বইটির অখণ্ড সংস্করণ নীলক্ষেতে পাওয়া গেল।
নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে বইয়ের কাহিনি সংক্ষেপ
ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হবার কয়েক বছর আগে পূর্ব বঙ্গে বসবাসরত এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্ম হলো এক দেবশিশুর। নাম সোনা। তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে বিশাল কলেবরের এই লেখার। উপন্যাসটির একটা বড়ো অংশ পাগল জ্যাঠামশাই, বড়ো জেঠি, ঈশম, জালালী, মুশকিল আসান পীর, জোটন, সোনার বান্ধবী ফতিমা, ফতিমার বাপ, মালতি, ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য লোকজনসহ অনেকগুলো চরিত্রের সমাহারে দেশভাগের পূর্ববর্তী সময়ে হিন্দু মুসলিমের পাশাপাশি বসবাস, অসাম্প্রদায়িকতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে বদলে যাওয়া জাতির সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব আর তার ফলাফল কেমন ছিল; নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসে তার বর্ণনা করা হয়েছে সুনিপুণ ভাবে।
উপন্যাসের শুরুটায় ছোট্ট সোনার বড়ো হয়ে ওঠা, একই গ্রামে হিন্দু মুসলিমের মিলেমিশে বসবাস করার আবহ বিরাজমান ছিল। সেখান থেকে হঠাৎ করে মুসলীম লীগের দৌরাত্ম্যে হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করার হাহাকারে গিয়ে থেমেছে এই উপাখ্যান। দেশভাগ, দেশভাগের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবোধ, সেকালের মানুষের জীবনবোধ, যাপিত জীবন ফুটে উঠেছে এই মহাকাব্যের মতো উপন্যাসে।
আরও পড়ুন: সৌদামিনী মালো ও আত্মচরিত বই রিভিউ
একসময় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কটা খুব মধুর ছিল। সেখানে হঠাৎ করেই মুসলমানরা বলতে শুরু করল – “মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ”। মুসলমানরা পূর্ব বঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে দেশ শাসনের অধিকার একমাত্র তাদেরই। এতদিন একসঙ্গে থাকার পরেও মুসলমান প্রতিবেশীরা হিন্দুদের বাদ দিয়ে নিজেদের জন্য আলাদা একটি দেশ চেয়েছিল। এগুলো হিন্দু জন মানসে খুব আঘাত হেনেছে। এই থেকেই একটা বেদনা সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দুদের মনে। সেই অভিমানটাও কাজ করেছে দেশত্যাগের পিছনে। শুধু যে দাঙ্গা হয়েছিল বলেই দেশত্যাগ করেছিল হিন্দুরা, তা নয়। দাঙ্গা শুরু হবার আগে অনেকে চলে গেছে দেশ ছেড়ে। দেশত্যাগের মূল কারণ ছিল অভিমান। এই উপন্যাসে বর্ণিত ঠাকুর পরিবারও, এই অভিমান বুকে ধরেই চলে গিয়েছিল।
মুসলমানরা যে দেশভাগ চাইল, তা আসলে অত্যন্ত সঙ্গত ছিল। মুসলমানরা আর্থিক দিক থেকে হিন্দুদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। সাধারণ মুসলমানদের ধারণা ছিল, দেশ থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিলেই তারা জমিদার হয়ে উঠতে পারবে। আদতে কিন্তু তা ঘটেনি। ঠাকুরবাড়ির সব সম্পত্তি একজন মুসলমান জোতদার অধিকার করলেন। ওদের তরমুজ ক্ষেতটা দখল করে নেওয়া হয়েছিল। সেসব লাভ করেছিল অবস্থাসম্পন্ন মুসলিম জোতদার। গোটা পূর্ব বঙ্গেই এরকম ঘটেছে। যাদের টাকা ছিল তারা কমদামে কিনে নিয়েছে, যাদের ক্ষমতা ছিল তারা দখল করেছে, গরিব মানুষের কিছুই হয়নি। তারা যে গরিব, সেই গরিবই থেকে গেছে। এরকম খুঁটিনাটি বিষয়গুলোই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পুরো উপন্যাস জুড়ে।
নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া
অতীন বন্দোপাধ্যায় এর সেরা লেখার একটি ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, এটা জেনে নিয়েই বইটি পড়তে শুরু করেছিলাম। লেখকের লেখনি আমার কাছে খুবই স্বতন্ত্র মনে হয়েছে। ওপার বাংলার লেখকের বই পড়লেই বোঝা যায় যে, ওপারের লেখকের লেখা। ওদের লেখার ধরনে আলাদা একটা ধাঁচ আছে। কিন্তু অতীন বন্দোপাধ্যায় এর লেখনীশৈলী একদমই আলাদা। তাঁর গল্প বলার অসাধারণ ভঙ্গী, চিত্ররূপময় কাব্যিক আকর্ষণীয় ভাষা, প্রকৃতির অপূর্ব রূপায়ন, চরিত্র চিত্রায়ন – সব মিলিয়েই আলাদা ধরনের লেখনশৈলী।
আরও পড়ুন: বোবাকাহিনী বই রিভিউ
প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতার এতো দারুণ বর্ণনা যে, সবকিছু খুব জ্যান্ত মনে হয়। পরে জানতে পেরেছি, এই উপন্যাসের মধ্যে লেখকের সমস্ত স্বত্তা ডুবে আছে। উপন্যাসের বেশিরভাগ চরিত্র, গল্প ঐতিহাসিক সত্য। দেশভাগ নিয়ে অতীন উদ্বাস্তু একটি পরিবার নিয়ে লিখেছেন। এই পরিবারটি আসলে তাঁর নিজেরই পরিবার। তাঁদের ভোগান্তি, হাহাকার, অভিমান- এই সবই যেন বুকের গহীনে গিয়ে আঘাত হানে।
ঈশমের তরমুজ ক্ষেত, শাপলা – শালুকে ভরা খাল, লটকন ফলের মায়াময় জগত ফেলে, পাগল জ্যাঠামশাইকে ফেলে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে সোনার আক্ষেপ যেকোনো কঠিনপ্রাণ মানুষকেও কাঁপিয়ে দেবে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, এত বড়ো একটা উপন্যাস, যেখানে দেশভাগ হয়ে গেল, হিন্দুরা প্রবল কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেলো, কিন্তু কোথাও একটা প্রতিহিংসামূলক বাক্য লেখেননি অতীন। একটা দেশ যাদের কারণে, যাদের ভয়ে ছাড়তে হলো, তাদের বিরুদ্ধে একটি কথাও কোনো চরিত্রের মাধ্যমেও বলানো হয়নি। একজন লেখকের তো এমনই হওয়া উচিৎ। দেশভাগের কঠিন বেদনা নিজের চোখে দেখেছেন বলেই হয়তো পুরো ব্যাপারটা এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করতে পেরেছেন অতীন বন্দোপাধ্যায়।
নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে সিরিজের অন্য বই
চারটি পর্বে বিভক্ত নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে নামের সিরিজটি। প্রথমটি নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, পরের পর্বটি মানুষের ঘরবাড়ি। এরপরে অলৌকিক জলযান। শেষের পর্বটির নাম ঈশ্বরের বাগান। সবগুলো পর্ব পড়লে দেশভাগের বেদনা, এর প্রভাব আরো পরিষ্কার হবে।
লেখকের পরিচয়
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ মার্চ (বাংলা ১৩৩৭ সাল) বাংলাদেশের ঢাকা জেলার রাইনাদি গ্রামে। যৌথ পরিবারে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। সোনারগাঁও স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা, পানাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছিলেন। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেন তিনি। টিচার্স ট্রেনিংয়ে ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।
জীবিকার টানে বিভিন্ন সময়ে একাধিক কাজ করেছেন অতীন। ট্রাক পরিষ্কারের কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতার কাজও করেছেন তিনি। এক জীবনে কাজ করেছেন জাহাজের খালাসি হিসেবেও। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন। বারবার তাঁর লেখায় উঠে এসেছে দেশভাগের যন্ত্রণা। জন্মভূমি, মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, নদী সমুদ্র, হাওয়া – সব কিছুর মধ্যেই ছন্দ আছে। সেটার মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে ছন্দটাই তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। জীবন-যাপনের ছন্দ, সৌন্দর্যবোধের ছন্দ – এগুলো তাঁর মধ্যে ছিলো বলেই তাঁর লেখা ছিলো ছন্দের মতো।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’, ‘ঋতুসংহার’, ‘নগ্ন ঈশ্বর’, ‘নীল তিমি’, ‘জনগণ’, ‘প্রিয়নাথের জবানবন্দী’, ‘ভগ্নদেশ’ অন্যতম। তিনি অসামান্য সাহিত্যকীর্তির জন্য ২০০১ সালে পান সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। এ ছাড়া ১৯৫৮ সালে মানিক স্মৃতি পুরস্কার, বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯ জানুয়ারি কলকাতার পোর্ট ট্রাস্টের কাছে সেন্টিনারি হাসপাতালে ৮৫ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বই পরিচিতি
বই: নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে
লেখক: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল্য: ২৬০ ৳ (নীলক্ষেত প্রিন্ট)
প্রচ্ছদ: পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রকাশনী: করুণা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ১৯৭১
প্রাপ্তিস্থান: ওপারের লেখকদের বইয়ের মূল কপির দাম অনেক বেশি হওয়ায় আমি সবসময়ই নীলক্ষেত প্রিন্ট কিনি। কাগজের মান হয়তো ভালো হয় না, কিন্তু পড়ে মনের তৃষ্ণা মেটানো যায়। এতে দামও কম পড়ে। নীলক্ষেত, বাংলাবাজারে এই কপিগুলো পাওয়া যায়।