প্রথম আলো: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অমর সৃষ্টি!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর নাম স্মরণ করলেই প্রথমে যে কথাটি মনে পড়ে, তা হলো ঐতিহাসিক সময় ট্রিলজির কথা। ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতি আমার অন্যরকম এক দূর্বলতা আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অদ্ভুত চমৎকার কায়দায় ইতিহাসকে তাঁর উপন্যাসে ধারণ করেছেন। কী করে, কোথা থেকে উপন্যাসের কোন অংশে ইতিহাসের বীজ বুনতে হয়, তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি খুব ভালো করে জানতেন, বাঙালি পাঠক নিজের দেশের ইতিহাসকে পুনরাবিষ্কার করে কতটা আনন্দিত ও সমৃদ্ধ হবে। আমি এই লেখায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর প্রথম আলো উপন্যাসটি সহ আরও কিছু লেখা নিয়ে আলোচনা করব।
প্রথম আলো – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রথম আলো বর্ণাঢ্য, বেগবান এক ঐতিহাসিক উপন্যাস। যার মূল নায়ক সময়।
এই বিশাল, বর্ণাঢ্য, বেগবান ঐতিহাসিক উপন্যাসের পটভূমিকায় রয়েছে গত শতাব্দীর শেষ এবং বর্তমান শতাব্দীর শুরুর এক নবজাগরণের সময়কাল। সেই সময়- যখন হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে কিছু মানুষ আবিষ্কার করছে দেশ নামের এক ভাবসত্তাকে। শরীরে অনুভব করছে পরাধীনতার জ্বালা। ব্যক্তিগত মর্মযাতনা,ভালোবাসার অপূর্ণতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে জাতিগত অধঃপতনের গ্লানি। দু-পর্বে বিন্যস্ত এই মহান উপন্যাসের কাহিনির শুরু এক রাজ-অন্তঃপুরে। ঠিক যেন রুপকথার এক রাজবাড়ি, যেখানে কয়েকজন মহারানির সঙ্গে বিহার করছেন এক কঠোর-কোমল মহারাজ, রাজপুত্র-রাজকন্যারা ঘোরাঘুরি করছে কাছাকাছি। অথচ এ-কাহিনি রূপকথা নয়। মাত্র একশো বছর আগেকার কথা এবং এই মহারাজের মুখের ভাষা বাংলা, রাজ্যের নাম- ত্রিপুরা।
আরও পড়ুন: নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – দেশ, মাটি ও স্বজন হারানোর আখ্যান!
সেই পার্বত্য ত্রিপুরা-রাজ্য থেকে ক্রমশ এই কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী বাংলায়,তারপর সমগ্র ভারতে। অসংখ্য জীবন্ত চরিত্র। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য, রাধাকিশোর মাণিক্য, বিলেত-প্রত্যাগত তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ, অকস্মাৎ-দৃষ্ট উল্কার মতন ব্যতিক্রমী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, আধুনিক ভারতের প্রথম বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র, আয়ার্ল্যান্ডের অগ্নিকন্যা মার্গারেট নোবল, বঙ্কিমমচন্দ্র, তিলক, ওকাকুরা, অবনীন্দ্রনাথ, গিরিশ ঘোষ, অর্ধেন্দু মুস্তাফি প্রমুখ বিস্তর চেনা এবং সেই সঙ্গে অনেক দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ। সব ছাপিয়ে, এই উপন্যাসেরও মূল নায়ক – সময়।
তির সামনে ছুটে যাবার আগে কিছুটা পিছিয়ে যায়। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে আগিয়ে যাবার পথে যেকোনো সমাজের মাঝেমাঝে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দিকে পিছু ফিরে দেখা দরকার। আমাদের দেশের অনতি-অতীতের পুনর্দশন ও পুনর্বাচার নিয়েই- ‘প্রথম আলো’।
১৮৮৩-১৯০৭; এই চব্বিশ বছর নিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনি এগিয়েছে। এই চব্বিশ বছরে ভারতবর্ষে তথা বাংলায় এত এত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব জন্মেছেন আর একই সময়ে পৃথিবীকে মাতিয়ে গিয়েছেন, ভাবতেই অবাক লাগে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশ চন্দ্র বসু, মাহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ … কার কথা ছেড়ে কার কথা বলব! এঁদের কারোর সম্পর্কেই বেশি কিছু জানতাম না। এই একটা বই-ই এঁদের চেনাতে যথেষ্ট।
আবার এঁদের নিজের মধ্যে দেখা সাক্ষাত, আলাপচারিতাও ছিল! একদিকে বঙ্কিমবাবু বিশ্বকবির লেখা তেমন পছন্দ করতেন না, অন্যদিকে রবিবাবু বিবেকানন্দকে এড়িয়ে চলতেন। আবার জগদীশ চন্দ্রের সাথে বিশ্বকবির খুব ভাব ছিল! কী অদ্ভুত!
পুরো উপন্যাস জুড়ে বিশ্বকবি ছিলেন স্বদর্পে। কবিবরের সম্পর্কে ভালোমতন কিছুই জানা ছিল না আমার। অনেক অনেক কিছু জেনেছি তাঁর সম্পর্কে। বইয়ের চ্যাপ্টারে চ্যাপ্টারে কবিবরের গান। তিনি নিজে গাইতেনও খুব চমৎকার। বই পড়ে ওঁর নিজের গাওয়া একটা গান শুনতে ইচ্ছে করছিল।
প্রথম খন্ডে কাদম্বরী দেবীর জন্য একটা চাপা কষ্ট ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেছে। এই বই পড়ার আগে উনার সম্পর্কে ধোঁয়াশা-টাইপ কিছু কথা জানতাম। ভেতরের কাহিনি জেনে খুব খারাপ লেগেছে ওঁর জন্য।
স্বামী বিবেকানন্দের কিছু কিছু ব্যাপার খুবই অদ্ভুত লেগেছে। প্রথম জীবনে তিনি সবসময় রামকৃষ্ণর সাথে কালীপূজার বিরুদ্ধে, অবতারবাদের বিরুদ্ধে লজিক্যালি তর্ক করতেন। পরে তিনিই কী করে অবতারবাদ মেনে নিলেন? কালীপূজারি হলেন? বিবেকানন্দ এই ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা দিলেন, সেটায় কেমন ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
জগদীশচন্দ্র বসুর চরিত্রটি এমনভাবে উপন্যাসে এসেছে, প্রথমে আমি ঠিক বুঝতেই পারিনি এটাই আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশ। জগদীশের সম্পর্কে আমেরিকান আইরিশ মার্গারেটের জবানীতে যখন পড়ি, এরকম ত্যাগ শুধু কোনো ভারতীয়দের পক্ষেই সম্ভব। ভারত স্বাধীন না হলে তার এইসব সুসন্তান পৃথিবীতে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে কী করে? – তখন কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠেছিলাম। আমরা আমাদের কৃতি সন্তানদের ত্যাগের ব্যাপারে কতটুকু জানি?
বড়ো লাট কার্জনের কাহিনি পড়ে রাগে গা জ্বলছিল। অখন্ড বাংলাকে ভাঙ্গনের বীজ তো এই সাম্রাজ্যবাদী অহংকারী শোষকটাই বুনেছিল! এর নামে ঢাকা ভার্সিটির হল কেন হয়েছিল? চাটুকারিতা প্রকাশ করার জন্য, না?
যদিও তার কিছু কিছু ভালো দিক ছিল। কিন্তু, সেটা মাথায় তুলে রাখার মতো নয়।
বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আন্দোলনের জায়গা টুকু পড়তে গিয়ে আমি প্রচণ্ডভাবে শিহরিত হয়েছি। ঠিক যেন চোখের সামনে দেখছিলাম, কোনো রাজনৈতিক দলের মুখাপেক্ষী না হয়ে হিন্দু মুসলিম একাত্ম হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন করছে!
আমি যেন ঐতিহাসিক এই উপন্যাসেও থ্রিল খুঁজে পেলাম। এত মোটা একটা বই, স্বাভাবিকভাবেই যখন তখন মনোযোগ সরে যেতে বাধ্য। কিন্তু লেখক আশ্চর্য দক্ষতায় পাঠককে ধরে রেখেছেন উপন্যাসের প্রতি পরতে পরতে। ১১২২ পৃষ্টার এই বিশাল কলেবরের বইটা পড়তে আমার সময় লেগেছে নয় দিন।
বই পরিচিতি
বই: প্রথম আলো
লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মূল্য: ২৫০ ৳ (নীলক্ষেত প্রিন্ট)
প্রকাশনী: আনন্দ প্রকাশনী
প্রাপ্তিস্থান: ওপারের লেখকদের বইয়ের মূল কপির দাম অনেক বেশি হওয়ায় আমি সবসময়ই নীলক্ষেত প্রিন্ট কিনি। কাগজের মান হয়তো ভালো হয় না, কিন্তু পড়ে মনের তৃষ্ণা মেটানো যায়। এতে দামও কম পড়ে। নীলক্ষেত, বাংলাবাজারে এই কপিগুলো পাওয়া যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্যান্য উপন্যাস
প্রথম আলো নামের ঐতিহাসিক উপন্যাসটি পড়ে আমি সুনীলের ভক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমায় সুনীল-জ্বরে ধরেছিল তাঁর মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসগুলো পড়ে।
অথচ কী অদ্ভুত, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসগুলো পড়ার আগে দিনের পর দিন সুনীলের ওই বইগুলো আমার আলমারিতে পড়ে ছিল। ছুঁয়েও দেখিনি। কেন যেন পশ্চিম বাংলার লেখকদের সাহিত্যের প্রতি কোনো টান অনুভব করতাম না। অথচ রিডার্স ব্লকে থাকা আমি পড়ব পড়ি করে ইদের আগেরদিন নিতান্তই অবহেলায় “নানা রসের আটটি উপন্যাস” এর একটা উপন্যাস পড়তে শুরু করেছিলাম, এরপর আর থামতে পারিনি। ওতে ছিল- সুখ অসুখ, সরল সত্য, কেন্দ্রবিন্দু, কবি ও নর্তকী, স্বপ্ন লজ্জাহীন, হীরক দীপ্তি, মুক্তপুরুষ এবং ফুলমণি উপখ্যান।
আরও পড়ুন: বোবাকাহিনী বই রিভিউ
সবগুলোই তীব্র মাত্রায় মনস্তাত্ত্বিক। মানুষের মনের টানাপোড়েন নিয়ে লেখা এই উপন্যাসগুলোর রিভিউ করতে গেলে আমি ঠিকঠাকভাবে এর সাহিত্যগুণ বিচার করতে পারব না। তাই কেবল এটুকু জানালাম, উপন্যাসগুলো ভীষণ ভালো লেগেছিল আমার। একেকটা উপন্যাস পড়ে একেক রকম ঘোরে ডুবে ছিলাম। আমার চিন্তাভাবনাই বদলে দিচ্ছিল।
এরপর পড়েছি বুকের মধ্যে আগুন – এটা স্বদেশীয়াদের নিয়ে লেখা। সুনীলের ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস তো সেরা-আগেই বলেছি। এটা পড়ে খুব আক্ষেপ হয়েছে। আরেকটু বড়ো হলো না কেন বইটা?
এরপর তো একের পর এক চোখ বন্ধ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বইই পড়ে গেছি। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা না বলে পারছি না। নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। সমসাময়িক আরেকজন জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদারের এমন অনেক লেখা আমি পড়েছি, যা শেষ করে আমার মনে হয়েছে, একদম সময় নষ্ট করল বইটা আমার। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখা পড়ে অন্তত এই অনুভূতিটা আপনার হবে না, যে আপনার সময় নষ্ট হলো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর পরিচয়
সুনীলের জন্ম হয়েছিল অখণ্ড ভারতবর্ষের ফরিদপুরে। কিন্তু দেশভাগের পর তাঁকে এই বাংলা ছেড়ে ওই বাংলায় পাড়ি জমাতে হয়েছে। তকমা পেতে হয়েছে রিফিউজি বাঙাল হিসেবে। তাঁর মধ্যে দেশভাগের যন্ত্রণাটা তাই এত প্রখর ছিল। সেই সাথে সুনীল ছিলেন চরিত্র-সৃষ্টিতে কুশলী কারিগর। এই উপন্যাসগুলো লেখার সময় তিনি নিজের প্রতি কোনো মমতা দেখাতেন না। প্রচুর বই সংগ্রহ করে রিসার্চ করতেন। এমনকি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। আর এসব মিলিয়েই সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোসহ তার সমস্ত সৃষ্টিগুলো ছিল অসাধারণ।
নীললোহিতের সেরা নয়টি উপন্যাসে প্রকাশকের লেখা ভূমিকায় জানতে পেরেছি সুনীল সম্পর্কে আশ্চর্য কিছু তথ্য। লেখালেখির ব্যাপারে উনি ছিলেন খুবই সাবধানী। পাঠকচিত্ত জয় করার মন্ত্র জানা ছিল তার। আর ছিল নিজের কল্পনাশক্তির ওপর অগাধ আত্মবিশ্বাস।
সুনীল সবসময় বলতেন, ‘সাহিত্যে নতুন কিছু, মৌলিক কিছু লিখতে না পারলে, লেখার কোনো অর্থ হয় না। আমরা যখন প্রথম লিখতে আসি, তখন নতুন কিছুই করতে চেয়েছিলাম।’
প্রচুর গদ্য লিখলেও নিজেকে আগে তিনি “কবি” ভাবতে পছন্দ করতেন। কবিদের সঙ্গে ছিল তাঁর বেশি সখ্যতা।
সুনীলকে নাকি বাংলা সাহিত্যের “উত্তম কুমার” ডাকা হয়। যাকে বলে “ম্যাটিনি আইডল”। একথা আমি একবাক্যে মেনে নেবো। তীব্র বইয়ের নেশা থাকা সত্ত্বেও অদ্ভুত এক সাইকোলজির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের লেখা আমি পড়তাম না। সেই সাইকোলজির প্রভাব থেকে অত্যন্ত উদার ও মুক্তমনা এই লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-ই আমাকে মুক্ত করেছেন।