ফিচারবিখ্যাত ব্যক্তি

প্রিন্সেস ডায়না: জনগণের রাজকুমারী!

প্রিন্সেস ডায়না : অসাধারণ ফ্যাশন সেন্স ও রাজকীয় প্রথা ভেঙে যিনি জিতে নিয়েছেন কোটি মানুষের প্রাণ।

সূচনা :

রাজকীয় পরিবারে জন্ম না নিয়েও কি রাজকীয় হওয়া যায়? হওয়া যায় সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের রানি? ঠিক রূপকথার রাজকন্যাদের মতোনই মায়াবী নীল চোখ আর সোনালি চুলের স্বর্গীয় সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। বলছি প্রিন্সেস ডায়না সম্পর্কে। তাকে কম বেশি আমরা সকলেই জানি। তিনি তার কমনীয় সৌন্দর্য ও উদারতার জন্য সকলের প্রিয় ছিলেন। তাকে ডাকা হতো “পিপল’স প্রিন্সেস”।

তার জন্ম রাজকীয় কোনো পরিবারে নয়, অর্থ্যাৎ জন্ম থেকেই তিনি রাজকীয় উপাধি লাভ করেননি। প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি রাজকীয় উপাধি লাভ করেন। শুধু রাজবধু হিসেবেই নয় বরং তিনি তার ব্যক্তিত্ব, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, রূপ ও ফ্যাশন সবকিছু মিলিয়েই ছিলেন বিশ্ব তারকা। বলা হয়ে থাকে, রাজকীয় রমণীদের মধ্যে সর্বাধিক ফটোশ্যুট প্রিন্সেস ডায়নারই করা হয়েছে। ১৯৬১ সালের ১লা জুলাই  তিনি জন্মগ্রহণ করেন  ব্রিটেনের অন্যতম অভিজাত স্পেন্সার পরিবারে। ক্ষণজন্মা এই নারীকে ১৯৯৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরা হতো বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান নারী হিসেবে। এমনকি মৃত্যুর এত বছর  পরেও তার খ্যাতি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

ব্রিটিশ রাজবধু’র বাইরে এসে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন নিজের আলাদা একটি পরিচয় ও আলাদা জগত। রাজকুমারী না হয়েও যিনি লাখো মানুষের রাজকুমারী ছিলেন, মানুষ যেমন তাকে গ্রহন করেছিলো দ্রুত সেভাবেই ফ্যাশন আইকন হিসেবেও দ্রুতই তিনি মানুষের মনে জায়গা করে নেন। তাঁর অনেক গাউন, ককটেল ড্রেস, কস্টিউম ইত্যাদী আজও নিলামে আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হয়। তার জীবদ্দশায়ও তিনি তার পোশাক নিলামে তুলে সেই অর্থ বিভিন্ন দাতব্য তহবীলে দান করেছেন।

চলুন দেখে আসা যাক প্রিন্সেস ডায়নার সবচেয়ে আইকনিক স্টাইল মুহুর্ত:

বিয়ের পোশাকে প্রিন্সেস ডায়না:

হাতে সাদা গোলাপ আর টিউলিপের তোড়া। অত্যাশ্চর্য সাদা গাউন ও মাথায় টিয়ারা পরা প্রিন্সেস ডায়ানা ও প্রিন্স চার্লসের বিয়ের দৃশ্য টিভিতে লাইভ দেখেছিল কোটি দর্শক। ডায়ানার সেই সৌন্দর্য আজও মুগ্ধ করে সবাইকে।

এটি ১৯৮১ সালে সেন্ট পলের ক্যাথেড্রালে প্রিন্স অফ ওয়েলস চার্লসের সাথে ডায়ানার বিয়ে হয়েছিলো। প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার রাজকীয় বিয়ের পোশাক তৈরি করেছিলেন ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ডেভিড ও এলিজাবেথ এমানুয়েল। ডায়নার বিয়ের জমকালো এই পোশাক আইভরি সিল্ক টাফিটা ও অ্যান্টিক লেইসে ১০ হাজার মুক্তা এবং ভিনিসীয় স্বর্ণমুদ্রা বসিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এটির নাম ছিল “সহস্রাব্দের পোশাক”। সেই সময়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পোশাক হয়ে ওঠে। এখন অব্ধি পোশাকটি ফ্যাশন দুনিয়াকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বর্তমান বিশ্বে শ্রেষ্ঠ বিয়ের পোশাকের মধ্যে ডায়নার পোশাক এখনো এগিয়ে।

বিয়ের পোশাকে প্রিন্সেস ডায়না
বিয়ের পোশাকে প্রিন্সেস ডায়না

আরও পড়ুন# জামদানি শাড়িতে উষ্ণ সোহিনী, জেনে নিন জামদানির ইতিহাস!

ট্রাভোল্টার পোশাক:

তার সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো গাউনগুলোর মধ্যে ছিল ভিক্টর এডেলস্টাইনের ডিজাইন করা একটি নীল মখমলের গাউন। এই ড্রেসটি পরে ডায়না ১৯৮৫ সালে হোয়াইট হাউজে জন ট্রাভোল্টার সঙ্গে নেচেছিলেন। সেই সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউজে একইসাথে কয়েকটি ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। মুহুর্তেই সেইসব ছবি সমস্ত সংবাদপত্রে ছেপে যায়। এরপরও সেই গাউনটি ডায়না আরো দুইবার পরিধান করেন। এটি ১৯৯৭ সালে এক লাখ ইউরো এবং পরে আবার ২০১৩ সালে ২ লাখ ৪০ হাজার ডলারে বিক্রি হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে ব্যয়বহুল পোশাকগুলির মধ্যে একটি হয়ে ওঠে।

ট্রাভোল্টার পোশাকে প্রিন্সেস ডায়না
ট্রাভোল্টার পোশাকে প্রিন্সেস ডায়না

প্রতিশোধ পোশাক:

এটি প্রিন্সেস ডায়ানার অন্যতম আইকনিক একটি পোশাক। রাজপরিবারে নারীদের পোশাক নিয়ে বিস্তর প্রটোকল ছিল। কিন্তু রাজপরিবারের সদস্য হয়েও তিনি তার সাজপোশাকের মধ্যে তার ভাবমূর্তি সাহসিকতার সাথেই তুলে ধরতেন। তার পোশাকই হয়ে উঠেছিল তার প্রতিবাদ কিংবা স্বাধীনতার প্রতীক। ১৯৯২ সালে সরকারিভাবে প্রিন্সেস ডায়নার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘোষনা হবার পর ১৯৯৪ সালে প্রিন্স চার্লস তার ও ক্যামিলার সম্পর্কের কথা টেলিভিশনে স্বীকার করেন। সেদিন বিকেলেই ডায়না তার বিখ্যাত এই কালো পোশাকটি পরে সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।

পরদিন পত্রিকায় তার ছবি প্রথম পাতায় ছাপা হয় এবং চার্লসের খবর চলে যায় দ্বিতীয় পাতায়। তখনকার সময়ে সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশনেবল প্রিন্সেস ডায়না মৃত্যুর এত বছর পরও সমানভাবে ফ্যাশন দুনিয়ায় সমাদৃত। তার আইকনিক পোশাকটি আজও সবচেয়ে ফ্যাশনেবল গাউন হিসেবে বিবেচিত। ফ্যাশন দুনিয়া হোক কিংবা মানবিকতা সবদিকেই তিনি বিশ্ববাসীর কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। এমনকি তার জনপ্রিয়তা প্রিন্স চার্লসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ধারনা করা হয় এজন্যই চার্লস হীনমন্যতায় ভুগে এবং প্রিন্সেস ডায়নার সঙ্গে তার সম্পর্কে সংকটের ছায়া ঘনিয়ে আসে।

প্রতিশোধ পোশাকে প্রিন্সেস ডায়না
প্রতিশোধ পোশাকে প্রিন্সেস ডায়না

আরও পড়ুন# চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ঐতিহ্যবাহী আমের রাজধানী

প্রিন্স চার্লস ও তার বিবাহ বিচ্ছেদের পর তার ওয়ারড্রোবের ডিজাইনও বদলে যেতে থাকে। তার পোশাকের মধ্যে তার আত্মবিশ্বাস ও স্বতন্ত্রতা ফুটে উঠে। ১৯৯৫ সালে ভেনিস পরিদর্শনকালে তিনি রাজপরিবারের প্রটোকল থেকে মুক্ত হয়ে সুন্দর একটি লাল পোশাক পরেন। তার পোশাকের দৈর্ঘ্য ছোট ছিল ও জুতো ছিল উঁচু। রুবির ও হীরের তৈরী সুন্দর নেকলেস তার এই সাহসী পোশাকের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। আর মুক্তোর কানের দুল তার রাজকন্যার মতোন সাজকে পরিপূর্ণ করেছিল। রাজপরিবারে সাধারণত নারীদের খোলামেলা পোশাক ভালো চোখে দেখা হতো না। এমনকি মেয়েদের হিল জুতোর উচ্চতার ক্ষেত্রেও ছিল বেঁধে দেওয়া নিয়ম। এক্ষেত্রে ডায়ানা সবসময়ই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। সে তার ব্যক্তিত্ব ও পছন্দের সাথে মিলিয়েই পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। মুক্তো ও হীরের গয়না তার বিশেষভাবে পছন্দ ছিল।

ফ্যাশনে অনন্য মাত্রা যোগ:

মৃত্যুর ২৫ বছর পরেও ফ্যাশন দুনিয়ায় প্রাসঙ্গিক প্রিন্সেস অব ওয়েলস। পোশাক থেকে শুরু করে মানবিকতা সবকিছুতেই নিজের রুচির ছাপ রেখেছিলেন। তার পোশাকগুলোকে বলা হয় সবসময়ের সেরা ফ্যাশনেবল পোশাক। তার অধিকাংশ পোশাকের ডিজাইন করেছিলেন ক্যাথেরিন ওয়াকার। নতুন করে ট্রেন্ডে এসেছে ফ্লোরাল প্রিন্ট, প্রিন্সেসের ড্রেসের আদলে ফ্লোরাল প্রিন্টে তৈরী হচ্ছে অসংখ্য পোশাক। ফ্যাশনে ট্রেন্ড তৈরী করতে ডায়ানা একাল হোক কিংবা সেকাল সবসময়ই ছিলেন প্রাসঙ্গিক। তার কিছুটা বব ধাচের ছোট করে ছাঁটা সোনালি চুল সবসময়ই বিখ্যাত। তা হৃদয় কেড়েছেন লাখো ফ্যাশন সচেতন মানুষদের। ৫০ বছরের মোস্ট আইকনিক হেয়ারকাট হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে তার হেয়ারকাট। তার হেয়ারকাট ডায়না কাট হিসেবে বহুল জনপ্রিয়।

বিয়ের আগে ও পরে তার স্টাইলে বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষণীয়। রাজপরিবারে নারীদের পোশাক ছিল বেশ রক্ষণশীল।  তবে ডায়না তার পোশাক নির্বাচনের সময় সবসময় নিজের স্বস্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আত্মবিশ্বাসী ডায়না নিজের পোশাকের মাধ্যমেই বিশ্বকে বার্তা দিতে চেয়েছেন, পোশাকই এক সময় তার কূটনৈতিক অস্ত্রও হয়ে ওঠে। একবার সৌদিআরবে ভ্রমনকালে তিনি সিল্কের একটি পোশাক পরিধান করেছিলেন। সিল্কের পোশাকটি বাজপাখির নকশা দিয়ে সাজানো ছিলো। কেননা  বাজপাখীকে ধরা হয় সৌদিআরবের প্রতীক। এর মাধ্যমেই তিনি পোশাককেই নিজের বার্তা প্রকাশ করার একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এতেই বোঝা যায়  প্রিন্সেস ডায়না কেবল অতুলনীয় সুন্দরীই নন বুদ্ধিমতী ও ফ্যাশন সচেতনও ছিলেন। তিনি তার ফ্যাশন ও স্টাইলে সমসাময়িক সবার থেকে এগিয়ে ছিলেন। তিনি রাজকীয় নিয়ম ভাঙতেও নিজের পোশাককে ব্যবহার করেছেন।

রাজপরিবারে সাধারন জনগণের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় ও হাত মেলানোর সময় গ্লাভস ব্যবহারের বিষয়টি পছন্দ না হওয়ায় ডায়ানা গ্লাভস পরার সিদ্ধান্তটি বাদ দিয়েছিলেন। তার উদার ও কমনীয় আচরণের জন্য জনসাধারণের কাছে তিনি। তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। রাজপরিবারের যেকোনো গল্পে তার নাম সবার আগে থাকবেই। তার নিয়ে তখন যতটা না আলোচনা হতো এখন চর্চা হয় তারচেয়েও বেশি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তাঁর পোশাক ও স্টাইল জনপ্রিয়তায় শীর্ষে ছিল । বাটন ডাউন অক্সফোর্ড শার্ট, পুলওভার, শিফট ড্রেস ও মুক্তার গয়না যেকোনো সময় ও যেকোনো জায়গায় পরার জন্য উপযুক্ত, প্রমাণ করেছিলেন তিনি। তার মুক্তোর গয়না, হ্যাট, ফ্লোরাল প্রিন্ট, চেকস্যুট, গাউন, নানা রঙের পায়ের বুট, সাদা শার্ট, স্পোর্টস জ্যাকেট, ডানগারিস, হাই ওয়েস্টেড ওয়াইড লেগ প্যান্ট, ঢোলা সোয়েটার, হাঁটু পর্যন্ত ড্রেস, সোজা কাট, ফ্লোয়ি কাটের পোশাক ইত্যাদি যুগের পর যুগ অনুপ্রাণিত করেছে বিশ্ববাসীকে।

১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট গাড়ি দুর্ঘটনায় এই অমীমাংসিত সৌন্দর্যের মৃত্যু ঘটে।

 

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।