বজ্রপাতের আঘাতে কেন মানুষ মারা যায়?
বর্ষাকাল আসলেই বজ্রপাত নিয়ে মানুষের মাঝে একটা আতংক শুরু হয়। এই বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর প্রায় ২০০ জনের অধিক মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারান। গত ২০২১ সাল অবধি বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮২। চলতি বছরেও অনেক মানুষ বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যু বরণ করেছেন। এই সংখ্যা নেহাত কম নয়। বজ্রপাতে প্রাণহানির বাৎসরিক হিসাবে (প্রতি বর্গ কি.মি.) বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। তাই বজ্রপাতকে ছোটো করে দেখার বিশেষ সুযোগ নেই। তো চলুন, আজকে আমরা জানব বজ্রপাত নিয়ে বিশেষ কিছু তথ্য। বজ্রপাত কী? বজ্রপাত কেন হয়? বজ্রপাতের আঘাতে কেন মানুষ মারা যায়? ইত্যাদি।
বজ্রপাত কী এবং বজ্রপাত কেন হয়?
বজ্রপাত শব্দটা মাথায় আসলেই প্রচণ্ড আকাশের ডাক ও সাথে বিদ্যু ঝলকানি চোখে ভাসে। গ্রাম বাংলায় এই নিয়ে বেশ কিছু কুসংস্কার রয়েছে। একসময় কিংবা এখনো অনেকে মনে করেন যে, বজ্রপাত মানে দেবতাদের যুদ্ধের ফল কিংবা শয়তানের প্রতি ইশ্বরের আগুনের ঘোলা ছুঁড়ে মারা। কিন্তু, এইগুলো সম্পূর্ণই মানুষের মনগড়া কিছু গল্প। কিন্তু, আমরা বিজ্ঞানের কল্যাণে জানি, বাসার বিদ্যুৎ কিংবা আকাশের বিদ্যুৎ দুটোই এক, তফাত কেবল মাত্রা ও নিয়ন্ত্রণের।
#আরও পড়ুন: কেন সূর্য কখনো নিভে না!
সাধারণত মেঘের মধ্যে যখন অতি শীতল ও শুষ্ক বায়ু এবং অপেক্ষাকৃত গরম ও জলীয়বাষ্প ভর্তি বায়ু মেশে, তখন দেখা যায় বরফের কুচি ও গ্রাউপল বা নরম শিলার সৃষ্টি ঘটে। এছাড়া যেকোনো দুটি বস্তু যেমন ধরেন সিল্ক ও প্লাস্টিক, এদের ঘর্ষণে স্থির বিদ্যুৎ সৃষ্টি হতে পারে। তো ধারনা করা হয়, এমন করেই বায়ুর ধাক্কায় বরফের কুচি ও গ্রাউপলের ঘষর্ণে বরফের কুচিতে ধনাত্মক এবং গ্রাউপলে ঋণাত্মক চার্জ তৈরি হয়। আর সাধারণ মেঘের ওপরের দিকটায় ধনাত্মক ও নিচের দিকটায় ধনাত্মক চার্জ জমা হতে থাকে।
তো মূলত, বিদ্যুতের নিজস্ব স্বভাব হচ্ছে উচ্চ বিভব থেকে নিম্ন বিভব বা চার্জ চালানো। কিন্তু, বায়ু বিদ্যুতের জন্য খুব একটা ভালো পরিবাহী নয়, তাই দেখা যায় খুব সহজে এর আদান-প্রদান ঘটে না। অন্যদিকে, বিভবের চাপ বৃদ্ধি পেতে পেতে তা প্রতি সেন্টিমিটারে প্রায় ৩০ হাজার ভোল্ট কিংবা এরও বেশি হলে, এক সময় এই বিভবের চাপ বাতাসের অপরিবাহিতায় কিংবা ইন্সুলেটিং প্রপার্টিতে ফাটল ধরায়। আর ওই ফাটলের বরারব বিশাল পরিমাণের চার্জ এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছোটাছুটি করে। চার্জের এমন ছুটে যাওয়াকে সাধারণত আমরা বলি বিদ্যুতের চমক।
ওইদিকে শব্দের চেয়ে আলোর গতি অনেক গুণ বেশি (প্রায় আট লক্ষ বিরাশি হাজার) হওয়ায় বজ্রপাতের আলো আগে দেখা যায় আর এর কয়েক সেকেন্ড পর শব্দ শুনি। আর এর ফলে সৃষ্ট হওয়া তাপের তাপমাত্রার পরিমাণ হয় প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে সৃর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তো এই প্রচণ্ড তাপ বাতাসকে খুব দ্রুত প্রসারিত করে। আর আমরা তো জানি, বাতাসের কম্পনই মূলত শব্দ। এই প্রসারণ থেকে সৃষ্টি হওয়া কম্পনকে আমরা বজ্রের গর্জন বা মেঘের গর্জন বলি। এই রকম চার্জের ছুটে যাওয়া একই মেঘের মাঝে কিংবা পাশের মেঘের সাথেও হতে পারে। কিন্তু, আমরা ওই বিষয়ে যাচ্ছি না। কারণ আমরা জানব মাটিতে আঘাত করা বজ্র নিয়ে। যেটা মানুষ বা প্রাণীর মৃত্যুর কারণ।
#আরও পড়ুন: পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা গেল কে২ ধূমকেতু!
বজ্রপাতের আঘাতে কেন মানুষ মারা যায়?
তো মাথার ওপর মেঘে যখন চার্জ জমা হতে থাকে, তখন মাটিতে আবেশ বা ইনডাকশন প্রক্রিয়ায় তার উল্টো বা বিপরীত চার্জ জমা হতে থাকে। আর যদি জায়গাটা উঁচু কোনো গাছ কিংবা ভবন হয়, তখন সেখানের চূড়াতে এই চার্জ জমার পরিমাণ খুবই বেশি হয়। যেহেতু উচ্চতার কারণে সেটি মাটির তুলনায় মেঘের কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। এই গাছ কিংবা ভবন থেকে মেঘের দিকে এবং মেঘ থেকেও নিচের দিকে চার্জ প্রবাহিত হয়। যদি এই দুটো চার্জের প্রবাহ একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে তবে রোধ বা রেজিস্ট্যান্স খুব তাড়াতাড়ি কমে যায় এবং এই রাস্তা ধরে মেঘের চার্জ নিচের দিকে ছুটে আসে। যার ফলেই মূলত ঘটে বজ্রপাত।
তো বিষয়টা হলো যখন মাটির কাছে থাকে তখন বজ্রাঘাতে মেঘ থেকে ঋনাত্মক চার্জ নামে ৯৫%, আর যখন দূরে থাকে তখন ধনাত্মক চার্জের বজ্রাঘাত ঘটে মাত্র ৫%। কিন্তু, দূরুত্ব বেশি অতিক্রম করতে অনেক বেশি চার্জ লাগে৷ এইজন্য ঋনাত্মক চার্জের বজ্রাঘাতের তুলনায় ধনাত্মক চার্জের বজ্রাঘাত খুবই ভয়ংকর।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে বিল্ডিং তো মেঘের কাছাকাছি থাকে, তাহলে কেন বিল্ডিংয়ের ক্ষতি ঘটে কম?
প্রিয় পাঠক, আমরা জানি বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ধাতব তারগুলোর সংযোগ সাধারণত মাটিতে দেওয়া হয়। এতে করে বিদ্যুৎ মাটিতে চলে যায়, যাকে আমরা আর্থিং বলেই চিনি। কিন্তু এর প্রকৃত নাম লাইটনিং অ্যারেস্টর।
তো, এই বাসার বিদ্যুতের শক্তি মাত্রা ২৪০ ভোল্ট মাত্র, কিন্তু এই ভোল্টেই অনেক মানুষ মারা যায়। অন্যদিকে, বজ্রপাতের বিদ্যুতের শক্তি প্রায় ৩০ কোটি ভোল্ট, তো এই বিদ্যুৎ সরাসরি আঘাত করলে মানুষ মারা যাবে স্বাভবিক।
পরিসংখ্যান হতে জানা যায়, বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে সরাসরি বজ্রপাতে মারা যায় ৩-৫%, গ্রাউন্ড কারেন্টে মারা যায় ৪০-৫০% এবং সাইড ফ্ল্যাশ লাইটনিংয়ে মারা যায় ২০-৩০%। এছাড়াও বাকি মৃত্যু ঘটে পরিবাহীর মাধ্যমে বা আহত হয়ে ভোগার পরে৷
#আরও পড়ুন: প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীর সমান ভর গিলা ব্ল্যাকহোল এর গল্প!
তো, এখন বিষয় হলো সাইড ফ্ল্যাশ লাইটনিং আসলে কী?
ধরুন প্রথমে বজ্রপাতটা কোনো গাছে বা উচ্চ কোনো স্থাপনায় ঘটলো কিন্তু তার সঠিক বজ্রনিরোধী ব্যবস্থা নেই৷ তো সেই বজ্রপাত গাছ বা স্থাপনা ভেদ করে আড়াআড়ি ভাবে বা পাশে থাকা মানুষকে আঘাত করে। এই বিষয়টাই হলো সাইড ফ্ল্যাশ লাইটনিং বা পার্শ্বীয় ঝলকানি। যদিও এই বজ্রপাতে মৃত্যু কম ঘটে তবে তা একদম উড়িয়ে দেওয়ার মতোও না। এছাড়া অনেকসময় ভেজা মাটিতে বিদ্যুতায়িত হয়েও মানুষের মৃত্যু ঘটে।
দেখা যায়, অনেক এলাকায় বজ্রপাত বেশি ঘটে, আবার অনেক এলাকায় কম। এছাড়া মৌসুম ভেদেও এর ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। বিশেষ্প করে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে হাওর অঞ্চলে। আবার বর্ষাকালে বজ্রপাত বেশি ঘটে— সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। এছাড়াও অক্টোবর-নভেম্বর মাসগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে বেশি বজ্রপাত ঘটে। আর শীত মৌসুমে সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালীতে বজ্রপাত ঘটে। কিন্তু, বর্ষাকালেই মূলত বেশি বজ্রাঘাত হয়। যার জন্য বর্ষাকালেই মানুষ বেশি আতংকে থাকে।
অধিকাংশ বজ্রপাত ঘটে মার্চ থেকে মে মাসে। আর এই সময়টায় হাওড় এলাকার কৃষকরা বেশি হুমকিতে পড়েন৷ কেন না, হাওড় এলাকার খেতে উঁচু গাছপালা নেই। ফলে উঁচু জায়গা ওই মাঠই। আর আমরা আগেই জেনেছি, উঁচুতেই মূলত বজ্রপাত ঘটে। তাই দেখা যায়, প্রতি বছর মাঠে কাজ করতে যাওয়া কৃষকেরা বজ্রপাতের শিকার হয়।
এই বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় আসলে কী?
যদিও বাংলাদেশ সরকার বেশ বড়ো প্রকল্প নিয়েছের এই বজ্রপাতের বিরুদ্ধে। তবে, বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক বলেন, বেশ কিছু নিয়ম মানলে এই বজ্রাঘাত থেকে বাঁচা যায়। যেমন:
১। জনগনের সচেতনতা বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে। মেঘের গর্জন শুনলেই নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। পানি কিংবা গাছপালা নেই এমন জায়গায় অবস্থান করা যাবে না।
২। তবে তালগাছ বা কোন উঁচু গাছ, বাঁশঝাড় নিরাপদ স্থান বা আশ্রয় নয়। কেন না, সাইড ফ্ল্যাশ বা মাটি বিদ্যুতায়িত হয়েও মৃত্যু ঘটে। তাই এমন স্থানে আশ্রয় নিতে হবে যেখানে সাইড ফ্ল্যাশ হবার সম্ভাবনা নেই।
৩| যদি বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা এবং শব্দ শোনার মধ্যে ৩০ সেকেন্ড বা তার কম সময় থাকে তাহলে অবশ্যই নিরাপদ আশ্রয়ে (পানিরোধী ছাদযুক্ত, শুকনা ফ্লোর বিশিষ্ট এবং বজ্রনিরোধক স্থাপনা) যেতে হবে। বজ্রপাত কমার পর আরও ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।
৪| বজ্রপাতের সময় পুকুরে কিংবা পানিবাহিত কোনো কাজ করা যাবে না।
৫। ঘরের মধ্যেও সিমেন্টের মেঝেতে শোয়া বা দেয়ালে হেলান দেওয়া এড়িয়ে যেতে হবে।
বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে এই নিয়মগুলো মেনে চললে অনেকটা মৃত্যুর হার কমবে। নিজে ভালো থাকুন ও অন্যকে ভালো রাখুন। ধন্যবাদ।