ফিচারলোকসংস্কৃতি

বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের চিত্রকথা!

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সৃজনশীলতার চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে তাদের নিজস্ব শিল্পকর্মের মাধ্যমে। আবার মানুষ তার প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছে বিভিন্ন চিত্রশিল্পে। প্রাচীনকালে রঙ-তুলির ব্যবহার ছিল না, মানুষ তখন গাছের পাতা, ফলের বিঁচি, কয়লা প্রভৃতি দিয়ে ছবি অঙ্কন করে তা ফুটিয়ে তুলতো। পরবর্তীতে তারা বাড়ির দেওয়াল, মসজিদ, মন্দির, রাজপ্রাসাদের দেওয়াল প্রভৃতি জায়গায় সুন্দর চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তুলতো৷ এছাড়া তারা কাপড়ে চিত্রকর্ম অঙ্কন করতো, যেটি পটচিত্র নামে পরিচিত। পটচিত্র লোকশিল্পের একটি অংশ। সুপ্রাচীনকাল থেকে পটচিত্র ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। যা বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহাসিক নিদর্শন। পটে আঁকা ছবি সৃজনশীল ও রুচিশীল প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।

পটচিত্র:

পট শব্দটি সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দ থেকে এসেছে। পট শব্দের অর্থ কাপড়। সুতরাং বলা যায়, পটচিত্র হলো কাপড়ের উপরে আঁকা চিত্রকর্ম। শুধু কাপড় নয়, পাত্রের উপর আঁকা চিত্রকর্মকেও পটচিত্র বলা যায়। তবে পটচিত্র বলতে মূলত কাগজ বা কাপড়ের উপর ছবি আঁকাকেই বোঝায়। 

পটুয়া:

যারা পটচিত্র অঙ্কন করেন তাদেরকে বলা হয় পটুয়া। অর্থাৎ যারা পট লেখে। সাধারণত এরা পট আঁকা বলে না বলে পট লেখা বলে থাকে। আর তারাই পটুয়া নামে পরিচিত। পট শব্দের সাথে ‘উয়া’ প্রত্যয় যােগ করে পটুয়া কথাটি এসেছে। আবার অঞ্চলভেদে পটুয়ারা পউটা, পউট্যা, পােটো নামে পরিচিত। পটুয়ারা চিত্রকর বলেও পরিচিত। 

পটচিত্রের ইতিহাস:

পটচিত্র ঐতিহ্যের দাবিদার এবং ইতিহাস সমৃদ্ধ। গ্রামীণ বাংলায় পটুয়ারা মূলত পটচিত্র এঁকে এবং পট গানের মাধ্যমে জীবিকা সংগ্রহ করতেন। 

কথিত আছে পটুয়ারা হলেন বিশ্বকর্মার বংশধর। মহাদেব শিবকে না জানিয়ে তাঁর চিত্র অঙ্কন করেছিল পটুয়াদের আদি পুরুষ এবং তা গোপন করার প্রচেষ্টা করলে মহাদেব তা দেখে ফেলেন। তুলি এঁটো করার দায়ে মহাদেব তাদের অভিশাপ দেন যার ফলস্বরূপ তারা জাতে পতিত হয় ও মুসলমানের রীত ও হিন্দু ধর্ম করতে আদিষ্ট হয়৷ এজন্যই চিত্রকর পটুয়ারা মুসলিমদের রীতি অনুযায়ী নামাজ আদায় করেন ও হিন্দুদের মতো দেব-দেবীর পট আঁকে ও কীর্তন গানের মাধ্যমে দেব-দেবীর মহিমা তুলে ধরেন। 

আবার ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণের দশম অধ্যায়ে পটুয়া বা চিত্রকর জাতির উদ্ভব নিয়ে আরও একটি অনুরূপ কাহিনী পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণবেশী বিশ্বকর্মার ঔরসে গোপকন্যাবেশী অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে নয়টি পুত্র জন্মগ্রহণ করে। বিশ্বকর্মার এই নয়পুত্র হলেন- মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকার, কুন্দিবক (তন্তুবায়), কুম্ভকার, কাংশ্যকার, সূত্রধর, চিত্রকার ও স্বর্ণকার। এই নয়পুত্রের মধ্যে চিত্রকার বা চিত্রকর-ই হলেন পটুয়াদের আদিপুরুষ। পৌরাণিক মতে, ব্রাহ্মণ নির্দিষ্ট চিত্রপদ্ধতি অনুসরণ করে ও এই স্বতন্ত্র চিত্ররীতি অবলম্বন করার কারণে ব্রহ্মশাপে তারা জাতিতে পতিত হয়। সেই থেকেই তারা না হিন্দু না মুসলমান হয়ে এক কষ্টকর প্রান্তিক জীবন-যাপন শুরু করে। আবার এরা নামাজ আদায় করলেও এদের নাম হিন্দুদের মতোই। পটুয়াদের সঙ্গে মুসলমান রীতিনীতির অনেক মিল পাওয়া যায় তবুও এদের মধ্যে হিন্দু আচার, রীতি-নীতির চল বেশি তাছাড়া হিন্দু অনুসারীরও অভাব নেই। তবে কালীঘাটের পটুয়া ছিলেন বৃত্তিত্যাগী, তাদের অধিকাংশই সূত্রধর সম্প্রদায়ভুক্ত।

পটের প্রকারভেদ:

পট প্রধানত দুই প্রকার-

একটি হলো জড়ানো দীর্ঘ পট। এটি ১৫-৩০ ফুট লম্বা ও ২-৩ ফুট চওড়া হয়। দীর্ঘ পটে পটচিত্র অঙ্কন করা হয় এবং লাঠি দিয়ে জড়ানো থাকে। চিত্রের উপর ভিত্তি করে ছড়া, কবিতা, গান করে কাহিনীর বর্ণনা করা হয়। 

আর একটি হলো, ক্ষুদ্রাকার চৌকা পট। এই পট ছোট আকারের হয়ে থাকে। কালীঘাটের একক পটগুলি হল চৌকা পট।

এছাড়া বিষয়, সমসাময়িক অবস্থা, ধর্মীয় অনুভূতি প্রভৃতি ভেদে পটচিত্রকে বিভিন্ন ভাগে  করা যায় যেমন- 

  • চালচিত্র– এটি দুর্গাচালা বা দেবীচাল নামেও পরিচিত। সাবেকি দুর্গা প্রতিমার উপরিভাগে অঙ্কিত দেবদেবীর কাহিনিমূলক পটচিত্র এটি, যা প্রধানত অর্ধগোলাকৃতির হয়ে থাকে। এর মূল বিষয়বস্তু হলো হরপার্বতী, দশাবতার, কৈলাশ, নন্দীভৃঙ্গী, মহিষাসুর বধ ইত্যাদি। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজ-রাজেশ্বরী দুর্গার চালচিত্র অন্যন্য ও বিখ্যাত।
  • সরা পট– সরার উপর এটি আঁকা হয়। বিশেষ করে লক্ষ্মী, দুর্গা, অন্নপূর্ণা, কালী, শীতলা, মনসা প্রভৃতি দেবীর সরা বিখ্যাত। সরার উৎপত্তি মূলত বাংলাদেশের ঢাকা , ফরিদপুর, বরিশাল জেলায়। সরা তৈরি করেন কুম্ভকার ,পাল সম্প্রদায়। 
  • যম পট– ধর্মরাজ যম, পুণ্যবান, স্বর্গীয় সুখ, নরক যন্ত্রণা, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি বিষয় যমপটে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই পটটি মানুষকে সচেতন করে যা মূলত নীতিশিক্ষা দেয়।
  • চক্ষুষ্মান পট– এটি জাদুপট হিসেবেও পরিচিত। সাঁওতালী উপকথার ভিত্তিতে সাঁওতালদের জন্মকথা পটের ছবিতে অঙ্কন করে বর্ণনা করা হয়। মৃত ব্যক্তির ছবি পটে আঁকা হয় যাতে চোখের মনি থাকে না। তাই এর আরেক নাম চক্ষুদান পট।
  • গাজীর পট– মুসলিম ধর্মযোদ্ধা গাজী ওনপীরদের বীরত্ব ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ বিবৃত হয় গাজীর পটে। বন বিবি, দক্ষিণ রায়ের ছবি গাজীর পটে ফুটে ওঠে। এটি মূলত মুসলিম পট। গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী এতে অঙ্কিত হয়। এছাড়াও মানিকপীর, মাদারপীর, সত্যপীর, কালুফকির, বনবিবি প্রভৃতি সম্পর্কে চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
  • লৌকিক পট– বিষয়বৈচিত্রের কারণে এটি জনপ্রিয়। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, কৃষ্ণলীলা, মনসামঙ্গল সহ অন্যান্য মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যজীবন থেকে লৌকিক পটে বিষয় আহরণ করে চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।
  • কালীঘাটের পট– কলকাতার কালীঘাটকে কেন্দ্র করেই চিত্রিত হয় এ পট। চৌকা পটগুলো মূলত কালীঘাটের পট। 

আবার সাধারণভাবে পটকে ছয়ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা: 

  • বিষয় নিরপেক্ষ পট। 
  • ধর্মীয় পট।
  • সামাজিক পট।
  • পরিবেশগত পট।
  • রাজনৈতিক পট।
  • ঐতিহাসিক পট।

পটচিত্র অঙ্কনের উপকরণ:

পটচিত্র অঙ্কনের উপকরণ সাধারণত প্রকৃতিনির্ভর। অর্থাৎ, প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করেই পটচিত্রের উপকরণ সংগ্রহ করা হয় এবং তা দিয়ে চিত্রাঙ্কন করা হয়। বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত পটুয়াদের জ্ঞান এবং প্রকৃতি থেকে আহরিত নানা রঙ এবং উপকরণ দিয়ে পটচিত্র আঁকা হয়ে থাকে। যেমন-

  • পটচিত্রের জমিন তৈরি করার জন্য মূলত কাপড়ের ওপর কাদামাটি, গোবর এবং গাছের আঠা দিয়ে প্রলেপ করা হয়।
  • তুলি হিসেবে লাঠি বা কঞ্চির ডগায় পশুর লোম বা পাখির পালক লাগিয়ে ব্যবহার করা হয়। আবার বাচ্চা ছাগলের ঘাড়ের লোম বা পেটের লোম দিয়ে তুলি তৈরী হয়। কাঠ বেড়ালির লোম বা বেজির লেজের চুল ব্যবহৃত হয় সরু তুলির জন্য।
  • ইঁটের গুঁড়া, লাল সিঁদুর, আলতা, পাকা তেলা কচু, সজনে গাছের পাতা বেঁটে দিয়ে লাল রঙ তৈরী করা হয়। আবার পোড়ামাটি থেকে আসে লালচে রঙ।
  • সাদা খড়িমাটি ও খড়িমাটির সঙ্গে সামান্য নীল মিশিয়ে দিয়ে সাদা রঙ করা হয়।
  • কাজল, কাঠ-কয়লা, গাব গাছের শিকড় পুড়িয়ে কালো রঙ তৈরী করা হয়।
  • হলুদ গাছের শিকড় থেকে, কাঁচা হলুদ, আলামাটি থেকে হলুদ রঙ তৈরী করা হয়।
  • বেলপাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে, হিঞ্চে শাকের রস, শিমপাতা থেকে সবুজ রঙ তৈরী করা হয়। 
  • পাকা পুঁই মুচুড়ি ও জাম থেকে আসে বেগুনি রঙ।
  • অপরাজিতা ফুল বা তুঁত থেকে নীল রঙ।
  • চুন বা আলামাটির সঙ্গে খয়ের মিশিয়ে তৈরী করা হয় খয়েরি রঙ।
  • রঙ ভালোভাবে ধরানোর জন্য রঙের সঙ্গে মেশানো হয় বেল, গঁদ, শিরিশ বা নিমের আঠা, তেঁতুল বিঁচি ভিজিয়ে সিদ্ধ করে থকথকে কাই করা হয় অথবা ডিমের কুসুমের সাহায্য রঙ ধরানো হয়।

পটচিত্রের বিষয়বস্তু:

পটচিত্রে পটুয়াদের হাতের ছোঁয়া রয়েছে। বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত জ্ঞান ও লোকজ প্রাকৃতিক উপাদানকে কাজে লাগিয়ে তারা চিত্রাঙ্কন করে। বিষয় নিরপেক্ষ, ধর্মীয়, সামাজিক, পরিবেশগত, 

রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিষয়ই মূলত পটচিত্রের বিষয়বস্তু৷ এছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়, বিখ্যাত কাহিনী, ব্যক্তি প্রভৃতি নিয়েও পটচিত্র তৈরী হয়। তবে পটে ধর্মীয় বিষয়কে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়। ধর্মকে কেন্দ্র করেই পটের উৎপত্তি ও তা অধিক বিস্তার লাভ করে। যেহেতু ধর্মকে কেন্দ্র করে পটচিত্র গড়ে ওঠে তাই বলাই যায় ধর্ম হলো এর অন্যতম মূল বিষয়বস্তু। যাদের মাটির প্রতিম গড়ে পূজা করার মতো সামর্থ্য ছিল না তারা পটচিত্রে পূজা করতেন। মনসা, দূর্গা, লক্ষ্মী দেবীর পট বেশি আঁকা হতো। পটের মাধ্যমে রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হতো। পটে সাবেকি বাংলার চাল-চিত্র ফুটে ওঠে। বাংলার নর-নারীদের জীবন, নারীদের দুঃখ, প্রেম,বিচ্ছেদ, বিবাহ প্রভৃতি পটের বিষয়বস্তু। বাংলায় গাজীর পট, সত্যপীরের  পট, বনবিবির পট, বনদূর্গার পট বেশ জনপ্রিয়। আবার মঙ্গলকাব্য, মনসামঙ্গল, পৌরাণিক কাহিনী পটের অন্যতম বিষয়বস্তু। গৃহে পটচিত্র রাখাকে কল্যাণকর ও শুভ বলে মনে করা হয়। 

পটচিত্র ও পটের গান:

পটচিত্র ও পটের গানের মধ্য নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। পটুয়াদের হাতের ছোঁয়া ও রঙে পটচিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে, সেই সাথে পটচিত্রকে আরও একটু প্রাণবন্ত করতে পটের গান গাওয়া হয়। কাপড়ের চিত্রকে গানের মাধ্যমে শ্রোতাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়।  কাহিনী, গল্পগাঁথা, উপখ্যান প্রভৃতি প্রাণ পায়। ছন্দ মিলিয়ে গান গেয়ে পুরো কাহিনীর বর্ণনা দেওয়া হয়। বাংলায় ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে হয়ে পটুয়ারা পটচিত্র অঙ্কন করে থাকে ও কাঠিতে জড়ানো পটের ছবি দেখিয়ে পুরো একটি কাহিনী বা আখ্যানকে গান গেয়ে দেখানোর রীতি বাংলাতে এখনও প্রচলিত রয়েছে। 

পটচিত্র ও পট গানে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিফলন:

একসময় হিন্দুদের ধর্মীয় কাহিনীর পাশাপাশি মুসলিমদের গাজির পট, মানিক পীরের পট দেখায় পটুয়ারা। ফলে পটের মধ্যেও ইসলামী প্রভাব বেশ বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে মুসলিম পটের প্রচলন বেশি দেখা যায়। ফলে পটের কাহিনী, চরিত্র ও ঘটনাবলী প্রায় একই রকম হলেও হিন্দু-মুসলিম মিশ্রিত পট নতুন মাত্রা যোগ করে, যার প্রভাব সমাজেও পড়ে। এসময়ে ও পরবর্তী সময়ে অসংখ্য সুফি ধর্ম প্রচারক মধ্য ইরান-আরব এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। এঁদের প্রভাবেই এদেশের মানুষ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারে ও ইসলামের সান্নিধ্যে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। যার প্রভাব পড়ে  মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে এবং দেশীয় সংস্কৃতিতে। ফলে সেই প্রভাব পটচিত্রেও দেখা যায়। ইসলামের প্রভাবে পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে  যুক্ত হয় ইসলামী আখ্যান। পরিবর্তন আসে দেব-দেবীর বেশভূষা ও চালচিত্রে। যেমন- বনদুর্গা হয়ে ওঠেন বনবিবি, শীতলা পান বনবিবির রূপ, দক্ষিণ রায়ের স্থলে আসে গাজী-কালু, সত্যনারায়ণের হন সত্যপীর। পীর ফকির ও দেব-দেবী বাঙালি জীবনের নতুন অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এই অনুষঙ্গের নির্ভরতায় পটচিত্রের আখ্যান আর চরিত্রেও বদল ঘটে। তাই কালিয়া দমন আর গোষ্ঠ লীলার পাশাপাশি দেখা যায় গাজীর পটের অবস্থান। যা মূলত সুস্পষ্টভাবে বাঙালি জীবনে ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণের পরিচয় বহন করে।  

পটুয়া শিল্পীরা হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এঁকে তাদের মহিমা কীর্ত্তন করতেন তবে তারা বেশিরভাগই হিন্দু নয়। তারা হিন্দুদের সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকেই অতি সম্পৃক্ত ও পরিবারের মেয়েরা অনেকেই হিন্দুদের সামাজিক রীতি-নীতি মেনে চলে। শাঁখা-সিঁদুর পরে,  শাড়ি পরে, মাথায় ঘোমটা দেয়। তবে হিন্দু মুসলমান সমাজের মধ্যে বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হতো না। হিন্দু সমাজে এরা ব্রাত্য ছিল। আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ইহারা দেবতার চিত্রাঙ্কন ও তাহাদের মহিমা কীর্তন বিষয়ে পৌরাণিক আদর্শ রক্ষা করিবার পরিবর্তে লৌকিক আদর্শেরই অনুসরণ করে- অতএব ব্রহ্মার শাপে ও ব্রাহ্মণের কোপ বশত: তাহাদের এই অবস্থা হইয়াছে।’ পটুয়াদের পটে মহিষাসূরমর্দিনী, কমলে কামিনী, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা-চাঁদ সওদাগর, কৃষ্ণ-রাধা, চৈতন্যলীলা কাহিনী থাকে।  আবার সাঁওতালদের মরং বুরু, মরা-হাজা, পিচলু বুড়ি ইত্যাদির কাহিনী থাকে। আর মুসলিমদের জন্য পীরপট, গাজীর পট আঁকা হয়। এতে পীরের অলৌকিক ঘটনা, যম, যাদু ও চক্ষুদানপটের মতো রাশিপট যাদুটোনা ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো। পটশিল্পীদের পট ও পটগীতি সম্পর্কে গুরুসদয় দত্ত বলেছেন- ‘পটুয়া-শিল্পীর বৃন্দাবন বাংলাদেশে, অযোধ্যা বাংলাদেশে, শিবের কৈলাশ বাংলাদেশে; তাহার কৃষ্ণ, রাধা, গোপ-গোপীগণ সম্পূর্ণ বাঙ্গালী; রাম লক্ষণ ও সীতা বাঙ্গালী, শিব পার্ব্বতীও পুরা বাঙ্গালী। বড়াই বুড়ীর ছবি বাঙ্গালী ঠাকুরমা ও পিসীমার নিখুঁত প্রতিমূর্তি। রামের বিবাহ হইয়াছে ছাতনাতলায়। পার্ব্বতীর কাছে সব অলঙ্কার হইতে শাঁখার মর্যাদা ও আদর বেশি।’ হিন্দু সমাজে তারা আদরনীয় হওয়ায় মুসলমান সমাজ আর গ্রহণ করল না ফলে মুসলমান সমাজেও এরা ব্রাত্য হয়ে পড়ল। এই সব নানা কারণে পটুয়াদের মধ্যে হিন্দু – মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতির প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু কোনো ধর্মেই তাদের সঠিক মর্যাদা ছিল না। তাই সামাজিকভাবে তারা ছিল চরম অবহেলিত সম্প্রদায়। জীবিকার তাগিদে তারা পটচিত্র ও পটগান ছাড়াও সাপখেলা দেখাতো। আর্থিক দিক থেকে পটুয়া সমাজ বরাবরই নিম্নমুখী, তারা কখনই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। আবার সামাজিকভাবেও তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদাটুকু পায়নি। ধর্মীয়ভাবেও তাদের ছিল মিশ্র বিষয়, মূলত ধর্মীয় দিক থেকেই তারা ব্রাত্য বিধায় সমাজে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান কখনই গড়ে উঠেনি। যে কারণে তারা সবদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল। সামাজিক, ধর্মীয় ও আর্থিক দিক থেকে তারা ছিল অসহায় ও নিষ্পেষিত সম্প্রদায়। 

পটচিত্র ও গানের আধুনিকতা:

বর্তমানে পটুয়ারা অনেকেই তাদের পুরাতন পেশা ছেড়েছেন এবং অন্যভাবে উপার্জনের চেষ্টা করছে।  কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতা ও নাগরিকতার সান্নিধ্যে পটুয়াদের ভাবনা বদলেছে। যাই হোক পটুয়ারা তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে আবার অনেকেই পুরাতন পেশাকে আঁকড়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। পটচিত্র করলেও পটের গান ছেড়েছেন। তবে তাদের সৃজনশীল কাজের জন্য অনেকেই পাচ্ছেন দেশি বিদেশি সম্মাননা। যশোর ও খুলনা অঞ্চলে পটুয়াদের ‘গাইন’ নামে অভিহিত করা হয়। অতীতে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং দিনাজপুর অঞ্চলে পটুয়ারা বসবাস করত। বর্তমানে তা হ্রাস পেয়েছে। তবে বর্তমানে বেশকিছু নাট্যসংগঠন, এনজিও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পটের গান পরিবেশন করে। এখনকার পটের গানে ধর্মীয় আখ্যান উঠে আসে না। উঠে আসে সমাজ সচেতনতামূলক বিষয়। যেমন- নারী ও শিশু নির্যাতন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আদমশুমারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সচেতনতা প্রভৃতি। আবার নগরকেন্দ্রীক শৌখিন মানুষেরা সাবেকি ধারার পটচিত্রও সংরক্ষণ করে থাকেন। কিছু কিছু মেলায় মাঝেমধ্যে পটচিত্র পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জে লোকশিল্প জাদুঘর ও বাংলা একাডেমিতে কিছু পটচিত্র সংরক্ষিত আছে।

বর্তমানে শাড়ি-থ্রিপিচ-ব্লাউজেও যমিনী রায়ের পটচিত্রের ছবিকে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে নারী ও শিশু, নারী-পুরুষের সেই পটের ছবিকেই উপস্থাপন করা হচ্ছে ভিন্নভাবে। এখানে লোকজ প্রাকৃতির রঙের বদলে অ্যাকরোলিক রঙের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। এতে মূলত ব্যবসায়ে অভিনবত্ব আসছে। নারী উদ্যোক্তাদের হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠছে এসব চিত্র। আধুনিক রমনীদের কাছে যার বেশ কদর আছে। 

পরিশেষে বলা যায়, পটচিত্র আমাদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা বিলুপ্তির পথে। মূলত ন্যায্য অধিকার ও কাজের সম্মানী না পাবার কারণের পটুয়ারা তাদের পেশা পরিবর্তন করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন। বিলুপ্তপ্রায় এই লোকজ ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি পদক্ষেপ জরুরি। সরকারের উচিত পটচিত্র ও পটের গান সংরক্ষণের জন্য সরকারি প্রণোদনা প্রদান করা। যে সকল পটুয়া বা চিত্রশিল্পী আজও পটচিত্রকে ধরে রেখেছেন বা চিত্রাঙ্কন করছেন তাদের আর্থিক সহায়তা করা উচিত যাতে বিলুপ্তপ্রায় এই লোকশিল্পটি যেন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত না হয়ে যায়।

 

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।