ইতিহাসঐতিহ্যফিচার

কোহিনূর : ভারতের রাজদরবার থেকে ব্রিটিশ রানির মুকুটের রত্ন!

কোহিনূর নামটি শুনলেই মাথায় আসে ব্রিটিশ রানি ২য় এলিজাবেথের মুকুটে জ্বলজ্বল করতে থাকা এক হীরকখণ্ডের নাম। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অন্যতম গর্বের নাম এই কোহিনূর। অথচ আজ থেকে তিন চারশো বছর আগেও এই কোহিনূর ছিল আমাদের সম্পদ, আমাদের ভারতবর্ষের সম্পদ। আমাদের এই অমূল্য রত্নটি দখল করে নিয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ বেনিয়ারা। উপহার দিয়েছিল ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়াকে। যার আজকের ঐতিহাসিক ও বাজারমূল্য ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। সেই থেকে ভারতবর্ষে নয়, এই অমূল্য রত্নটি শোভা পাচ্ছে ব্রিটিশ রানির মুকুটে! প্রিয় পাঠক, চলুন আজ জেনে নিই কোহিনূরের অমূল্য হয়ে ওঠার গল্প!

কোহিনূর হীরার ইতিহাস

প্রাচীনকালে হিন্দুরা মনে করতেন এই হীরা মহাবীর অর্জুনের হাতের বাহুর অলংকার। অনেকে মনে করেন, কাকাতিয়া রাজবংশের দেবীমন্দিরে দেবীর চোখ হিসেবে কোহিনুর ব্যবহার করা হতো। সবার বিশ্বাস, আলোচনা, দ্বন্দ্ব নিয়েই কোহিনূর এখনো পৃথিবীবাসীর কাছে ঐতিহাসিক রহস্যের নাম।

কোহিনূর হীরার সন্ধান পাওয়া যায় তেরো শতাব্দীতে। গবেষকদের মতে, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার সন্তোষনগর অঞ্চলের কল্লর খনি থেকে এ হীরাটি উত্তোলন করা হয়। কোহিনূরের সাথে ‘দরিয়া–ই–নূর’ নামে আরেকটি হীরাও উত্তোলন করা হয়। দুটি হীরা দেখতে একইরকম ছিল। কোহিনূরের প্রাথমিক ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারেট। কিন্তু ভেনিসের হীরা কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিসের অদক্ষতার কারণে কোহিনূরকে কেটে ছোটো করে ফেলেন। এর বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট।

কোহিনূর বহুল আলোচিত হলেও এটি কখনো বিক্রি করা হয়নি। সাম্রাজ্যে বদলের সাথে সাথে হীরাটিরও হাত বদল হয়েছে। আবার কোহিনূর চুরি করে নেওয়ারও বহুল আলোচিত ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহাসিকদের তথ্য মতে, কোহিনূর প্রথম দিকে মালবের রাজপরিবারের অধিকারে ছিল।

আরও পড়ুন# এবার রোবট হলো কোম্পানির সিইও!

পরবর্তীকালে তা মুঘল সম্রাটদের হাতে আসে। সম্রাট শাহজাহান নির্মিত ময়ূর সিংহাসনের শোভা বর্ধন করে। মুঘল সাম্রাজ্য যখন বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন নাদির শাহকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মুসলিম শাসনের গৌরবোজ্জ্বল দিন ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে। কিন্তু তাকে প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়। কৌশলে তিনি মোগলদের কাছ থেকে কোহিনূর উদ্ধার করে নিয়ে যান ইরানে। কোহিনূর নামটিও নাদির শাহের দেওয়া মনে করা হয়। নাদির শাহ নি’হ’ত হবার পর কোহিনূর আসে আবার মুঘল সম্রাজ্যে। মুঘল আমলে এটি মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। যার কারণে মুঘল শাসকবৃন্দ কোহিনূরের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান ছিলেন। মুঘল শাসকদের অধিকারে কোহিনূর ২১৩ বছর ছিল। পরে আফগানদের কাছে ৬৬ বছর ও ব্রিটেনের অধিকারে ১৩৪ বছর পার করে হীরকখণ্ডটি। এটি বর্তমানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পত্তি হিসেবে রয়েছে।

কোহিনূর নামকরণ

কোহিনূর নামটি মুঘলদের দেয়া। ফারসি শব্দ কোহ–ই–নূর শব্দটি থেকে কোহিনূর শব্দটির উদ্ভব। কোহ–ই–নূর অর্থ আলোর পর্বত। উজ্জ্বলতার কারণেই এমন নাম দেওয়া হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

কোহিনূরের হাতবদল

মুঘল আমলে এটিকে ‘বাবরের হীরা’ বলা হত। পানিপথের যুদ্ধের পর সম্রাট বাবরকে কোহিনূর হীরা উপহার দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র সম্রাট হুমায়ূন। বাবর বা হুমায়ূন কেউ এ হীরাকে অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেননি। সম্রাট শাহজাহান সিংহাসনে বসার পর প্রথমবারের মতো ময়ূর সিংহাসনের অলঙ্কার হিসেবে কোহিনূর ব্যবহার করেন। পরে পারস্যের নাদির শাহ হীরাটি লুট করেন।

তারপর এই হীরাটি চলে যায় শিখদের হাতে। পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিং আফগান শাসকের নিকট থেকে কোহিনূর হীরা পেয়েছিলেন। তিনি তা উইল করে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে দিয়ে যান। দ্বিতীয় ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধের পর শিখদের হারিয়ে ব্রিটিশরা শিখ সাম্রাজ্য দখল করে। তার জন্য লর্ড ডালহৌসি লাহৌরের শেষ চুক্তি তৈরি করেন। সেই চুক্তিতেই কোহিনূর সহ মহারাজার যাবতীয় সম্পদ ইংরেজদের রাজ্য ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়াকে সমর্পণের কথা বলা হয়েছিল।

ব্রিটেনের রানির মুকুটে থাকা কোহিনূর
ব্রিটেনের রানির মুকুটে থাকা কোহিনূর

উত্তরসূরি দলীপ সিং ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে এটি তুলে দেন। শেষ পর্যন্ত সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তুলে দেন রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে। ১০৮.৯৩ ক্যারেট ওজনবিশিষ্ট কোহিনূর প্রথমে রানি ভিক্টোরিয়া ব্যবহার করতেন তার হাতে। এরপর সেটি স্থান পায় ব্রিটিশ মুকুটে। তবে ব্রিটিশরা এই হীরাটি ঠিক লুট করে নেয়নি। ২০১৬ সালের এক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মনে করে, ইংরেজ শাসকেরা ভারত থেকে কোহিনুর চুরি যেমন করেনি, তেমনি লুট করেও নিয়ে যায়নি। পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিং ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজেই এই অমূল্য সম্পদ উপহার দিয়েছিলেন।’ তবে এ ঘটনার সময় দলীপ সিংহ ছিলেন নাবালক। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, নাবালক রাজাকে চাপ দিয়ে কোহিনূর নেওয়া হইয়েছে এবং সেই যুক্তিতেই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার সময় এবং তার পরে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় কোহিনূর প্রত্যর্পণের দাবি তুলেছে ভারত। কিন্তু চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে তা খারিজ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার।

অভিশপ্ত কোহিনূর

কোহিনুরের অভিশাপ নিয়ে প্রচুর গল্প বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে আছে। বলা হয়, যে শাসকের অধীনে এ হীরাটি ছিল সেই হারিয়েছে তার সাম্রাজ্য, ধন-দৌলত। সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে ব্রিটিশ রাজা পর্যন্ত, যিনিই এ হীরাটির অধিকারী হয়েছেন তার জীবনেরই নেমে এসেছে দুর্গতি। সিংহাসন ত্যাগ, সংঘাত, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, খুনাখুনির ইতিহাস তাই কোহিনূরের সাথে গাঢ়ভাবে লেপ্টে আছে। কোহিনূরকে ভারত থেকে  ইংল্যান্ডে নেওয়ার পথে কম দুর্গতি পোহাতে হয়নি ব্রিটিশদের।

আরও পড়ুন# জমজ সন্তানের জন্ম দিলেন তরুণী, জানা গেল দুই সন্তানের বাবা আলাদা!

১৮৫০ সালের ১২ জানুয়ারি ডালহৌসি কোহিনূরকে ব্রিটেনে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ৬ এপ্রিল কোহিনূরকে নিয়ে জলপথে ব্রিটেন রওনা দেয়া হয়। কোহিনুর নেয়া হচ্ছিল ব্রিটেনের রানির জাহাজ ‘মিডিয়া’য়। যাত্রার কদিন পরেই জাহাজে যেন অভিশাপ লাগে। কলেরার মহামারিতে এসময় একে একে ১৩৫ জন নাবিক মারা যান।

এখানেই শেষ নয়। এ জাহাজটি এরপর ঝড়ের কবলেও পড়েছিল। অনেক বিপত্তি শেষে ৩০ জুন মিডিয়া  ব্রিটেনের প্লাইমাউথ বন্দরে পৌঁছে। ওইসময়ই বিট্রিশ ও অন্যান্য সংবাদপত্রগুলো কোহিনুরের অভিশাপ নিয়ে লিখতে শুরু করে। ব্রিটেনে যাওয়ার পর কোহিনূরের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার হয়। সেটি হলো কোহিনুর কেবল পুরুষ শাসকদেরকেই অভিশাপ দিয়ে থাকে। নারীরা তার অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকে। যার কারণে কোহিনুরের অভিশাপ রানি ভিক্টোরিয়া ও এলিজাবেথের ক্ষেত্রে কোনো কাজ করেনি। মহারানি ভিক্টোরিয়া একটি নিয়ম চালু করে যান। এতে বলা হয় কোহিনূর বসানো রাজমুকুট কেবল রানিরাই ব্যবহার করতেও পারবেন, কোনো রাজা নয়। সে হিসেবে কোহিনূরের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হবেন রাজা ৩য় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলিয়া রোজমেরি।

উপসংহার

কোহিনুর বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো হীরা নয়। এটি ভরের দিক দিয়ে পৃথিবীর ৯০তম। কিন্তু এ হীরাটির পৃথিবীব্যাপী যে ঐতিহাসিক মূল্য, আলোচনা, মিথ রয়েছে তা অন্য কোনো হীরার নেই। সেজন্যই পৃথিবীবাসীর আগ্রহ এখনো কোহিনূরের দিকে রয়েছে। যে কারণে বলা যায়, আরও শত শত বছর কোহিনূর তার মিথ ও রহস্যের দ্যুতি ছড়াবে পৃথিবী ভরে। কোহিনূর ভারতের সম্পদ না ব্রিটিশদের সে তর্ক আজ থাকুক, দীর্ঘ সত্তর বছর পর এই হীরাটি পেতে যাচ্ছে তার নতুন উত্তরাধিকারীকে। এখন থেকে যে নতুন রানির মুকুটেই শোভা পাবে হীরাটি!

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।