ইতিহাসধর্ম

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ আমাদের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী । তিনি ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী জানা জরুরী। চলুন জেনে নেই প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী..

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে পুণ্যমানব তিনি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম জাতির হেদায়াতের জন্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে প্রেরণ করেন। বিশ্বনবী (স.) আর্বিভাবের পূর্বে সমগ্র পৃথিবী ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। অনাচার, অবিচার আর ব্যভিচারে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল গোটা জগত। আরব, পারস্য, ভারতবর্ষ তৎকালীন সভ্য জগতের সবখানেই নিভে গিয়েছিল সত্যের আলো। সে সময় আরবের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়।

জন্ম ও পিতা-মাতাঃ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম সৌদি আরবের মক্কা নগরীর কোরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে আব্দুল্লাহ ও আমিনার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান ধারণা অনুযায়ী উনার জন্ম সাল 570 খ্রিস্টাব্দে। মহানবী (স.)-এর জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। ছয় বছর বয়েসে মমতাময়ী মা পরলোকগমন করলে শিশুনবী এতিম হয়ে পড়েন। কিছু দিন উনার দাদাআব্দুল মুত্তালিবের স্নেহ ছায়ায় লালিত-পালিত হন। ৮ বছর বয়সে দাদার ইন্তেকালের পর উনার চাচা আবু তালিবের সংসারে বড় হতে থাকেন।

বাল্যকালঃ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন আরবে একটি প্রথা চালু ছিল যে তখনকার সময়ে আরবে যে সকল শিশু জন্মগ্রহণ করত তাদেরকে দুধ বাড়ানোর জন্য বেদুইন মহিলাদের কাছে পাঠানো হতো। এই রীতি অনুসারে হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে হালিমা বিনতে হুজাইভ এর কাছে তুলে দেন। ৮ দিন বয়সে তিনি মুহাম্মদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং দুই বছরের কিছু অধিক সময় পর্যন্ত তাকে মদীনায় নিজ বাড়িতে লালন-পালন করেন। হালিমার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই অসচ্ছল। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে ঘরে নেওয়ার পর আল্লাহর রহমতে হালিমার ঘর সচ্ছল হয়। হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর দুধ ভাই ছিল। তার নাম ছিল আশ শায়মা অথবা খুযাইমা মতান্তরে হুযাফা। হযরত মুহাম্মদ সাঃ হালিমার একটি স্তনের দুধ পান করতেন। অন্য স্তনের দুধ উনার দুধ ভাই আশ শায়মা অথবা খুযাইমা মতান্তরে হুযাফার জন্য রেখে দিতেন। তখন থেকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর ইনসাফ ন্যায় বিচার করতে শেখেন। হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে দুই বছর লালন পালন করার পর মা আমিনার ফিরিয়ে দেন। তারপর থেকে মক্কায় মহামারী শুরু হয়। মা আমিনা পুনরায় হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে হালিমার নিকট ফিরিয়ে দেয়। মা হালিমাও চেয়েছিল শিশু নবীকে ফিরে পেতে।

উনাকে ফিরে পেয়ে দুধ ভাই-বোনেরাও খুব খুশি হয়েছিল। ইসলামের ও পুরো বিশ্বের নবী হযরত মুহাম্মদ এর শৈশব বয়স থেকেই ছিলেন চিন্তাশীল । তিনি তার শৈশব ও কৈশরকাল থেকেই সমাজের ও মানুষের বিভিন্ন বিষয় দুঃখ,কস্ট,ক্লেশ নিয়ে চিন্তা করতেন। ইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।

এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মাদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। হযরত মুহাম্মদ সাঃ ,তার শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে পাঁচশত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। উনার মায়ের মৃ,ত্যুর পরবর্তী সময়ে ওনার দাদার কাছে বড় হতে শুরু হয়। আবার ওনার দাদার মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে ওনার চাচার কাছে বড় হয়। উনার চাচা ওনাকে সাথে নিয়ে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া যাত্রা শুরু করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ছোটবেলা থেকে ছিল ন্যায় বিচারক সত্যবাদী। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস সামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।ইসলামের ও পুরো বিশ্বের নবী হযরত মুহাম্মদ এর শৈশব বয়স থেকেই ছিলেন চিন্তাশীল। তিনি তার শৈশব ও কৈশরকাল থেকেই সমাজের ও মানুষের বিভিন্ন বিষয় দুঃখ,কস্ট,ক্লেশ নিয়ে চিন্তা করতেন। এই চিন্তাধারাই তাকে পরবর্তীতে মহামানব হতে সাহায্য করেছিলো। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল। তিনি ছিলন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তিনিই একমাত্র মানব যে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি।

নিকাহ বা বিবাহঃ মুহাম্মাদ ২৫ বছর বয়সে তার প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদের সাথে বিবাহ করেন। মহানবী মুহাম্মদ সা: তার ৬৩ বছর ৪ দিনের জীবনে মোট ১১টি বিবাহ করেন। রাসূল (সা.) এর ১১ জন স্ত্রীদের মধ্যে দশ জনই ছিলেন হয় বিধবা না হয় তালাক প্রাপ্তা। যথাক্রমে,

১.খাদিজা (রা:)।
২.সওদা বিনতে জামআ (রা:)।
৩.আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা:)।
৪.হাফসা বিনতে ওমর (রা:)।
৫.যয়নব বিনতে খোযায়মা (রা:)।
৬.উম্মে সালমা হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া (রা:)।
৭.যয়নব বিনতে জাহাশ ইবনে রিয়াব (রা:)।
৮.যুয়াইরিয়া বিনতে হারেস (রা:)।
৯.উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান (রা:)।
১০.সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রা:)।
১১.মায়মুনা বিনতে হারেস (রা:)।

নবুয়ত প্রাপ্তের পূর্ববতী জীবন: জাহেলি যুগের লোকেরা যেসব কাজ করত, দুবারের বেশি কখনোই সেসব কাজ করার ইচ্ছা আমার হয়নি। সে দুটি কাজেও আল্লাহর পক্ষ থেকে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর সে ধরনের কাজের ইচ্ছা কখনো আমার জাগেনি।’ তা হলো তিনি বকরি ও উট চরানোর সময় দুই দিন তিনি সঙ্গের বালকের কাছে পশু রেখে মক্কা নগরীতে হওয়া রাতের আড্ডায় অংশ নিতে আসেন। সেখানে গান-বাজনা হচ্ছিল। দুই দিনই আল্লাহ তাঁর কান বন্ধ করে দেন এবং তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মাদ এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তরুণ বয়সে মুহাম্মাদের তেমন কোন পেশা ছিলনা। তবে তিনি বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা’দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। এরপর তিনি ব্যবসায় শুরু করেন। মুহাম্মাদ অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে তার উপাধি হয়ে যায় আল আমিন এবং আল সাদিক যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী। ব্যবসায় উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মাদের সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। মুহাম্মাদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।

খাদীজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভূয়সী প্রশংশা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলেন জানাবেন। মুহাম্মাদ তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫।মুহাম্মাদের বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা’বা গৃহের পূনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এভাবে পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দল। নির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবে এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন মুহাম্মাদ সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।

নবুয়ত প্রাপ্তের পরর্বতী জীবন: চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুওয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল তার কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিব্রাইল তাঁকে এই পংক্তি কটি পড়তে বলেন:
ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ
خَلَقَ ٱلْإِنسَٰنَ مِنْ عَلَقٍ
ٱقْرَأْ وَرَبُّكَ ٱلْأَكْرَمُ
ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ
عَلَّمَ ٱلْإِنسَٰنَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

অর্থঃ পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।

উত্তরে নবী জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিব্রাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পংক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মুহাম্মাদ পংক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। অবর্তীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গ্রহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাবেন, “আমাকে আবৃত কর”। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হন নবী। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্‌সির-এর কয়েকটি আয়াত। এর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ। এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর। এই প্রতিকূলততার মধ্যেই নবীর মক্কী জীবন শুরু হয়।

গোপন ইসলাম ধর্ম প্রচার: মহানবী (সা.) বুঝতে পারেন, ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে। কারণ তৎকালীন নেতৃত্বের ভিত ধ্বংস করা ব্যতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোনো উপায় ছিল না। মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী সর্বপ্রথম ব্যক্তি ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.)। এরপর মুসলমান হন মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচাতো ভাই, তাঁর ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলী (রা.)। হজরত আলী (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের সময় বয়স ছিল ১০ বছর। ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য নবী (সা.) নিজ বংশীয় বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি সভা করেন। এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শ মেনে নেয়নি। এ সভায় শুধু একজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হলেন হজরত আলী (রা.)। ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন নবীর (সা.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু, মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ করতে থাকেন। এভাবে তিন বছর গোপনে দীন ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার পর মুহাম্মদ (সা.) প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার-প্রসার শুরু করেন। এ ধরনের প্রচারের সূচনাটা নাটকীয় ছিল। নবী (সা.) সাফা পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন, আল্লাহতায়ালা ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহতায়ালার প্রেরিত রসুল। এ সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়। মক্কার কাফির-মুশরিকরা যখন নবী করিম (সা.) কে আদর্শিক দিক দিয়ে মোকাবিলা করতে পারছিল না, তখন তারা কুৎসা রটনাসহ অশালীন কথা দ্বারা মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্মল চরিত্রে কালিমা লেপনের ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়। তাদের বিশ্বাস, এই অস্ত্রের আঘাতেই তাকে ধরাশায়ী করা যাবে।

ভিনদেশি লোকেরা দীন গ্রহণ করতে এসে তাঁর বদনাম শুনে ইসলাম গ্রহণ না করে নিজ দেশে ফিরে যাবেন। আর যদি তারা যাচাই-বাছাই করতে আসেন, তাহলে ঘুরে-ফিরে তাদের কাছেই তো আসতে হবে। তখন তারা তাদের মগজধোলাই করে ছাড়বেন। কাফির-মুশরিক কর্তৃক রসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেওয়া গালি ও মিথ্যা অপবাদসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো। তারা রসুলুল্লাহ (সা.) কে পাগল বা কবি হিসেবে প্রচার করতে থাকে। যেন মানুষ তাঁর কাছে না যান, তাঁর কাছে প্রেরিত ওহি তথা কোরআনুল কারিম থেকে দূরে থাকেন। আরবে বসবাসকারী কতিপয় লোক নবী (সা.) কে সাধারণ মানুষ বলে তাঁর নবুয়তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন। কেননা তিনি নবী হলে তাঁর সঙ্গে কোনো ফেরেশতা নেই কেন। যে তাঁর সত্যায়নকারী হতো? তারা মনে করত, নবী কোনো সাধারণ মানুষ হতে পারেন না। তিনি ফেরেশতাদের মধ্যে কেউ একজন হবেন। এভাবে তারা পথভ্রষ্ট হওয়া সত্ত্বেও উল্টো তারাই নবী করিম (সা.) কে পথভ্রষ্ট বলে গালিগালাজ করতে লাগল। তাদের দৃষ্টিতে তারাই হকপন্থি। নবী করিম (সা.) ও মুমিনরাই বিপথগামী। রসুলুল্লাহ (সা.) কে বেদীন বা ধর্মত্যাগী বলে তাদের প্রচারণা চালাতেন। জাহেলি যুগের মানুষদের প্রচারণায় অবাক না হয়ে পারা যায় না। ওই যুগে কুরাইশ নেতারা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের কাছে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ করে। এসব অভিযোগে ইসলামের দাওয়াতি মিশন নিস্তব্ধ করতে চেয়েছিল। প্রকারান্তরে তারা নবী করিম (সা.) কে নিয়ে হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা চাচার কাছে অভিযোগ করে যে, আপনার ভাতিজা পিতা-পিতামহের বিরোধিতা করছে। আপনার জাতির ঐক্য ছিন্নভিন্ন করছে। তাঁদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে। আমরা তাঁকে হত্যা করব। (আর-রাহিকুল মাখতুম, ১৭তম সংস্করণ ২০০৫ইং, পৃ. ৯৪)। এক সময় ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হলো উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। মহানবী (সা.) সব সময় চাইতেন আবু জেহেল ও ওমর (রা.) এদের যে কোনো একজন ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর এই ইচ্ছা পূর্ণ হলো। আরবে ওমর (রা.)-এর বিশেষ প্রভাব থাকায় তাঁর ইসলাম গ্রহণে ইসলাম প্রচার অনেকটা সহজ হয়। পরে মহানবী (সা.)-এর চাচা হামজা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা পায়।

প্রকাশ্য ইসলাম ধর্ম প্রচার: তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেয়ার পর মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। এ ধরণের প্রচারের সূচনাটা বেশ নাটকীয় ছিল। নবী সাফা পর্বতের ওপর দাড়িয়ে চিৎকার করে সকলকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্‌র রাসূল। কিন্তু এতে সকলে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড খেপে যায় এবং এই সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়।

মদীনায় হিজরতঃ এরপর আরও শুভ ঘটনা ঘটে। মদীনার বেশকিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মূলত হজ্জ্ব করতে এসে ইসলামে দাওয়াত পেয়েছিল। এরা আকাব নামক স্থানে মুহাম্মাদের কাছে শপথ করে যে তারা যে কোন অবস্থায় নবীকে রক্ষা করবে এবং ইসলামে প্রসারে কাজ করবে। এই শপথগুলো আকাবার শপথ নামে সুপরিচিত। এই শপথগুলোর মাধ্যমেই মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একসময় মদীনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। মদীনা তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকে প্রায় ৬২০ সাল পর্যন্ত গোত্র গোত্র এবং ইহুদীদের সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকে। বিশেষত বুয়াছের যুদ্ধে সবগুলো গোত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ায় প্রচুর রক্তপাত ঘটে। এ থেকে মদীনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত নেয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারেনা। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যে সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবে। এ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মাদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। এই আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যায়। সবশেষে মুহাম্মাদ ও আবু বকর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন। তাদের হিজরতের দিনেই কুরাইশরা মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তা সফল হয়নি। এভাবেই মক্কী যুগের সমাপ্তি ঘটে।

মাদানী জীবনঃ নিজ গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে যোগদান আরবে অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হত। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সেরকম নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইসলামের বন্ধনই শ্রেষ্ঠ বন্ধন হিসেবে মুসলিমদের কাছে পরিগণিত হত। এটি তখনকার যুগে একটি বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। ইসলামী পঞ্জিকায় হিজরতের বর্ষ থেকে দিন গণনা শুরু হয়।

মহানবী সাঃ এর বিদায় হজ্জের ভাষণঃ আরবি দশম হিজরী সনের পবিত্র হজের সময় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সাহাবির সামনে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ বিকালে আরাফাতের ময়দানে যে বক্তব্য পেশ করেন এবং পরদিন ১০ জিলহজ ঈদের দিন ও কোরবানির দিন প্রদান করেছিলেন। তাকেই বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ বলে। এই দুইদিনে দেওয়া তাঁর বক্তব্য বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। এটি ছিল মানব জাতির উদ্দেশে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ ভাষণ। এই ভাষণে মহানবী (সা.) বলেছিলেন:

হে লোক সকল! আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদিগকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। (আল-কোরআন, পারা: ২৬, সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)। সুতরাং কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান; আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট।

হে সভ্যমণ্ডলী! এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসী) প্রতি খেয়াল রাখবে, তোমরা যা খাবে, তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরও তা পরাবে। সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।
হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে, স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে এবং নেতাদের আনুগত্য করবে; তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা শোনো। হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব না।

হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ ও পবিত্র তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। অচিরেই তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর সাক্ষাতে উপনীত হবে। তখন তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আমি তো তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তোমাদের কারও কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবে।নিশ্চয়ই সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো। তোমরা কোনো জুলুম করবে না, বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহিল যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো। প্রথম আমি রিবয়া ইবন হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম।

আরো পড়ুনঃ বৃদ্ধাশ্রম থেকে ছেলেকে লেখা বাবার চিঠি, পড়লে চোখের জল ধরে রাখতে পারবেন না

হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের এই ভূখণ্ডের উপাস্য হওয়ার ব্যাপারে চিরদিনের জন্য নিরাশ হয়ে গেছে। তবে এ ছাড়া তোমরা যা তুচ্ছ মনে করে থাকো, এমন বহু কাজ রয়েছে, যাতে তার আনুগত্য করলে সে খুশি হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার থেকে সাবধান থেকো। হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই মাসসমূহকে আগ-পিছ করা বস্তুত কুফরিকেই বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিররা বিভ্রান্ত হয়। অথচ কাল (সময়) তার নিজস্ব নিয়মে প্রকৃতিতে আবর্তিত হয়।
হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক প্রাপকের (উত্তরাধিকারীর) জন্য তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জন্মদাতা ছাড়া অন্যের সঙ্গে নিজের বংশসূত্র স্থাপন করে এবং যে নিজ মনিব ছাড়া অন্যকে মনিব বলে স্বীকার করে, তার ওপর আল্লাহর লানত। সব ঋণ পরিশোধের যোগ্য ও অধিকার, ধারকৃত বস্তু ফেরতযোগ্য, উপঢৌকনেরও বিনিময় প্রদান করা উচিত, জামিনদার জরিমানা আদায় করতে বাধ্য থাকবে। কারও জন্য তার অপর ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে নিজে সন্তুষ্টচিত্তে তা প্রদান না করে। কোনো নারীর জন্য তার স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর অর্থ-সম্পদ থেকে কাউকে কিছু দেওয়া বৈধ নয়। তোমরা কখনো একে অন্যের ওপর জুলুম কোরো না। নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে এবং তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার আছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো তারা তোমাদের বিছানায় কাউকে কখনো স্থান দেবে না, যা তোমাদের সবার অপছন্দনীয় এবং তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা কোনো অশ্লীল বা লজ্জাকর কাজে লিপ্ত হবে না। তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হও। কারণ, তারা তোমাদের কাছে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তারা তো নিজেদের জন্য কিছু করে না। তোমরা তো তাদের আল্লাহর আমানতস্বরূপ গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের সতীত্বের ওপর অধিকার লাভ করেছ (বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য অধিকার লাভ করেছ)।

অতএব, হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা অনুধাবন করো। আমি তো পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (সা.)এর সুন্নাহ।

হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা শোনো ও অনুধাবন করো। তোমরা অবশ্যই জেনে রেখো, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলিমগণ ভ্রাতৃপ্রতিম। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সন্তুষ্টচিত্তে তাকে তা প্রদান করে। অতএব, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না। সবাই শোনো, এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে।শোনো! তোমরা আল্লাহর দরবারে আমার ব্যাপারে যখন জিজ্ঞাসিত হবে, বলো তখন কী উত্তর দেবে? উপস্থিত সাহাবিরা উত্তর দিলেন, আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি যথাযথ পালন করেছেন; ইয়া রাসুলুল্লাহ! (হে আল্লাহর রাসুল!) আপনি রিসালাতের হক পূর্ণরুপে আদায় করেছেন এবং উম্মতকে কল্যাণপথের দিশা দিয়েছেন। তারপর তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি কি পৌঁছে দিয়েছি?উপস্থিত সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি পৌঁছিয়েছেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আকাশের দিকে শাহাদত অঙ্গুলি উত্তোলন করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। অতঃপর নাজিল হয়: ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম দিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম।

মৃত্যুঃ বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচন্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির ওপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রাঃ) এর কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল,মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলোও দান করে দেন। বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে। অবশেষে ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখ সন্ধায় তিনি মৃত্যবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। আলী (রাঃ) তাকেঁ গোসল দেন এবং কাফন পরান। আয়েশ (রাঃ)এর কামরার যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন,জানাযার পর সেখানেই তাকেঁ দাফন করা হয়।

এখানে যদি কোনো প্রকার ভুলত্রুটি থাকে, দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ভুল হলে আমাদেরকে কমেন্টে জানান। অনুলিপির সাথেই থাকুন

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।