বেদে সম্প্রদায়: কষ্টে মোড়ানো এক সম্প্রদায়ের জীবনগল্প!
বাংলাদেশের একটি যাযারব সম্প্রদায় হলো বেদে সম্প্রদায়। ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠী কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করে না। বেদে সম্প্রদায় সাময়িকভাবে আজ এখানে কাল ওখানে অবস্থান করে। নদীর সঙ্গে তাদের জীবনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নৌকায় তাদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি সাজানো। স্রোতের মতো ভেসে বেড়ানো বেদেদের জীবন যাদের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ, সামাজিক অনুষ্ঠান সবকিছুই নৌকাকেন্দ্রীক। এদের কোনো নির্দিষ্ট এলাকা নেই। এদের জীবন যাপন, আচার আচরণ সব কিছু চলছে একটি ভিন্ন সংস্কৃতির ধারায়, যাযাবরের মতোই বৈচিত্র্যময় তাদের জীবন ও সংস্কৃতি। এই সম্প্রদায়ের বাস নদীর পাড় কিংবা কোনো পতিত জায়গায় তবুও আবার তা অস্থায়ী। বেদে সম্প্রদায় দলবদ্ধভাবে বাস করে জীবিকার তাগিদেই।
বেদে সম্প্রদায় এর ইতিহাস:
বাংলাদেশের অতিপরিচিত একটি প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী হলো বেদে সম্প্রদায়। ভূমিহীন এই অসহায় মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকাতে বাস করে আসছে তাদের গোষ্ঠীর সূচনালগ্ন থেকেই। ভূমিহীন এই সম্প্রদায়ের ভিটামাটি বলে কিছুই নেই। বেদে সম্প্রদায় মূলত সাপের খেলা দেখানোর জন্যই বেশি জনপ্রিয়। বেদেদের বাদিয়া, বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামেও ডাকা হয় এবং এই নামগুলোর উৎপত্তি বৈদ্য থেকেই। তবে প্রাচীনকাল থেকেই বেদেরা কবিরাজি, ঝাঁড়ফুঁকসহ বিভিন্ন হাতুড়ে চিকিৎসার সাথে জড়িত ছিল। আবার অনেকেই অবশ্য দাবী করে থাকেন, বেদে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বেদুইন থেকে। আরব বেদুইনদের বেদেরা পরিচয় দেয় নিজেদের পূর্বপুরুষ হিসেবে।
নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় আবার বেদেরা অনার্য। বেদেরা সুঠাম দেহ, গভীর কালো গায়ের রঙ, কোঁকড়ানো চুল, আয়ত ও কালো চোখের অধিকারী। শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা আবার আদি অস্ট্রাল বংশোদ্ভূত। কারও মতে, বেদেরা আরাকানের মনতং মান্তা নৃগোত্র থেকে এসেছে। আবার কেউ বলে থাকেন, বেদেরা সাঁওতালদের বিচ্ছিন্ন অংশ। যারা পারস্যের সাথে বেদেদের সম্পর্কের কথা বলেন অনেকে। বেদেরা সাত শতকে আরবের আলবাদিয়া নামক স্থান থেকে এদিকে এসেছে। অনেকের ধারণা, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে পূর্ব ভারত থেকে বেদেরা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং কালক্রমে এ অঞ্চলে তারা আসে। আবার বলা হয়, বেদেরা কোনো একসময় সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রতিকূলতার জন্যই ঘরবাড়ির মায়া ছেড়ে বাধ্য হয় যাযাবর জীবন বেছে নিতে। শত শত বছর ধরে নদীর জীবনে সাথে তারা টিকে আছে।
বেদে সম্প্রদায় এর ভাষা:
বেদেরা বাংলায় কথা বললেও তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। নিজেদের মধ্যে বেদেরা ঠেট বা ঠার ভাষায় কথা বলে থাকে। বেদেরা অস্ট্রালগোত্রীয় কিন্তু ভাষার দিক দিয়ে তিব্বতি-বর্মি (সাক-লুইশ) ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তবে এ ভাষার কোনো লিপি নেই। ঠারভাষী বাংলাদেশি বেদের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার যা ১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী দেখানো হয়েছে।
বেদে সম্প্রদায় এর ধর্মাচার:
বাংলাদেশে বেদে সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং বাকি মানুষ হিন্দু। তবে বেদেদের ধর্মাচার অবশ্য মিশ্র। অনেকে পীরের অনুসারী, আবার অনেকে মনসা বা বিষহরির ভক্ত। ধর্মে সাধারণত বেদেদের আগ্রহ নেই তবে সর্বদেবী মনসাকে তারা মানেন। হিন্দু বেদেরা বিভিন্ন পার্বণে অংশ নিলেও পূজা অর্চনা করে না। বাঙালি মুসলমানদের সাথে এ সম্প্রদায়ের সামাজিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বিবাহ মুসলিম ধর্মীয় মতে হলেও বিবাহে বিভিন্ন রীতিনীতি আছে। গোষ্ঠীভেদে এসব রীতিনীতির পার্থক্য দেখা যায়। আগের দিনে নিয়ম ছিল মারা গেলে তাদের মৃতদেহ কলাগাছের ভেলায় ভাসানোর। এখনও তাদের মৃতদেহের ঠাঁই হয় কোনো পরিত্যক্ত স্থানে কিংবা নদীর কিনারায়। কারণ তাদের ধর্ম বা তারা আজও সমাজে স্বীকৃত নয়।
সমাজ ব্যবস্থা:
বেদেরা কৌমসমাজের রীতিনীতি মেনে চলে ও দলবদ্ধ হয়ে থাকে আবার মধ্যে গোত্রপ্রীতি প্রবল। তারা একে অন্যকে নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করে থাকে। তাদের জীবনযাত্রা, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন গোত্রের মধ্যেই আবদ্ধ। প্রতিটি বেদে পরিবারের নিজস্ব নৌকা আছে আর কয়েকটি নৌকা নিয়ে তৈরি হয় একটি দল। আবার কয়েকটি দল নিয়ে একেকটি বহর। প্রতিটি বেদে বহরে একজন সর্দার থাকেন। বহরের নিয়মনীতি, প্রত্যেক দলের বাণিজ্যপথ ও এলাকা এসবই নির্ধারণ করেন সর্দার। সর্দার এখানে মূল। বিয়ে এবং অন্যান্য উৎসবে সর্দারকে অর্থ কিংবা বিশেষ উপহার দিতে হয়। বেদে সম্প্রদায়ের উপগোত্রীয় ও গোত্রীয় সর্দারও আছে। বেদেরা ৮টি গোত্রে বিভক্ত। এই গোত্রগুলো হলো মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারী, বরিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে।
বেদে ছেলেরা অলস প্রকৃতির হয়ে থাকে আর সব রকমের কঠোর পরিশ্রম মেয়েরাই করে থাকে। নৌকা এদের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে এরা গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণ করে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে। এই পরিভ্রমণকে বেদেদের ভাষায় গাওয়াল বলে তবে মহিলারাই বেশি গাওয়ালে যায়। তাদের সাথে থাকে সাপের ঝাঁপি বা ঔষধের ঝুলি। এরা সাধারণত গাওয়ালে যায় শীতের শুরুতে অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে ও আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার্ধে। প্রথম দফায় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ও দ্বিতীয় দফায় আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এরা গাওয়াল করে। গায়ালের সময় এরা স্থানীয়ভাবে মূলত নৌকা, তাঁবু বা কোন স্কুল ঘরের বারান্দায় সপরিবারে থাকে। গাওয়াল শেষে দলবদ্ধভাবে আবার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসে।
বিবাহরীতি:
সাধারণত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌথ পরিবারের মতো প্রথাগুলো নেই বললেও চলে তবে বাল্যবিবাহ প্রথা কিছুটা আছে বেদে সমাজে আর বেদেনীরা স্বাধীনচেতা। বেদে যুবক-যুবতীরা স্বেচ্ছায় পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়েতে সম্মত হয়। তবে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ে করতে গেলে কনেকে অর্থ দিতে হয় বরের। বিয়ের ব্যাপারে যুবক-যুবতীর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। বিয়ের চমৎকার এক রীতি আছে বেদেদের। হবু বর গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে গিয়ে বসে তখন হবু বরকে নামাতে কনেকে কথা দিতে হয় শ্বশুর-শাশুড়ি আর সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার।বরকে আজীবন ভরণপোষণের প্রতিজ্ঞা করলে তবে সে নিচে নেমে আসে কারণ নারীরা এ সম্প্রদায়ের মূল। এরপর তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে আসে। বর-কনেসহ উপস্থিত সবাই নাচগানের মাধ্যমে উৎসবে মেতে ওঠে। গোত্রের মধ্যেই এদের বিয়ে হয় তবে বাইরের যুবক বেদে তরুণীকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে তাকে দিতে হয় ক্ষতিপূরণ। আবার স্বামী-স্ত্রীতে কখনো ছাড়াছাড়ি হলে সর্দারের নির্দেশে সন্তান ও সম্পত্তি দুজনকে ভাগ করে দেওয়া হয়। বেদে সমাজে বিধবা বিবাহও প্রচলিত রয়েছে।
জীবন যাপন ও পোশাক-পরিচ্ছদ:
বেদে নারীরা বেশ সাজগোজ করে। কোমরে বিছা আর গায়ে ইমিটেশন গহনা পরে আবার খোপায় ফুল গুঁজে রাখে। বেদেরা সহজ-সরল জীবনযাপনকারী ও খুবই সৎ প্রকৃতির। সর্দারের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না যতই গুরুতর শাস্তি হোক। ছোট্ট নৌকার বা সমতল ভূমিতে অবহেলিত হয়ে এদের বসবাস বিধায় এদের জীবন ধারণের মান অত্যন্ত নিম্নমানে ও অপরিচ্ছন্ন। এদের খাদ্য তালিকার কোনো বাছ-বিচার নেই। বেদে পুরুষরা বিভিন্ন ধরনের মাদকেও এরা আসক্ত।
তবে বেদে পুরুষেরা লুঙ্গি পরে। মহিলারা দশহাত কাপড় দুই টুকরা করে এক টুকরা কোমরের নিচে দুপ্যাঁচ দিয়ে, অন্য টুকরা গলায় ওড়নার মতো ঝুলিয়ে রাখে এবং গায়ে পরে যাকে বলে ফতুয়া অর্থাৎ আঙ্গি। তবে বর্তমানে অনেক মনতং নারী ও পুরুষ বাঙালি নারী-পুরুষের মতেই পোশাক পরতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশে বেদেদের অবস্থান ও আবাসস্থল:
বেদেরা আরাকান রাজ বল্লাল রাজার সাথে ১৬৩৮ সালে এ দেশে আসার পর বিক্রমপুরে প্রথম বসতি গড়ে তোলে। পরে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে তারা বসবাস করতে শুরু করে। বাংলাদেশের বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, নোয়াখালি, সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেদে সম্প্রদায়ের আবাসস্থলের কথা জানা যায়। সাভারে বেদেদের এক বিশাল প্রান্তিক গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের অধিকাংশই নিজেদের মান্তা বলে পরিচয় দেয়। মান্তারা পেশায় মৎস্যজীবী। এদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মাচার বেদেদের মতোই হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী তিলের খাজা
বেদে সম্প্রদায় এর জীবিকা:
বেদে বলতেই পৃথিবীর রহস্যময় একদল মানুষের চেহারা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এটায় স্বাভাবিক। আমাদের কল্পনায় আসে যাদের বড় বড় চুল, অস্বাভাবিক লম্বা গোঁফ, কাঁধে গেরুয়া কাপড়ের ঝোলা, হাতে বীণ, মাথায় সাপের ঝাঁপি। যাদের বেঁচে থাকার জন্য রয়েছে বিচিত্রসব পেশা। তন্ত্র-মন্ত্র, যাদু-টোনা ও বশিকরণ বিদ্যায় যাদের আজন্ম লালিত বিশ্বাস। বেদেদের মূল পেশা সাপখেলা। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, কালনাগ, গোখরা, আহলাদ, দারাজ, বাঁশপাতা, আরো কত কত জাতের সাপ আর বেজি নিত্যসঙ্গী তাদের। বাক্স ভরা সাপ-বেজি আর বেদে বা বাইদ্দারা জীবন ধারণের জন্য তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। নারীরা ছোট বাক্সে সাপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরে বাত ছাড়াতে চোঙা দিয়ে মানুষের শরীর থেকে রক্ত আনা, চুড়ি, ফিতা, গহনা বিক্রি করে পরিবারের সদস্যদের খাবারের জোগান দেয়।
বেদে মেয়েরা বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেঘুরে নিজেদের বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে চিকিৎসা করে। এরা গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বাতব্যথায় সিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা ও সাপ খেলা দেখানো, তাবিজ-কবজ বিক্রি, ঝাঁড়-ফুঁক দিয়ে আয় করে। সাপের খেলা দেখিয়ে আর নানা কথায় ওষুধ বিক্রি করে চলে তাদের সংসার। তবে বেদেরা সবচেয়ে বেশি যেটা করে সেটা হল সাপের বিভিন্ন রকমের খেলা দেখিয়ে টাকা উপার্জন করা। এছাড়াও মানুষকে সাপে কমড়ালেও বেদেরা শরীর থেকে সাপের বিষ নামিয়ে দেয়। ভেষজ ওষুধ বিক্রি, মৃত পশুর শরীরের অংশ এবং গাছ-গাছড়ার ওষুধ তৈরি করে বিক্রি, বানরখেলা ও জাদু দেখানো, মাছ ধরা, পাখি শিকার ইত্যাদি হরেক উপায়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করেন বেদেরা।
সামাজিক মর্যাদা:
বেদে সম্প্রদায়ের জীবন কষ্টের জীবন। তাদের বসবাসেরও কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ভবঘুরে এই গোষ্ঠী সামাজিকভাবে অবহেলিত। নৌকায় তাদের জীবন শুরু আবার নৌকাতেই জীবনাবসান। নৌকাতেই ছোট্ট সংসার পাতে তারা। মাথা গোজার ঠাঁই না থাকাই নৌকাতেই বসবাস করে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান সহ পরিবারের সবার বসবাস ওই নৌকাতেই। নদীকেন্দ্রীক তাদের এই জীবন ব্যবস্থা সত্যিই কষ্টকর। তাদের খাবার নেই, নেই নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা। নেই শৌচাগার। অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করছেন। এ পেশায় এখান টিকে থাকা দায়। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার থেকে তাদের জীবনযাপন রীতি ভিন্ন বিধায় সমাজের মূল স্রোতে তারা ফিরতে পারে না। ছেলেমেয়েরা অবহেলায় বেড়ে উঠেছে।
জাত প্রথার মাধ্যমে বেদেদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করা, নারী ও পুরুষ সবাইকেই ন্যায় সাম্যের ভিত্তিতে মানুষ বলে বিবেচনা করা হয় না। তাদের জন্মগত ও সাম্প্রদায়িকতার বিবেচনায় বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের সন্তানেরাও। সমাজে টিকে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তা তাদের নেই। জীবনযাপনের অনগ্রসর এ সম্প্রদায়ের কষ্টের সূচনা প্রাচীন কাল থেকেই যা আধুনিক সমাজেও বহমান। বর্তমানে জাত প্রথা সমাজের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সবচেয়ে বড় বিষয় হিসেবে বিরাজ করছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশে জাত প্রথার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। আমাদের দেশের বেদেরা এই জাত প্রথার নির্মম শিকার।
আজও এই বেদেদের দৈনন্দিন জীবনচিত্র পুরোটাই ভিন্ন কারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তা তাদের নেই। ওরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। ওরা মানুষ হলেও যাযাবর বেদে বলে আখ্যায়িত। শিশুরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা তাদের মাথায় নেই। ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় এলেও একটু ভেবে আর ভাবার সময় হয়ে ওঠে না। দুবেলা দুমুঠো খাবার কীভাবে জোগাবে এই চিন্তায়ই তাদের ঘুম হয় না। খোলা আকাশের নিচে বিচিত্র রাত যাপন করে। কষ্ট ব্যথা হতাশা ওদের নিত্যসঙ্গী। সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, পশ্চাৎপদতা ও দুঃখ-কষ্ট কতটা প্রকট তা তাদের জীবন কাহিনী দেখেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবার অল্পতেই ওরা খুশি হয়। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাও যেন ওদের ভাগ্যে জুটছে না। আজ এখানে, কাল ওখানে জীবিকার কঠোর তাগিদে ওদের ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথায় নিয়ে প্রতিনিয়ত তারা সংগ্রাম করছে। কিন্তু তাদের কেউ দেখার নেই।
আরও পড়ুন: নকশি পাখা: সুতোয় গাঁথা স্বপ্ন যেন!
পরিশেষে বলা যায়, বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বতন্ত্র জীবনাচার ও নিজস্ব ঐতিহ্যের অধিকারী বেদে সম্প্রদায় এখন অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। সময়ের প্রয়োজনে পাল্টে যাচ্ছে জীবিকার ধরন, এমনকি জীবনবোধও। কিন্তু আজকের আধুনিক সমাজেও তারা অবহেলিত। নৌকায় ভাসমান তাদের জীবনগাঁথা। কষ্টে মোড়া এই জীবন থেকে একদিন এই সম্প্রদায় পরিত্রাণ পাবে। এজন্য সরকারি ও স্থানীয় নজরদারি খুবই জরুরি। সরকারের সহায়তা আর ভূমি পেলে তারা একটু মাথা গোজার ঠাঁই পাবে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবনমান ও জীবনযাপন একটু হলেও উন্নত হবে।