মঙ্গলপুর: জন-মানবশূন্য এক গ্রামের গল্পকথা!

গ্রাম বলতে বোঝায় জনবসতির একটি একক। মনুষ্য সম্প্রদায়ের ছোটো বসতি যেটি মূলত কৃষিভিত্তিক অঞ্চল। গ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ খুব সাধারণভাবে জীবন-যাপন করে থাকে। সাধারণত বড়ো শহর বা রাজধানী থেকে দূরে অবস্থিত হয় গ্রাম। গ্রামে লোকবসতি থাকবে, কোলাহল থাকবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু লোকশূন্য গ্রামও কিন্তু হয়। হ্যাঁ, শুনলে অবাক হবেন বাংলাদেশে এমন একটি গ্রাম আছে যে গ্রামে মানুষের লেশ মাত্র নেই৷ মানুষের অস্তিত্ব না থাকায় গ্রামটি পরিচিত হয়ে উঠেছে ভুতুড়ে গ্রাম হিসেবে। গ্রামটির নাম মঙ্গলপুর গ্রাম। মঙ্গলপুর গ্রাম নাম হলেও এ গ্রামে অমঙ্গলের বসতিতে পরিপূর্ণ। আশেপাশের লোকজন এই গ্রামের নাম শুনলেই এখনও আঁতকে ওঠেন। চলুন আজ জেনে নেই জন-মানবশূন্য মঙ্গলপুর গ্রামের গল্পকথা।
মঙ্গলপুর গ্রামের অবস্থান, নামকরণ ও ইতিহাস:
বাংলাদেশের ঝিনাইদাহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলা একটি গ্রাম হলো মঙ্গলপুর। কোটচাঁদপুর উপজেলা শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে এলাঙ্গী ইউনিয়নের ৬৬ নম্বর মৌজায় গ্রামটি অবস্থিত। এলাঙ্গী ইউনিয়নের ৬৬ নম্বর মৌজায় অবস্থিত গ্রামটির ২০৬টি খতিয়ানভুক্ত জমি রয়েছে। সরকারি নথিতেও এই গ্রামের অস্তিত্ব আছে। শুধু এই গ্রামে নেই কোনো মানুষের কোলাহল, পুরো গ্রামটিই জনশূন্য।
ধারণা করা হয় যে, এই গ্রামটি প্রায় ১০০ বছরের পুরাতন। আবার অনেকেই বলেন ১৫০-২০০ বছরের আগের গ্রাম মঙ্গলপুর। অনেকেই বলে থাকেন, এই মঙ্গলপুর গ্রামে পাঠান নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর নাম ছিল মঙ্গল পাঠান। অনেকেই ধারণা করেন মূলত তাঁর নামেই গ্রামটির নামকরণ করা হয় মঙ্গলপুর। আবার অনেকের ধারণা এই মঙ্গলপুর গ্রামে মঙ্গলীয়ানরা একসময় বসবাস করতেন। সেখান থেকেই মঙ্গলপুর গ্রামের উদ্ভব। তবে অধিকাংশ স্থানীয়দের মতে, মঙ্গল পাঠানের নামানুসারে এসেছে মঙ্গলপুর গ্রামের নাম।
মঙ্গল পাঠানের সময়কালে তিন একর জমির ওপর বিশাল বাড়ি ছিল তাঁর। বাড়ির চতুরদিকে ছিল উঁচু করে ৩০ থেকে ৪০ ইঞ্চি চওড়া মাটির প্রাচীর। শোনা যায়, এর পাশে পুকুরের উঁচু পারে দাঁড়িয়ে নাকি বাড়ির ভেতরের কাউকে দেখা যেত না। কারণ এই পরিবার ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। বাড়ির বউ-মেয়েদের কখনোই বাইরের পুরুষদের সাথে দেখা করতে দেওয়া হতো না। এই মঙ্গল পাঠান এই গ্রামেই মারা যান। তাঁর সমাধিও এই গ্রামেই রয়েছে। এই গ্রামে একসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস ছিল। এখানে ১২ জাতির বাস ছিল। এ গ্রামটিতে ১২ জাতির বাস বলতে বোঝানো হয়েছে সকল প্রকার সম্প্রদায় যেমন-ডোম, কাপালী, জেলে প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের বাস। অনেকেই বলে অত্যাচারিত হয়ে ওই গ্রামের মানুষ গ্রাম ছেড়েছেন। তবে কোলাহলমুখর এক সময়ের এই গ্রামটি ঠিক কী কারণে মানবশূন্য হয়ে পড়েছে তা সঠিক জানা নেই কারও।
আবার শোনা যায়, গ্রামটি জনশূন্য হওয়ার প্রধান কারণ ছিল গুটি বসন্ত। একসময় কলেরা, গুটিবসন্ত ওই গ্রামটিতে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ ওই কলেরা, গুটিবসন্তেই মারা যায়। এই মৃতদের মধ্যে আবার শিশুদের সংখ্যাই ছিল বেশি। গ্রামে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক্তার, কবিরাজ, ওঝা নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক-তুঁকতাক করাসহ গ্রাম বন্ধ দিয়েও রোগ নিয়ন্ত্রণে আসেনি তখন। বাধ্য হয়ে ভয়ে তখন মানুষ ওই গ্রাম ছাড়তে শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে মানুষজন ঘরবাড়ি ভেঙে যে যার মতো বসবাস শুরু করে, ভারতসহ দেশের সুবিধামতো জায়গায় গিয়ে। সেই থেকে ওই গ্রাম মানুষ শূন্য হতে শুরু করে।
একসময়ের জনবহুল গ্রামটি হঠাৎ করেই জনশূন্য হয়ে পড়ে। ফসলী জমি, লোকজন, ফসল, পুকুর, ক্ষেত সবই ছিল এই মঙ্গলপুর গ্রামে। অনেকের গোলা ভরা ধান ছিল, গোয়ালে গোরু ছিল এই গ্রামে। তবে অনেক বছর হয়ে গেল সেখানে মানুষের বসতি হয়নি এই আর। শুধু কালের অভিশাপে সব হারিয়ে এখন জনশূন্য আর নিঃস্ব এই মঙ্গলপুর গ্রামটি। হঠাৎ করেই যেন অমঙ্গল ভর করেছে গ্রামটিতে। মঙ্গলের মঙ্গলবার্তা যেন আর বয়ে আসে না এক সময়ের কোলাহলপূর্ণ গ্রামটিতে। কালের বিবর্তনে যা লোকশ্রুতিমূলক অজানা কারণেই জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। প্রায় দেড়’শ-দুইশত বছর আগে এই মঙ্গলপুর গ্রাম পর্যন্ত ১৮ ফুট চওড়া মাটির রাস্তা ছিল এবং এই রাস্তায় চলাফের করত গ্রামের মানুষজন। পুকুরে গোসল করত, দরগায় মানত করত তারা, এছাড়া ওই গ্রামের রাস্তার পাশেই মসজিদের নমুনা পাওয়া যায়। গ্রাম জুড়ে অনেক ঘর বাড়ি ছিল আর মানুষের বসবাস ছিল। কিন্তু এখন বিশ্বাস করাই আসলে কঠিন যে এটি ছিল জনবসতিপূর্ণ গ্রাম।
#আরও পড়ুন: বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্যবাহী ঈদ পালনের ভিন্ন রীতিনীতি
এই গ্রামের সর্বশেষ অধিবাসী ছিলেন হাজরা ঠাকুর। বলাই বাহুল্য তার পরিবার সম্পূর্ণ গ্রামে একাই বাস করতেন। এক রাতে তিনি রহস্যজনক ভাবে খুন হন! এরপর থেকেই এই গ্রাম মানুষহীন! নিপিন ঠাকুররা ৪-৫ ঘর মানুষ ছিল। তবে আজ থেকে ৮০-৮৫ বছর আগে তারাও ঘরবাড়ি ভেঙে অন্যত্র চলে যায়। পরবর্তীতে এরা হয়তো মাঠের মধ্যে থাকা নিরাপদ বোধ করেনি, সে কারণে চলে গেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় আগে যারা গেছে তারা আসলে কী কারণে চলে গেছে এ সম্পর্কে তেমন কিছু তথ্য জানা যায়নি। মঙ্গলপুর গ্রামের অধিবাসীদের জমি-জমা সব পরবর্তীতে এ গ্রামের বসতিদের উত্তরসূরিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করে গেছে আবার অনেকেই সব ফেলে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। স্থানীয় লোকজন এখন যারা ওই গ্রামের আশেপাশে বসবাস করেন তারা কেউ এই গ্রামকে জনবহুল দেখেননি। তারা তাদের পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে শুধু শুনেছেন মঙ্গলপুর গ্রামের বিষয়ে। কিন্তু লোকশ্রুতি ছাড়া এ গ্রাম নিয়ে যথাযথ কোনো প্রকার স্পষ্ট তথ্য নেই।
মঙ্গলপুর গ্রাম নিয়ে প্রচলিত মিথ:
মঙ্গলপুর গ্রামটি নিয়ে অনেক ধরনের মিথ প্রচলিত রয়েছে। জনবহুল এই গ্রামটি জনশূন্য হবার কারণ হিসেবে দেখানো হয় অমঙ্গল বা ভয়ের বিষয়টি। এখনো এই গ্রামে ভয়ে কেউ একা আসতে চায় না। গা ঝমঝম করা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এখানে। সন্ধ্যা পর কেউ একা আসেন না এই গ্রামে। তবে দিনের বেলায় কৃষকরা আসেন তাদের কাজ করতে তবে সন্ধ্যা হবার আগেই তারা বাড়িতে ফিরে যান। আশেপাশের গ্রামের মানুষদের কাছেও গ্রামটি নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই৷ অনেকেই শুনেছেন, এই গ্রামে জিন-পরির আছর ছিল। লোকশ্রুতিতে আছে, রাতে পঙ্খীরাজ ঘোড়া বা গলা কাটা ঘোড়া দেখেছেন। এই ঘোড়া নাকি মানুষের গলা কাটে। অনেকে জ্বীন-ভূত দেখেছেন। আবার লোকশ্রুতি আছে গ্রামের পুকুরে জিন-পরিরা রাতে গোসল করতেন। জিন-পরির বসবাসের কারণেই নাকি এ-গ্রামে মানুষ বাস করতে পারেন না বলে জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। তবে এযুগে এসেও এ গ্রাম নিয়ে মানুষের ভীতি এতটুকুও কমেনি বা বিশ্বাসও আগের মতোই আছে।
বর্তমানে ওই গ্রামের অবস্থা:
বর্তমানে মঙ্গলপুর গ্রামে শুধুমাত্র কৃষকরা যান তাদের কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে। জনবসতি না থাকলেও এ গ্রাম জুড়ে রয়েছে ধান, মুশুরি, ইক্ষু, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলাদি আর ফলজ বাগান। রয়েছে বেশ কয়েকটি বসতভিটার ধ্বংসাবশেষ, এখনও গ্রামের অনেক জায়গাতে দেড়-দুইশত বছরের পুরাতন ইট ও ইটের টুকরার খণ্ডাংশ পাওয়া যায়, যা দেখে অনুমান করা যায় গ্রামটি কত পুরাতন। আবার মঙ্গলপুর গ্রামে রয়েছে পুকুর এবং পুকুর ভরা মাছ। তবে ব্যক্তি মালিকানার ভিত্তিতে গ্রামের সেখানে যাদের জমি ও পুকুর আছে, তারা এখানে দিনের বেলায় গিয়ে চাষ করেন। তবে গ্রামটিতে কয়েকজন একসঙ্গে মিলে চাষের কাজে যান কৃষকরা। এখন পর্যন্ত একা একা কেউ মঙ্গলপুর গ্রামে ঢোকার সাহসটুকু পান না। বর্তমানে গ্রামের রাস্তাটি হেরিং করা। গ্রামে প্রবেশের রাস্তাটি এখন শুধুমাত্র মঙ্গলপুর গ্রামের মাঠের ফসলাদি আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার হয়। ওই গ্রামের রাস্তার পাশেই মসজিদের নমুনা পাওয়া যায়। সেখানে মাঠে কর্মরত কৃষকেরা নামাজ আদায় করেন। যে কারণে সেখানে পানির ব্যবস্থার জন্য টিউবওয়েল বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া গ্রামে একটি দরগাহ আছে। এই দরগায় আশেপাশের অনেকেই মানত করে। এই দরগায় যে যা মানত করে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। বিশেষ করে সন্তানহীন নারীরা এ দরগায় মানত করে সন্তান লাভ করে থাকেন।
তবে মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে মঙ্গলপুর গ্রামের এক অংশে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে গ্রামের মানুষের জন্য গ্রামটিতে নির্মাণ করা হয়েছে সাতটি ভূমিহীন পরিবারের জন্য ঘর। রাস্তার পাশেই ওই গ্রামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে ভূমিহীন পরিবারের সদস্যরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বর্তমানে মঙ্গলপুর গ্রামের জমিতে অবাধে অনেকে চাষবাস করছেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা জমি দখল করছেন। কারণ অনেকেরই জমিজমার সুনির্দিষ্ট কোনো দলিলপত্র বা কাগজপত্র নেই। শুধু পূর্ব বংশের জেরেই তারা জমি পেয়েছেন ও চাষাবাদ করছেন। ফলে বেহাত ও বেদখল হয়ে যাচ্ছে এই গ্রামের জমিজমা।

#আরও পড়ুন: গোরু-ছাগলের হাট : আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে!
পরিশেষে বলা যায় যে, মঙ্গলপুর গ্রাম নিয়ে একটি ভৌতিক রহস্যেরর সৃষ্টি হয়েছে, যা এখনো চলে আসছে। গ্রামটির জনশূন্যতায় মূলত গা ঝমঝমে ও ভৌতিক বিষয়টি নির্দেষ করে। একসময় এ গ্রামে জনমানব থাকলেও কালের বিবর্তনে ও কোনো কারণে এখন আর মানুষের বসবাস নেই এই গ্রামে। তবে ঠিক কী কারণে জন-মাবনশূন্য হলো গ্রামটি তা আদৌ জানা যায়নি। তবে সুজলা-সুফলা এই মঙ্গলপুর গ্রামটি আবার মঙ্গলময় হোক। ভরে উঠুক জনমানুষে, লোকে লোকারণ্য হোক। আমরা এই আশায় ব্যক্ত করি।