মধুপল্লী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর সাগরদাঁড়ি গ্রামের বাড়ি!
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের যে বাড়িটিতে জন্মেছিলেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সেই বাড়িটিই এখন মধুপল্লী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর মধুপল্লী তে ঘুরে এলাম সাগরদাঁড়ি গ্রামে গিয়ে। যেকোনো জায়গায় ভ্রমণে যাওয়ার আগে আমার খানিক পড়াশোনা না করে গেলে, আমার ভ্রমণ পরিপূর্ণ হয় না। ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে যা জানলাম, তার কিছু অংশ আপনাদেরও গল্পে গল্পে শোনাই।
মধুপল্লী এর ইতিহাস
সতেরো শতকে এখনকার খুলনা শহরটি ছিল যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত। রাম কিশোর দত্ত সেই যশোর জেলার অধিবাসী। তার মৃত্যুর পর তিন ছেলে রামনিধি, দয়ারাম ও মাণিকরাম মাতামহের গ্রাম সাগরদাঁড়িতে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। তবে সাগরদাঁড়িতে এসেও রামনিধি তার অবস্থার তেমন উন্নতি করতে পারেননি।
কায়স্ত পরিবার হিসেবে সেকালের রেওয়াজ অনুযায়ী সন্তানদের ফারসি ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন। ফলে জ্যেষ্ঠপুত্র রাধামোহন আদালতের ভাষা ফারসি জানার সুবাদে যশোর আদালতে চাকরি পান এবং ধীরে ধীরে সেরেস্তার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ছোটো তিন ভাইকে যশোর এনে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন।
পড়াশোনা শিখে মেঝো ভাই মদনমোহন হন মুন্সেফ, সেঝ ভাই হন যশোরের উকিল এবং ছোটোভাই রাজ নারায়ণ দত্ত কোলকাতার সদর আদালতে উকিল হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন। এক পুরুষের মধ্যে দৈন্যদশা কাটিয়ে এই দত্ত পরিবার নিজেদের বিদ্যা এবং উদ্যোগকে ব্যবহার করে সেকালের তুলনায় প্রচুর বিত্ত উপার্জন করতে সক্ষম হন। আর সেই বিত্ত দিয়ে জমিদারি কিনে আবার দ্রুত বাবুতে পরিণত হন।
জমিদার রাজ নারায়ণ বিয়ে করেছিলেন কাঠিপাড়ার জমিদার কন্যা জাহৃবী দেবীকে। তাদের একমাত্র পুত্রসন্তানই ছিলেন মধুসূদন দত্ত। যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের যে বাড়িটিতে জন্মেছিলেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সেই বাড়িটিই এখন মধুপল্লী।
#আরও পড়ুন: চাঁচড়া শিব মন্দির : রাজা মনোহর রায়ের জমিদারির প্রতীক!
মধুপল্লী যেতে যেতে
যশোরের গদখালীর ফুলের রাজ্য ঘুরে মধুপল্লী যখন যাচ্ছি, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। কপোতাক্ষ নদ পার হতে হতে দেখি, নদের পাড়েই খুব চমৎকার ছোটো একটা মন্দির। তাড়া থাকায়, কাছে গিয়ে আর দেখা হয়নি।
সাগরদাঁড়ি গ্রামে যেতে যেতে ঝুম বৃষ্টির নামল। মধুপল্লীর রাস্তার মুখেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি প্রমাণ আকৃতির আবক্ষ মূর্তি ঠায় দাঁড়িয়ে।
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই টিকিট কেটে ঢুকলাম মধুপল্লীতে৷ কয়েকটি প্রাচীন স্থাপনা আর কবির স্মৃতিতে সমৃদ্ধ মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি। কুটিরের আদলে তৈরি প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় মধুপল্লীতে। সামনেই কবির আরোও একটি আবক্ষ মূর্তি। এটি গড়েছেন শিল্পী বিমানেশ চন্দ্র। ভেতরে কবির বসতবাড়ি, সেটিকে এখন জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে৷
মধুসূদনের পরিবারের ব্যবহার্য কিছু আসবাবপত্র আর নানান স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে এ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মধুসূদন জাদুঘর।মাত্র কদিন আগেই সুনীলের সেই সময় পড়ে শেষ করেছি। তার পর পরই মহাকবির বাড়ি ও জাদুঘর দেখার সুযোগ হওয়ায় সেই ইতিহাস যেন জ্যান্ত হয়ে ধরা দিলো আমার চোখে৷
কবির বন্ধুপ্রবরদের ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, এরা আমার কতদিনের পরিচিত! কবির পৈত্রিক কাছারিভবনটিকে এখন মধুপল্লী পাঠাগারে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে মাইকেল মধুসূদনের লেখা শর্মিষ্ঠা, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো, পদ্মাবর্তী, কৃষ্ণ কুমারী ইত্যাদি নাটক ও প্রহসন লেখা বইগুলো ছিল। তিলোওমা সম্ভব কাব্য, ব্রজাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা কাব্য, মেঘনাদ বধ মহাকাব্য ইত্যাদিও ছিল। এসব নাটক, প্রহসন আর মহাকাব্যগুলোর প্রেক্ষাপট জানতাম বলেই বইগুলো আলাদা এক আবেদন নিয়ে ধরা দিয়েছিল আমার চোখে। উত্তেজিত ভঙ্গীতে বইগুলোর প্রেক্ষাপট শুনেই শিহান নেড়েচেড়ে দেখতে চাইলো। তখন লাইব্রেরিয়ান জানালেন, যে কেউই এখানে বই এই পাঠাগারের বই পড়তে পারবে। আর কোনো কথা না বলে শিহান বই নিয়ে বসে পড়ল, আর আমি চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।
মধুপল্লীর চারপাশ প্রাচীরে ঘেরা। বাড়ির পশ্চিম পাশে আছে দিঘি। দিঘির ঘাটে কবি স্নান করতেন। দিঘির ঘাটটি শান বাঁধানো। কাছারি ভবনের পিছনেই কবির কাকার বাড়ি। কাছারি ভবনটি সহ এই অংশটি একটি চতুষ্ক বাড়ির মতো।
জাদুঘরের ভেতরের দিকেও কবির কাকার বাড়ির আরেকটি ভবন আছে, যেখানে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার নেই। জাদুঘরের ঠিক পাশেই দত্ত পরিবারের পারিবারিক পূজা মন্দির রয়েছে। মন্দিরে এখনো প্রতিষ্ঠিত আছে দেবী দুর্গার বিগ্রহ।
ঘুরে দেখতে দেখতে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া দিলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনগাঁথা। ১৮৩০ সালে সাগরদাঁড়ি ছেড়ে কলকাতার খিদিরপুর চলে যান মধুসূদন। তারপর মাদ্রাজে রেবেকা টমসন মেক্টাভিস নামের এক ইংরেজকে বিয়ে করেন। রেবেকার গর্ভে দুটি কন্যা ও দুটি পুত্র জন্ম গ্রহণ করে।
শেষ পুত্রটি এক বছরের মাথায় মারা গিয়েছিল। রেবেকা ১৮৯২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাইকেলের ৩টি সন্তান আগলে রেখে মানুষ করেছিলেন। মাইকেল ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ থেকে কোলকাতায় ফিরে আসার পর এদের আর কোনো খোঁজ নেননি নির্দয়ের মতো।
কবির সহকর্মী এ্যান রিয়েটা বা হেনরিয়েটা হেনরিয়েটার সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। মাইকেল কোলকাতায় আসার বছর দুয়েক পরই হেনরিয়েটা মাদ্রাজ থেকে কোলকাতায় গিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাথে একত্রে বসবাস করতে থাকেন। অধিকাংশ জীবনীকারদের মতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক সাথে জীবন যাপন করলেও তাদের আইন সিদ্ধ বিয়ে হয়নি।
#আরও পড়ুন: এগারো শিব মন্দির : রাজা নীলকণ্ঠ রায়ের স্মৃতি বিজড়িত মন্দির!
হেনরিয়েটার গর্ভেও কবির চারটি সন্তান জন্ম নেয়।
পোশাকে আশাকে, চলনে বলনে, খাদ্যাভ্যাসে মাইকেল ছিলেন প্রথা ভঙ্গকারী। তিনি অবলীলায় গোমাংস খেতেন। ইংল্যান্ডে যাবার প্রবল ইচ্ছে, হিন্দু ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা, কমবয়সী অপরিচিত এক বালিকার সাথে বিয়ের সম্পর্ক এড়ানোর জন্য খ্রিস্ট ধর্মে গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
হিন্দুত্ব না থাকায় হিন্দু কলেজের দ্বার বন্ধ হয়ে যায় তার জন্য। ভর্তি হন শিবপুর বিশপস কলেজে। ১৮৪৮ সালে তার বাবা পড়ার খরচ বন্ধ করে দেন। তারপর বিভিন্ন কারণে কোলকাতা ছেড়ে সকলের অগোচরে কবি পাড়ি জমান মাদ্রাজে।
মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে একবার কবি স্ত্রী-পুত্র কন্যাকে নিয়ে নদী পথে বজরায় করে বেড়াতে আসেন সাগরদাঁড়িতে। জানা যায় ১৮৬২ সালে কবি যখন সপরিবারে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন তখন ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে জ্ঞাতিরা তাঁকে বাড়িতে উঠতে দেয়নি। তিনি কপোতাক্ষ নদের তীরে একটি কাঠবাদাম গাছের তলায় তাঁবু খাটিয়ে ১৪ দিন অবস্থান করেন। বিফল মনে কপোতাক্ষের তীর ধরে হেঁটে বিদায়ঘাট হতে কলকাতার উদ্দেশ্যে বজরায় উঠেছিলেন।
এর পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। কিন্তু সুনীলের সেই সময়ে এই ঘটনার বিপরীত বর্ণনা দেওয়া আছে। বুঝতে পারছি না, কোন বর্ণনাটি সঠিক।
কপোতাক্ষ নদের তীরে কবির স্মৃতি বিজড়িত সেই কাঠবাদাম গাছের গোড়া শান বাঁধানো। বয়সের ভারে মৃতপ্রায় কাঠবাদাম গাছ ও বিদায় ঘাট ইতিহাসপ্রিয় দর্শনার্থীরা আগ্রহ নিয়ে দেখতে যায়। এখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় কপোতাক্ষ নদের সৌন্দর্য।
সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে। আমরাও পা বাড়িয়েছি মধুপল্লী থেকে বের হবার জন্য। তখন কে যেন ফিসফিসিয়ে আবৃতি করে উঠল নিজের সমাধিলিপির জন্য কবির লেখা কবিতাটি,
‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’
মধুপল্লী যাবার সময়সূচি
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর— প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং অক্টোবর থেকে মার্চ— প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে মধুপল্লী। শুক্রবার সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত বিরতি। মধুপল্লীর সাপ্তাহিক ছুটি রোববার। এছাড়া অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে বন্ধ থাকে।
#আরও পড়ুন: নাপিত্তাছড়া’র বহমান ধারায় অবগাহন!
প্রবেশ মূল্য
দেশি পর্যটক ১৫ টাকা, বিদেশি ১০০ টাকা। এছাড়া পার্কিং মূল্য বাস ১০০ টাকা, মাইক্রেবাস, জীপ, গাড়ি ৫০ টাকা। মোটর সাইকেল ১০ টাকা। এছাড়াও ভ্যাট ১৫% দিতে হয়।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যশোর যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর, কলাবাগান থেকে গ্রিন লাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, ঈগল পরিবহন, শ্যামলী পরিবহনের এসি বাস যশোর যায়। ভাড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। এ ছাড়া হানিফ, শ্যামলী, সোহাগ, ঈগল ইত্যাদি পরিবহনের নন-এসি বাসও যশোর যায়। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।
ঢাকার কমলাপুর থেকে সপ্তাহের শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৬টা ২০ মিনিটে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেস যশোরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া শোভন ৩৫০ টাকা, শোভন চেয়ার ৪২০ টাকা। প্রথম শ্রেণি চেয়ার ৫৬০ টাকা। প্রথম শ্রেণি বার্থ ৮৪০ টাকা। স্নিগ্ধা শ্রেণি (এসি চেয়ার) ৭০০ টাকা। এসি বার্থ ১,২৬০ টাকা।
ঢাকা থেকে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, রিজেন্ট এয়ারলাইন্স ও নভো এয়ারের বিমান নিয়মিত যশোরের পথে চলাচল করে।
যশোর বাস টার্মিনাল থেকে বাসে আসতে হবে কেশবপুর। ভাড়া ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কুমিরা কদমতলা বাসস্ট্যান্ড কিংবা বগা মোড় নামতে হবে। বগা মোড় থেকে অটোয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত যাদুঘর। ভাড়া আনুমানিক প্রতিজনে ৪০ টাকা। অটো সরাসরি না গেলে ভেঙে ভেঙে যেতে হবে।
যেখানে থাকবেন
সাগরদাঁড়িতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের একটি মোটেল আছে। ভাড়া ৬শ’ থেকে ১২শ’ টাকা।
প্রকৃতি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব উপহার। সেই সাথে আমাদের সম্পদ। আমাদের টুরিস্ট স্পটগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। পাহাড়ে গেলে অপচনশীল আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে এসে প্রকৃতিস্থ সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না। আসুন, ঘোরাঘুরির সাথে সাথে দর্শনীয় স্থানগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে সুরুচির পরিচয় দিই। কারণ, মন সুন্দর যার, সেই তো দেশ পরিষ্কার রাখে।