সালমান শাহ: বাংলার চিরসবুজ নায়ক!

আজ বাংলা চলচ্চিত্রের বরপুত্র সালমান শাহ’র প্রয়ান দিবস। আজকের এই দিনে ২৬ বছর আগে এই পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন জনপ্রিয় এই নায়ক। শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন ওরফে সালমান শাহ নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত নাম। মহান এই নায়কের আকস্মিক মৃত্যুতে থমকে যায় পুরো চলচ্চিত্র প্রাঙ্গণ। সেই সাথে শোকে ও বিস্ময়ে মুহ্যমান হয়ে পড়ে তার লাখো ভক্ত ও অনুরাগীরা। লাখো ভক্তকে কাঁদিয়ে ১৯৯৬ সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ ৬ সেপ্টেম্বর চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হন তিনি। আর রেখে যান অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগীর ভালোবাসা।
সিনেমা জগতে তার বিচরণের সময়কাল ছিল মাত্র তিন বছর। এই তিন বছরের ক্যারিয়ার জীবনে তিনি ছিলেন সবসময় দখল করেছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান। এমনকি মৃত্যুর ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও বিন্দুমাত্র কমেনি তার জনপ্রিয়তা বরং উত্তোরোত্তর তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। তার মৃত্যুটি যেমন ছিল আকস্মিক তেমন রহস্যজনক। মৃত্যুর ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও জানা সম্ভব হয়নি তার মৃত্যু পেছনের আসল কারণ। তিনি কি আত্মহনন করেছিলেন নাকি ঘটেছিল হত্যাকাণ্ড? তা নিয়ে এখনো মানুষের মনে সন্দেহ রয়েই গেছে।
ফিরে দেখা..
বাংলার স্টাইল আইকন ও চিরসবুজ নায়ক সালমান শাহর জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরে তার নানাবাড়িতে। তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গণে সালমান শাহ নামে পরিচিতি লাভ করলেও তার আসল নাম ছিল শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। সিলেটে জন্মগ্রহণ করলেও তার শৈশব কেটেছিল খুলনাতে, তার বাবার চাকরিসূত্রে। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন খুলনার বয়রা মডেল হাইস্কুলে পরবর্তীতে সালমান শাহ’র পরিবার খুলনা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে সালমান শাহ তার স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন ঢাকার আরব মিশন স্কুল থেকে। সালমান শাহ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯২ সালে। তিনি তার খালার বান্ধবীর মেয়েকে বিয়ে করেন। যার নাম সামিরা। সামির একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। সালমান শাহ’র দুটো সিনেমায় ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন সামিরা। সেখান থেকেই তার সাথে পরিচয়, তারপর বিয়ে। যদিও অনেকে ধারণা করেন এই বিয়েই তার জীবনে কাল হয়েছিল। সালমান শাহ’র মৃত্যু রহস্যের কূলকিনারা আজও হয়নি। আজও তা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
আরও পড়ুন# কর্মক্ষেত্রে মতবিরোধ কীভাবে কমাবেন?
সালমান শাহ’র অভিনয় জীবন
সুদর্শন ও চিরসবুজ এই ক্ষণজন্মা নায়ক তার তিন বছরের ক্যারিয়ার জীবনে মোট ২৭ টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘কিয়ামত থেকে কিয়ামত’। এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯০ সালে। কিন্তু সালমান শাহ’র অভিনয়জীবন শুরু হয়েছিলো তারও বেশ আগে থেকেই। ১৯৮৫ সালে তার অভিনয় করা প্রথম নাটক প্রচার হয় বিটিভিতে। ১৯৮৫ সাল থেকেই তিনি অভিনয় করতেন তবে নিয়মিত ছিলেন না। পাশাপাশি মডেলিং করতেন এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছিলেন। এরপর বিখ্যাত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের নজরে পড়েন সালমান শাহ। সেই সময় সোহানুর রহমান সোহান বলিউডের সাড়া জাগানো সিনেমা ‘কিয়ামত তক কিয়ামত’- এর বাংলা রিমেক ‘কিয়ামত থেকে কিয়ামত’ করার কথা ভাবছিলেন। আর এই সিনেমার নায়ক নায়িকার জন্য খুঁজছিলেন নতুন মুখ। তখনই সালমানকে নায়ক হিসেবে তার মনে ধরে যায়। এই সিনেমায় নায়িকা হিসেবে তিনি পছন্দ করেন মৌসুমিকে। মৌসুমিরও এটি প্রথম সিনেমা ছিল। ব্যাস এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সালমান শাহকে। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করে প্রিয় নায়ক হিসেবে বাংলার দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন তিনি। এরপর তিন বছরে একে একে ২৭ টি সিনেমা উপহার দেন দর্শককে। যার সবগুলোই হয়েছিল দর্শকনন্দিত। তার স্টাইল, তার ফ্যাশন সবকিছুই ছিল সময়ের থেকে এগিয়ে, সাথে সুদর্শন চেহারা ও অভিনয় দিয়ে তিনি মুহুর্তেই হয়ে যান কালজয়ী। ‘তিনি আসলেন, জয় করলেন, চলে গেলেন’ বিখ্যাত এই প্রবাদবাক্যটি যেন তার জন্যই তৈরি হয়েছিল।
সালমান শাহ অভিনীত সিনেমা ও নাটক
তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ছিল মৌসুমির বিপরীতে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। যা তুমুল জনপ্রিয় হয়। তিনি মোট ২৭ টি সিনেমায় অভিনয় করেন। এরপর মৌসুমীর বিপরীতে তিনি আরও ৩ টি সিনেমায় অভিনয় করেন। সেগুলো হলো, অন্তরে অন্তরে (১৯৯৪), স্নেহ (১৯৯৪), দেনমোহর (১৯৯৫)।
তার করা দ্বিতীয় সিনেমার নাম ‘তুমি আমার’। এই সিনেমায় প্রথম শাবনুরের সঙ্গে জুটি বেধে অভিনয় করেন সালমান শাহ। এরপর শাবনুরের সাথে একে একে মোট ১৪ টি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। সিনেমাগুলি হলো সুজন সখি (১৯৯৪), বিক্ষোভ (১৯৯৪), স্বপ্নের ঠিকানা (১৯৯৪), মহামিলন (১৯৯৫), বিচার হবে (১৯৯৬), তোমাকে চাই (১৯৯৬), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬), জীবন সংসার (১৯৯৬), চাওয়া থেকে পাওয়া (১৯৯৬), প্রেম পিয়াসী (১৯৯৭), স্বপ্নের নায়ক (১৯৯৭), আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭), বুকের ভিতর আগুন (১৯৯৭) ইত্যাদি। তাদের সবগুলো সিনেমা ব্যবসাসফল হয়েছিল।
আরও পড়ুন# কেন অ্যাপলের লোগো অর্ধেক খাওয়া?
সালমান শাহ মৃত্যুর আগে ‘মন মানে না’ সিনেমার ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করে গিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর সিনেমার বাকি অংশের কাজ চিত্রনায়ক রিয়াজকে দিয়ে করানো হয়েছিল। এছাড়াও ‘কে অপরাধী’, ‘তুমি শুধু তুমি’, ‘প্রেমের বাজি’ সহ আরও বেশ কয়েকটি সিনেমা তিনি অর্ধেক শুটিং করতে পেরেছিলেন মৃত্যুর আগে। তার মৃত্যুর পর ‘প্রেমের বাজি’ ছাড়া অন্যান্য সিনেমাগুলো ভিন্ন নায়কদের দিয়ে আবার শুরু থেকে শ্যুটিং করানো হয়। তবে সালমান শাহ’র অসমাপ্ত সিনেমা বাকিগুলোর কাজ কোনোভাবে শেষ হলেও একমাত্র ‘প্রেমের বাজি’ সিনেমার কাজ আর শেষ করা হয়নি পরবর্তীতে।
তার অভিনিত নাটকগুলো হলো-
আকাশ ছোঁয়া (১৯৮৫)
সৈকতে সারস (১৯৮৮)
পাথর সময় (১৯৯০)
ইতিকথা (১৯৯৪)
দোয়েল (১৯৯৪)
সব পাখি ঘরে ফেরে (১৯৯৫)
নয়ন (১৯৯৫)
স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬)
স্টাইল আইকন সালমান শাহ
সালমান শাহকে বলা হতো স্টাইল আইকন। তিনি স্টাইল ও ফ্যাশনসেন্সে ছিলেন সময়ের থেকে কয়েক যুগ এগিয়ে। এখনকার মতো সে সময়ও স্টাইলে বাংলাদেশের তরুণরা বলিউডের নায়কদের ফলো করত। কারও মধ্যে ছিলনা নিজস্বতা বা নতুনত্ব। সেই সময় সালমান শাহ অন্য কাউকে অনুকরণ না করে তার নিজস্ব স্টাইল বাজারে আনেন। তার স্টাইল সেসময়ে সবচেয়ে নতুন এবং ভিন্ন থাকত। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এখনো অনেকেই ফ্যাশনের জন্য সালমান শাহ’র থেকে অনুপ্রাণিত হন। চিরসবুজ এই নায়কের স্টাইল ও ফ্যাশন যুগের পর যুগ অনুপ্রাণিত করেছে লাখো তরুণকে। ভিন্নরকম স্টাইল ও সাবলীল অভিনয়ের জন্য দ্রুতই তিনি মানুষের নজর কাড়তে সক্ষম হন। যার রেশ তার মৃত্যুর এতবছর পরও কমেনি।
রহস্যময় মৃত্যু
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষদের জন্য একটি শোকময় দিন। সেদিন পুরো বাংলাদেশ যেন মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল সালমান শাহ’র মৃত্যুর খবরে। জানা যায় তিনি গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় ইস্কাটনে, তার নিজ বাসভবন থেকে। সালমান শাহ’র স্ত্রী সামিরা দাবি করেছিলেন তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু সালমানের মা এই দাবিকে অগ্রাহ্য করে বলেছিলেন সালমানকে হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যাকান্ডের অভিযোগের আঙুল ছিল সালমানের স্ত্রী সামিরার দিকে। এমনকি পরবর্তীতে সালমান শাহ’র পরিবারের লোকজনের পক্ষ থেকে তার স্ত্রী সামিরা ও আরও কয়েকজনকে অপরাধী হিসেবে মামলা দায়ের করা হয়; কিন্তু পরে এই মামলা নিয়ে পরে আর অগ্রগতি না হওয়ায় এখানেই থমকে যায় সালমান শাহ’র মৃত্যু নিয়ে তৈরি হওয়া রহস্যগুলোর।
বর্তমানে শাহজালালের মাজারের পাশে রয়েছে নায়ক সালমান শাহ’র কবর।
২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তদন্ত বিভাগ জানায় যে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু এখনো তার ভক্ত অনুরাগীরা এটাকে নিছক আত্মহত্যা বলে মানতে পারেন না।
এরপর বহু জলঘোলা হলেও মীমাংসিত হয়নি সালমান শাহ’র মৃত্যু রহস্য।
শরীরি মৃত্যু হলেও আজ ২৬ বছর পেরোনোর পরও তার ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের হৃদয়ে আজও বেঁচে আছেন প্রিয় নায়ক সালমান শাহ। আজও তার সিনেমা আগ্রহভরে দেখেন দর্শকরা। ভক্তদের হৃদয়েই তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন।