ইতিহাসফিচারবিখ্যাত জায়গাভ্রমণ

সুসং দুর্গাপুর : গোলাপী পাহাড়ি উপত্যকায় নীলাভ-সবুজরঙা হ্রদ!

প্রকৃতির কত রং, কত রূপ! গাঢ় নীল আকাশ আর গাছ গাছালির অপার সবুজের সাথে সবাই পরিচিত। কিন্তু এই চেনা পরিচিত পৃথিবীর বাইরে প্রকৃতি যখন নিজের লুক্কায়িত রূপ সাজিয়ে বসে, তার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না। মেটে রঙ ছাড়াও মাটির যে আরও কত রং থাকতে পারে, তা দেখার আগ্রহ জাগবে প্রকৃতিপ্রেমী যেকোনো মানুষের। কিন্তু এটুকুই সব নয়। সুসং দুর্গাপুর – নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের আড়াপাড়া গ্রামটি এককালে ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে।

সুসং দুর্গাপুর এর ইতিহাস

তখন এই এলাকায় বহিরাগতদের পা পড়ত না বললেই চলে। স্থানীয়দের বসতিও খুব বেশি ছিল না। এখানে ছিলো বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। স্থানীয় অধিবাসীরা বাজার কিংবা অন্য কাজে শহরে যেত মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে। তবে আরও বাষট্টি বছর আগে থেকে এদেশের উল্লেখযোগ্য সম্পদ বিজয়পুরের সাদামাটি বা হোয়াইট ক্লে। ১৯৫৭ সালে দুর্গাপুরে সর্বপ্রথম সাদা মাটির সন্ধান পাওয়া গেলে পরবর্তী বছরগুলোতে সরকারের খনিজ সম্পদ বিভাগ এ সাদামাটির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য ১৩টি কূপ খনন করে।

সুসং দুর্গাপুর
সুসং দুর্গাপুর এর চীনা মাটির পাহাড়

ফলে এই এলাকায় পাওয়া যায় নিয়মিত ও অনিয়মিত স্তরের সাদামাটি। বিজয়পুরের সাদামাটিই বাংলাদেশের চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করে চলেছে। বাংলাদেশের সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ এ মাটি ব্যবহারে তৈজসপত্র তৈরি করে। চীনে এ মাটির সর্বপ্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল বলে অনেকেই সাদামাটিকে চীনা মাটিও বলে থাকে।

সেই থেকেই মুখে মুখে এই এলাকার নাম হয়ে যায় বিজয়পুর সাদামাটি কিংবা চীনা মাটির পাহাড়। সাদামাটি বলা হলেও আদতে এর রং হালকা ধূসর থেকে সাদাটে রঙের। কোনো কোনো জায়গায় এছাড়াও আরও কয়েকটি রঙের সমন্বয় রয়েছে। কোথাও গোলাপী, কোথাও রংচটা লাল। তাই আবার জায়গাটিকে লাল কিংবা গোলাপী মাটির পাহাড় নামেও চেনে।

চীনা মাটির এই পাহাড়ের সন্ধান পাওয়ায় সরকার এখানে কোয়েরি করে। তখনই এই পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি হয় হ্রদ। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো হ্রদের পানি নীলাভ সবুজ। কেবল সবুজ নয়। বছরের কিছু বিশেষ সময়ে নাকি পানি নীল রঙেরও থাকে। বৃষ্টি না হলেই নাকি পানি নীল থাকে। এখন আর খুব বেশি নীলরঙা পানি দেখা না গেলেও একসময় গাঢ় নীলই দেখাতো এই হ্রদের পানি। এমনকি আগে লাল রঙা পানিও দেখা যেত।

সুসং দুর্গাপুর
গোলাপী পাহাড়

সুসং দুর্গাপুর কেন যাবেন?

হরেক রকম রঙের সমন্বয়ের কারণেই ভ্রমণপিয়াসু মানুষের কাছে এই জায়গাটি জনপ্রিয়তা পায়। গোলাপী সাদা রঙা পাহাড়, আর তার নিচে নীলাভ সবুজ জলাধার, ওপরে নীল আকাশ এক অপূর্ব মাধুর্যের অন্বয়সাধন করেছে এখানে প্রকৃতি।

অনেকেই জায়গাটিকে বিরিশিরি নামে চেনেন। কিন্তু সত্যি বলতে বিরিশিরি বলতে এখানে কোনো পর্যটন কেন্দ্র তো দূরে থাক, কোনো গ্রামের নামও নেই। এটি কেবল একটি বাসস্ট্যান্ডের নাম। স্থানীয়রা এই জায়গাটিকে সাদা মাটি, নীল পানি, চীনা মাটির পাহাড় নামেই চেনে।

খেয়া নৌকায় সোমেশ্বরী পেরিয়ে নদীর এপারেই পাওয়া যাবে হরেক রকমের যানবাহন। এই এলাকার সবগুলো জায়গা ঘোরার জন্য মোটর বাইক, রিকশা, অটো- রিজার্ভ করা যাবে। আবার ভেঙে ভেঙেও ঘোরাঘুরি করা যাবে। আমাদের হাতে যেহেতু সারাটাদিন সময় ছিল, তাই আমরা রিজার্ভ না নিয়ে লোকাল ট্রান্সপোর্টে চেপে সাদামাটির পাহাড়ে গিয়েছি।

সোমেশ্বরী নদী

অটো থেকে নেমেই সামনে সবুজ পাহাড় চোখে পড়ল। যেখানে অটো থাকে, সেখানে সাদামাটা দুটো দোকানঘর আর ডাবওয়ালা আছে। বেলা চড়ছে। সূর্যমামা নিজের সমস্ত তাপ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চরাচরে। পাহাড়ে ওঠার আগে তাই শক্তি সঞ্চয় করা চাই। ডাবওয়ালা মামাকে ডাব কেটে দিতে বললাম। গ্রামের ক্যামিকেল ছাড়া ডাব, খুবই মিষ্টি এর পানি। পানি পান করে ভেতরের শাঁসটুকুও খেয়ে পা বাড়ালাম পাহাড় অভিমুখে।

এরমধ্যেই আমাদের সাথে দুজন পিচ্চি এসে জুড়েছে। উদ্দেশ্য কী? জানা গেল, তারা টুরিস্ট গাইড। ওরে বাপরে! গাইড? এইটুকুন জায়গা ঘুরতে আবার গাইড লাগে? হাসতে হাসতে খানিকটা তাচ্ছিল্য নিয়েই কথা বললেও, তারা নিবৃত হলো না। আমাদের সাথে সাথেই চলতে লাগলো। আমরাও ভাবলাম, চলুক দুজন, ওদের সাথে নিয়েই ঘুরি!

সপ্তাহান্ত না হলেও পর্যটক নেহায়েত কম নয়। লাইন ধরে পাহাড়ে চড়ছে। আমাদের পিচকি গাইড পাশ্ববর্তী অন্য একটা পাহাড়ের চড়ার রাস্তা দেখিয়ে দিলো। এ পথে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। ওপরে উঠে আশেপাশের গ্রামকে চমৎকার দেখাচ্ছে। গাইডদ্বয় আঙ্গুল তুলে টিলার পাদদেশে একটা কালো মুখ দেখিয়ে জানালো, এটা মুক্তিযোদ্ধাদের গুহা। আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলাম, ওটার ভেতরে যাওয়া যায় কি না। গাইড জানালো, ভেতরে যাওয়া যায় না, মাটি ধ্বসে গুহা বন্ধ হয়ে গেছে।

#আরও পড়ুন: মধুপল্লী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর সাগরদাঁড়ি গ্রামের বাড়ি!

প্রচুর মানুষ থাকলেও আমরা আরামেই শান্তিপূর্ণভাবে পাহাড়ে উঠলাম। উপর থেকে গ্রামটা ভীষণ সুন্দর। কিন্তু চীনামাটির পাহাড় আর নীলরঙা হ্রদটা কই? ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে সামনে উপত্যকা আর ছোটো টিলা পেলাম। আর দূরে একচিলতে নীলচে সবুজ পানি। আমাদের পিচ্চি গাইড দেখিয়ে দিলো, কোন পথে যাওয়া উচিত। সেদিকে পা বাড়ালাম।

সুসং দুর্গাপুর
পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের সবুজ অবারিত প্রান্তর

কোনো কোনো স্থানে মসৃন, কোথাও খসখসে। কোথাও গাঢ় গোলাপী রঙা মাটি। কোথাও মাটির রং একটু ময়লা সাদা। শুকনো এ সাদা মাটি শক্ত ও ভঙ্গুর। বোঝাই যাচ্ছে ভেজালে আটালো ও নরম হয়ে যায়। বর্ষায় এলে এই পাহাড়ে চড়ে ঘুরে দেখতে হলে খুবই বিপদে পড়তে হবে।

ঢাল বেয়ে নিচে নেমে দেখি দূরেরটা ছাড়াও আরোও একটি হ্রদ আছে। এখানে হ্রদটি যে পাহাড়ের গায়ে শুয়ে আছে সেটিও গোলাপী ও সাদা রঙা। এই পানির রং নেই, মানে সাধারণ পানির রং। কিন্তু ঝকঝকা দিন আর নীল আকাশ থাকায় চমৎকার প্রতিফলন পড়ছে হ্রদের স্বচ্ছ জলে।

এই হ্রদটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়নি। চীনামাটির এই আকর থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে প্রাকৃতিক এই সম্পদ তোলার কারণেই তৈরি হয়েছে এটি। খননকার্যের কারণে এই হ্রদ বেশ গভীর, তাই এখানে গোসলে নামা নিষেধ। জায়গাটি বেশ বড়ো। পুরোটা ঘুরে ওপর থেকে দেখা সবুজরঙা পানির হ্রদের কাছে গেলাম।

এই হ্রদটি আরোও বেশি সুন্দর। এর পানির সবুজ রং গাছপালার প্রতিফলন কিংবা শ্যাওলার কারণে সবুজ হয়নি। প্রাকৃতিকভাবেই পানির রং এমন। তবে বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে এই পানি ঘোলা হয়ে যায়।

পাহার থেকে সোমেশ্বরী

এই পাহাড়টি শক্ত রঙিন শিলা দিয়ে তৈরি। বেশ রুক্ষ, তবুও খুব সুন্দর। হ্রদের সবুজ জলে সাদা চিনামাটির পাহাড়ের প্রতিবিম্ব যেন এক অলৌকিক সৌন্দর্য তৈরি করে। পুরো দৃশ্যটি এতো চমৎকার সুন্দর, দেখলে মনেই হয় না, এটা বাংলাদেশের কোনো জায়গা!

কীভাবে যাবেন?

ঢাকার মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সরাসরি দুর্গাপুর (Durgapur) যাওয়ার বাস ছাড়ে। এ পথে চলাচলকারী দু’একটি বাস সার্ভিস হলো সরকার, জিন্নাত ইত্যাদি। ভাড়া ২৫০-৩৫০ টাকা। ৫-৭ ঘন্টার মধ্যেই আপনি পৌঁছে যাবেন অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বিরিশিরিতে। বিরিশিরির বাস বলা হলেও এটি মূলত দুর্গাপুর পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে নৌকায় সোমেশ্বরী নদী পার হতে হবে। ওপার থেকে রিকশা, টেম্পু ,বাস বা মোটর সাইকেলে চীনামাটির পাহাড়ে যাওয়া যায়। রাস্তা আগে খারাপ থাকলেও এখন খুব ভালো। অটোয় করে প্রতিজন ৩০ টাকা ভাড়া।

ঢাকা ফেরার জন্য দুর্গাপুরের প্রাণকেন্দ্র তালুকদার প্লাজার সামনে থেকে রাত এগারটায় এবং সাড়ে এগারটায় দুটি নাইট কোচ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করে বাসে যেতে পারেন। ভোর পাঁচটার মধ্যেই মহাখালী পৌঁছে যাবেন।

#আরও পড়ুন: এগারো শিব মন্দির : রাজা নীলকণ্ঠ রায়ের স্মৃতি বিজড়িত মন্দির!

ট্রেনে যেতে হলে ঢাকা থেকে হাওড় এক্সপ্রেস রাত ১১.৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়। এই ট্রেনে ভোরের দিকে নামতে হবে শ্যামগঞ্জ ট্রেন স্টেশনে। ওখান থেকে বাস কিংবা সিএনজি করে দুর্গাপুর। ট্রেনে ময়মনসিংহ গিয়েও সেখান থেকে বাসে কিংবা সরাসরি সিএনজিতে করেও দুর্গাপুর যেতে পারবেন। ময়মনসিংহ থেকে বাসে গেলে প্রচুর সময় লাগবে। সিএনজিতে বড়োজোর দেড় ঘন্টা লাগে। সিএনজিতে দুর্গাপুর পর্যন্ত ভাড়া পড়বে ১৬০ টাকা।

চট্টগ্রাম থেকে কিছু সাধারন গাড়ি যায় যা অলংকার মোড় থেকে ছাড়ে। ভাড়া ৪৫০-৬০০টাকা নিবে (আর কমও নিতে পারে)

ঢাকা কাউন্টার: ০১৯১৭৭১০০০৮ (এরশাদ)

সুসং দুর্গাপুর কাউন্টার: ০১৭১১৬৬৯৭৭৪ (শিপার)

কোথায় থাকবেন

সুসং দুর্গাপুরে থাকার জন্য ভালো মানের বেশ কয়েকটি গেস্ট হাউস আছে। নিম্নে এদের নাম এবং যোগাযোগ করার নাম্বার দেওয়া হলো-

জেলা পরিষদ ডাক বাংলো: ০১৫৫৮৩৮০৩৮৩, ০১৭২৫৫৭১৭৯৫

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি গেস্ট হাউজ। ফোন: ০৯৫২৫-৫৬০৪২, মোবাইল: ০১৮১৫৪৮২০০৬

ইয়ুথমেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ-এর রেস্ট হাউস: ০১৮১৮৬১৩৪৯৬, ০১৭১৬২৭৭৬৩৭, ০১৭১৪৪১৮০৩৯, ০১৭৪৩৩০৬২৩০, ০১৯২৪৯৭৫৯৩৫, ০১৭২৭৮৩৩৩৩২। এখানকার রুম ভাড়া ৩০০-৫০০ টাকা।

YWCA গেষ্ট হাউজ: ০১৭১১০২৭৯০১। YWCA এর জন্য অমিতা সাংমা এর মোবাইল নাম্বার – ০১৭১২০৪২৯১৬। রুম ভাড়া পড়বে ৭৫০ টাকা (২ বেড) আর চাইলে VIP রুম এর ব্যাবস্থাও করতে পারেন। এদের বিরাট একটা হলরুম আছে যেখানে একসাথে ১৮ জন থাকতে পারবে, সেক্ষেত্রে পার বেডে খরচ পড়বে ২০০ টাকা করে। YWCA এর ছাদটা সবচাইতে সুন্দর, সেখান থেকে পূর্ণিমা দেখতে অসাধারণ লাগে।

#আরও পড়ুন: নাপিত্তাছড়া’র বহমান ধারায় অবগাহন!

এছাড়া দুর্গাপুরে আরও কিছু মধ্যম মানের হোটেল আছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –

স্বর্ণা গেস্ট হাউস (০১৭১২২৮৪৬৯৮),

হোটেল সুসং (০১৯১৪৭৯১২৫৪),

হোটেল গুলশান (০১৭১১১৫০৮০৭),

হোটেল জবা (০১৭১১১৮৬৭০৮, ০১৭৫৩১৫৪৬১৭),

নদীবাংলা গেষ্ট হাউজ (০১৭৭১৮৯৩৫৭০, ০১৭১৩৫৪০৫৪২)।

এসব হোটেলে ১৫০-৪০০ টাকার মধ্যে থাকার ব্যবস্থা আছে।

কোথায় খাবেন

যে রেস্ট হাউজে থাকবেন সেখানেই খাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। তবে এছাড়াও বিভিন্ন মধ্যমানের রেস্টুরেন্টে ভাত, ডাল থেকে শুরু করে সব ধরনের মাছ আর মাংসই পাবেন দুর্গাপুরে। দুর্গাপুরের উল্লেখযোগ্য রেস্টুরেন্ট হলো নিরালা হোটেল। এদের ব্যবহার খুবই ভালো।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।