হুমায়ূন আহমেদ : বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল আকাশে যে ক’টি নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে আলো দিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ অন্যতম। সাবলীল লেখা, তুখোড় সেন্স অব হিউমার, অসাধারণ নির্মাণ দিয়ে যিনি জয় করে নিয়েছেন দুই বাংলার অসংখ্য পাঠক ও দর্শকের মন। আজ এই মহান লেখক ও নির্মাতার ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে তাঁকে জানাই অনুলিপির পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা। চলুন জেনে নেওয়া যাক হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কিত জানা-অজানা সব তথ্য।
হুমায়ূন আহমেদ
জন্ম ও পরিচয়:
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ ই নভেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহুকুমার মোহনগঞ্জে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি ছিলেন পাকিস্তান পুলিশের উপ-বিভাগীয় পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় নির্মমভাবে শহিদ হন।
হুমায়ূন আহমেদের মায়ের নাম আয়শা ফয়েজ। হুমায়ূন আহমেদরা ছিলেন ছয় ভাইবোন। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়ো। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও বিখ্যাত কার্টুনিস্ট, সাহিত্যিক উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীব হলেন হুমায়ূন আহমেদের সহোদর।
শৈশব ও কৈশোর:
পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে বৈচিত্রময় এক শৈশব কেটেছে হুমায়ূন আহমেদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। তার রচিত ‘আমার ছেলেবেলা’ নামক আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন তার শৈশব ও কৈশোরের চমকপ্রদ সব গল্প! সেসব গল্প যে কোন পাঠককে আকৃষ্ট করবে নিঃসন্দেহে!
শিক্ষাজীবন:
পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে কখনোই এক স্কুলে বেশিদিন পড়ার সুযোগ পেতেন না হুমায়ূন আহমেদ। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে সিলেটের কিশোরী মোহন পাঠশালায় যা বর্তমানে কিশোরী মোহন (বালক) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে তিনি ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ১৯৬৩ সালে বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন এবং প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ মুহসীন হলেই লেখা। তিনি আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার নামের পাশে কখনোই ডক্টর উপাধিটি ব্যবহার করেননি!
কর্মজীবন:
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কর্মজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে। তখন তার বেতন ছিল মাত্র ৬৫০ টাকা। বাকৃবিতে শিক্ষকতার সময় তিনি ছোটো গল্প লেখা শুরু করেছিলেন। তাঁর লেখা সৌরভ নামক গল্পটি বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন।
পারিবারিক জীবন:
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে গুলতেকিন খান-কে বিয়ে করেন। গুলতেকিন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর নাতনী। হুমায়ূন গুলতেকিন দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড়ো মেয়ে নোভা আহমেদ, মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ এবং ছোটো মেয়ে বিপাশা আহমেদ। তাঁর বড় ছেলের নাম নুহাশ হুমায়ূন। বাবার মত নুহাশ হুমায়ূনও চলচিত্র ও নাটক পরিচালনায় মনোনিবেশ করেছেন।
২০০৫ সালে হুমায়ূন আহমেদ ও গুলতেকিন খানের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। হুমায়ূন ওই বছরই দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন একজন অভিনেত্রী, সঙ্গীতশিল্পী ও নাট্যনির্মাতা। মেহের আফরোজ শাওন দু’টি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। বড়ো পুত্রের নাম নিষাদ হুমায়ূন, ছোটো পুত্রের নাম রাখা হয় নিনিত হুমায়ূন।
সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ:
ছাত্রজীবন থেকেই হুমায়ূন আহমেদ লেখালিখিতে মনোনিবেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখেন যার নাম নন্দিত নরকে। এরপর তিনি লেখেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’। ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যায় তিনি লেখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘অচিনপুর’। তাঁর রচিত মোট বইয়ের সংখ্যা তিন শতাধিক। এরমধ্যে জোছনা ও জননীর গল্প, ১৯৭১, মাতাল হাওয়া, মধ্যাহ্ন (অখণ্ড) শ্রাবণ মেঘের দিন, অপেক্ষা, দূরে কোথাও, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, তোমাকে, মেঘ বলেছে যাবো যাবো অন্যতম। এছাড়াও তার হিমু, মিসির আলী, ও শুভ্র সিরিজের বইগুলো অত্যন্ত পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার রচিত বই ইংরেজি, ফরাসি, জাপানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
নাট্যনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ:
টেলিভিশনের দর্শকদের জন্যে হুমায়ূন আহমেদ বেশকিছু জনপ্রিয় নাটক নির্মাণ করেছেন। তার নির্মিত কোথাও কেউ নেই নাটকটি এতই বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল যে নাটকটির মূল চরিত্র ‘বাকের ভাই’-এর ফাঁসির আদেশ রুখতে বিটিভি কার্যালয় ও হুমায়ূন আহমেদের বাড়ির চারপাশে ঘেরাও করেছিল উত্তেজিত দর্শকরা। পৃথিবীর কোথাও একটি কাল্পনিক চরিত্রের ফাঁসির আদেশ রুখতে মিছিল হওয়ার নজির নেই। হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত ধারাবাহিক নাটকসমূহ- এইসব দিনরাত্রি, কালা কইতর, অয়োময়, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, উড়ে যায় বকপক্ষী, সবুজ সাথী, চন্দ্র কারিগর ইত্যাদি।
আরও পড়ুন# বলপয়েন্ট কলম যেভাবে এলো!
নাটকের মধ্যে অন্তরার বাবা, অচিন রাগিনী, অপরাহ্ণ, আজ জরীর বিয়ে, তারা তিনজন, ইবলিশ, আংটি, এই বর্ষায়, একা একা, একি কাণ্ড, চন্দ্রগ্রহণ, জল তরঙ্গ, তৃতীয় নয়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
চলচিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ :
হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের দর্শকদের জন্যে নির্মাণ করেছেন বেশকিছু কালজয়ী চলচিত্র। এসব চলচিত্র জাতীয় পুরস্কার সহ অন্যান্য অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত চলচিত্রগুলো হলো : আগুনের পরশমণি (১৯৯৪), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), দুই দুয়ারী (২০০০), চন্দ্রকথা (২০০৩), শ্যামল ছায়া (২০০৪), নয় নম্বর বিপদ সংকেত (২০০৬), আমার আছে জল, (২০০৮), ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)
আরও পড়ুন# নকশি পাখা: সুতোয় গাঁথা স্বপ্ন যেন!
এছাড়াও তিনি নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, দূরত্ব, নিরন্তর, দারুচিনি দ্বীপ, সাজঘর ও প্রিয়তমেসু চলচিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সমগ্র জীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদক (১৯৮৭), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৯৯২ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৪ সালে দেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। একই বছরের আগুনের পরশমণি চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া চলচ্চিত্রটি সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের জরিপে সমালোচকদের বিচারে সেরা দশ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকায় নবম স্থান লাভ করে।
আরও পড়ুন# যেভাবে গদি হারালেন বরিস জনসন!
তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে তৌকির আহমেদ নির্মিত দারুচিনি দ্বীপ (২০০৭) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। আমার আছে জল (২০০৮) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১১তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক পুরস্কার শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক বিভাগে মনোনয়ন লাভ করেন। তার উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত প্রিয়তমেষু (২০০৯) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১৫তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক পুরস্কার শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন। তার উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মরণোত্তর শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার লাভ করেন
মৃত্যু:
২০১১ সালের সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার সময় তার দেহে কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না পড়ায় সহজে তার চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ দফায় তাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। কৃত্রিমভাবে লাইফ সাপোর্টে রাখার পর ১৯শে জুলাই ২০১২ তারিখে তিনি নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
শেষ কথা:
হুমায়ূন আহমেদ তার জীবদ্দশায় বাংলা সাহিত্যকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন। বাংলা চলচিত্রে যোগ করেছেন বেশকিছু কালজয়ী সিনেমা। তার রচিত হিমু, মিসির আলী কিংবা শুভ্রের অনুকরণে আজও অনেক তরুণ জোছনা বিলাসী হবে, কেউ আবার হতে চাইবে যুক্তির চর্চাকারী, আবার কেউ দারুচিনি দ্বীপে খুঁজে নেবে মুক্তির স্বাদ। হুমায়ূন আহমেদ তার লেখা গানে বলেছিলেন, চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। তিনি যেদিন মারা যান, সেদিন নিউইয়র্কের আকাশে জোছনা ছিল না। তবে প্রতি পূর্ণিমায় তিনি নিশ্চয়ই জোছনাবিলাসে মেতে ওঠেন নন্দন কানন নুহাশপল্লীর বুকে শুয়ে থেকে!