ব্যবসা-বাণিজ্যসংবাদ

৪৩ কিলোমিটার সড়ক বানাতে পরামর্শ খাতে লেগেছে ১১০ কোটি!

চার লেনের সড়ক নির্মাণ হবে। এমন না যে দেশে চার লেন নির্মাণের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্প আরও আগেই বাস্তবায়ন হওয়া দেখেছে দেশের মানুষ। এসব মহাসড়কের সুবিধাও ভোগ করছে তারা। এবার ৪২ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার ‘সিলেট-চারখাই-শেওলা মহাসড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পে নির্মাণ হবে চার লেনের রাস্তা। মোট প্রকল্প ব্যয় ৩ হাজার ৮৭২ কোটি ৩২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ ব্যয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। এখানে উল্লেখ্য, এখানে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ২ হাজার ৬০৪ কোটি এবং সরকারি অর্থায়ন ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

তবে এসব কিছু নয়। অবাক করা ব্যাপার ঘটেছে প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ নিয়ে। শুধুমাত্র পরামর্শ খাতে আবদার করা হচ্ছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। একই সাথে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে চাওয়া হয়েছে ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদে ‘সিলেট-চারখাই-শেওলা মহাসড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।

তবে এ আবদার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। অর্থনীতিবিদরাও এর যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাদের পরামর্শ, কাড়ি কাড়ি টাকায় বৈদেশিক পরামর্শক না নিয়ে স্বল্প ব্যয়ে বুয়েটের (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) পরামর্শক নেওয়া হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, চার লেন নির্মাণে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অতীতে এ ধরনের যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে (ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন) সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ৪৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ১১০ কোটি টাকার পরামর্শক ব্যয় অনেক বেশি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিতে চলমান যে ধকল তাতে এসময় আমাদের বেছে বেছে কাজ করতে হবে।

অঢেল অর্থে বৈদেশিক পরামর্শক না নিয়ে কম টাকায় দেশীয় পরামর্শক নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। আমাদের বুয়েটের পরামর্শকরা এসব নির্মাণ প্রকল্প ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন। এতে ১১০ কোটি টাকার কাজ মাত্র ১০ থেকে ২০ কোটি টাকায় হয়ে যাবে। এখানে বিদেশি পরামর্শক বাদ দেওয়া উচিত। এটা জটিল কোনো প্রকল্প নয়।

আরও পড়ুন: মোট প্রকল্প ব্যয় ৪২ কোটি, পরামর্শের নামে খরচ ২৭ কোটি!

সড়ক নির্মাণে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, চার লেন নির্মাণ শিখতে বিদেশে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। দেশে বহু চার লেন হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বর্তমানে এলেঙ্গা থেকে রংপুর পর্যন্ত চার লেনের নির্মাণকাজ চলছে। বিদেশে না গিয়ে এসব চার লেন প্রকল্প থেকে জ্ঞান নেওয়া যেতে পারে। এখানে অনেক কিছু শেখার আছে। কারণ, এখানেই বিদেশি পরামর্শক কাজ করছেন। ওনাদের কাছ থেকে এখনই প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে। এসবের জন্য বিদেশ যাওয়ার কোনো মানে নেই।

মাত্র ৪২ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য এত টাকা খরচ করে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি ‘যৌক্তিক নয়’ বলে মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। পরামর্শক খাতের জনমাস ও ব্যয় পুনঃপর্যালোচনা করে যৌক্তিকভাবে ব্যয় কমানোর বিষয়ে একমত কমিশন। এমনকি কিছু খাতে অযৌক্তিক ব্যয় বাদ দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সত্যজিৎ কর্মকারের সভাপতিত্বে গত ২৪ আগস্ট ভার্চুয়ালি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছে। সভায় পরামর্শক ব্যয় কমানোসহ বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতেও ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। প্রকল্পে বৈদেশিক প্রশিক্ষণে সরকারি খাতে ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা এবং স্থানীয় প্রশিক্ষণে জিওবি খাতে ৩০ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে; যা যৌক্তিকভাবে কমাতে বলা হয়েছে। পিইসি সভায় বিস্তারিত আলোচনা করে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ব্যয় ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এ সভার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সত্যজিৎ কর্মকার।

এমনকি প্রকল্পের গাড়ি ক্রয়-সংক্রান্ত উপ-প্রস্তাবেও (কম্পোনেন্ট-প্রপোজাল) অসঙ্গতি রয়েছে। গাড়ি বা মোটরযান কেনা বাবদ ১০ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব দেওয়ার পর পৃথক উপ-প্রস্তাবে গাড়ি ভাড়া বাবদ চার কোটি ৮১ লাখ টাকা আবদার করা হয়েছে। কিন্তু গাড়ি কেনার পর গাড়িভাড়ায় কেন এত টাকা লাগবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বেশ কিছু অসঙ্গতির মধ্যে গাড়ি কেনা ও গাড়ি ভাড়ার বিষয়গুলোও প্রশ্নবিদ্ধ। পিইসি সভায়ও এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যানবাহনের মধ্যে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি জিপ গাড়ি, ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে চারটি পিকআপ, ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি মাইক্রোবাস, ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি মোটরসাইকেল কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে ৯.০৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে এডিবি!

প্রকল্প প্রস্তাবে ‘অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ’ খাতে ২৮ কোটি টাকা এবং দৈনিক কাজের খাতে ৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রাক্কলন (এস্টিমেশন) করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত কী বা এ খাতের আওতায় কী কাজ করা হবে তার কোন ব্যাখ্যা নেই প্রকল্প প্রস্তাবে। এমনকি দৈনিক কাজ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তাও খোলাসা করে বলেনি।

এ অবস্থায় প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন খাতে কী কাজ, কতটুকু কাজ এবং কোন কাজের জন্য কত টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে সেসব বিষয় স্পষ্টভাবে প্রকল্প প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করার মতামত দিয়েছে কমিশন। অর্থ বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ড্রাইভারের সংখ্যার ভিত্তিতে যানবাহনের সংখ্যা ও ব্যয় নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী অয়েল ও সুব্রিকেন্ট, গ্যাস ও জ্বালানির ব্যয় নির্ধারণ করার বিষয়ে পিইসি সভায় একমত পোষণ করা হয়।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিষয়ে বলা হয়েছে:

সিলেট সদর থেকে শেওলা স্থলবন্দর পর্যন্ত যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনের চলাচল দ্রুত এবং সহজ করা, মহাসড়কের উভয় পাশে আলাদা সার্ভিস লেন তৈরি করে স্থানীয় যানবাহন ও ধীরগতির যানবাহন চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিপন্ন বা দুর্বল সড়ক ব্যবহারকারীদের (বয়স্ক, নারী, শিশু ও সক্ষমতাহীন ব্যক্তি) জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমানো এ প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত বা বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) করিডোর, সাসেক (সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন) করিডোর, এশিয়ান হাইওয়ে, বিমসটেক করিডোর, বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) করিডোর ও সার্ক করিডোরের সঙ্গে আঞ্চলিক সংযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানো এবং তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা।

সিলেট-চারখাই-শেওলা মহাসড়কটি বিসিআইএম করিডোর এবং সাসেক করিডোর-৫-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীনের ইউনান প্রদেশ, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকের ‘সেভেন সিস্টার্স’র মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে বিসিআইএম করিডোর। সাসেক করিডোর-৫ মধ্য ও উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এ প্রকল্প বিবিআইএন কার্গো রুটের অন্তর্ভুক্ত একটি উপ-প্রকল্পও। এই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক করিডোরগুলো বেশ কয়েকটি স্থল ও সমুদ্রবন্দরে আন্তর্জাতিক যান চলাচল নিশ্চিত করবে। করিডোরগুলোর মাধ্যমে পণ্য ও যাত্রীদের আন্তঃসীমান্ত চলাচল প্রসারিত হবে। যাত্রী ও পণ্যবাহী যানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও বিষয়টিও প্রকল্পে উঠে এসেছে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পে ঋণদাতা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তির সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে পিইসি সভাকে অবহিত করবে ইআরডি (অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ) ও সওজ অধিদপ্তর। প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১৯৪ দশমিক ১৩ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৪৯৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং পুনর্বাসন খাতে ২৫ কোটি টাকার প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে এ ব্যয় প্রাক্কলন আদৌ জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) কোনো নথি সংযুক্ত নেই।

প্রকল্পে ৪৪ দশমিক ৫০ লাখ ঘনমিটার মাটির কাজের জন্য (সড়ক বাঁধ করতে) ১৭৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। সড়ক বাঁধের উচ্চতা কত হবে, তা স্পষ্ট নয়। সড়কের দুপাশে সার্ভিস লেনসহ ৪২ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার ছয় লেন পেভমেন্ট (উভয় পাশে সার্ভিস লেন ৪ দশমিক ৮ ও ৫ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থে এবং মূল পেভমেন্ট মিডিয়ানের উভয় পাশে ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থে) নির্মাণের জন্য ৮০৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা এবং ৭৩ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার মিডিয়ান ও লেন-ডিভাইডার নির্মাণের জন্য ১৫৪ দশমিক ১৬ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হলেও পেভমেন্ট এবং মিডিয়ান ও লেন-ডিভাইডার নির্মাণের ব্যাপারে ‘ইঞ্জিনিয়ারস এস্টিমেট’ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এই প্রকল্পে ইউটিলিটি স্থানান্তর বাবদ ১৫০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউটিলিটি সংস্থা ও সরবরাহকারী সংস্থার যৌথ জরিপ এবং যৌথ স্বাক্ষরে ইউটিলিটি স্থানান্তরের পরিমাণ ও ব্যয় নির্ধারণ করা হয়নি। ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সি খাতে ২ শতাংশ হারে ৭০ কোটি ১১ লাখ টাকা করে প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাইস কন্টিনজেন্সি খাতে ৮ শতাংশ হারে ২৮০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং মূল্য সমন্বয় খাতে ৩৫১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব খাতের ব্যয় কীসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রকল্প প্রস্তাবে তা স্পষ্ট করেনি সংস্থাটি।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রস্তাবিত এ চার লেন নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান জানান, সব প্রকল্প সম্পর্কে আমার জানা সম্ভব নয়। আমাকে অনেক প্রকল্প দেখতে হয়।

পরবর্তীতে, বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে চেয়ে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সিলেট জোন) মো. ফজলে রাব্বি।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।