ফিচারলোকসংস্কৃতি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ঐতিহ্যবাহী আমের রাজধানী

অত্যন্ত জনপ্রিয়, রসালো ও সুস্বাদু ফলের নাম হলো আম। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে ও পুষ্টিমানে আমের বিকল্প শুধু আম-ই। তাইতো আমকে বলা হয় ফলের রাজা। আম সাধারণত কাঁচা, আধা-কাঁচা, কাঁচা-মিঠা, পাকা অবস্থায়ও খাওয়া হয়। এছাড়াও বর্তমানে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আমকে রূপান্তর করা হচ্ছে। আম থেকেই আমসত্ত্ব, জুস, আচার, চাটনি এসব তৈরি করা যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আমের চাষ হয় তবে মূলত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও পার্বত্য জেলাগুলোয় বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ মে. টন আম উৎপাদিত হয় প্রতি বছর। উৎপাদিত আম এসব এলাকা থেকে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবারাহ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন জেলায় আমের ভালো ফলন হলেও আমের রাজধানী বলা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জকে। এই জেলার আমের উৎপাদন ব্যাপক, শুধু তাই নয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর আম এ জেলার ঐতিহ্যের একটি অংশ।

আমের উৎপত্তি স্থান নিয়ে মতবাদ:

সব ফলের রাজা আম, পৃথিবীর সেরা ফল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারত উপমহাদেশই মূলত আমের উৎপত্তি স্থান। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর মানুষেরা দাবি করেন, শিবগঞ্জের গৌড় এলাকাই আমের উৎপত্তি স্থান। কয়েক শত বছরের পুরোনো আম গাছ এখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অহরহ চোখে পড়ে। এছাড়া শতাধিক বছরের পুরোনো প্রচুর বট, পেকুড়, তেঁতুল, শিমুল, তালগাছ এ জেলায় ছিল যা পরবর্তী সময়ে নিধন করা হয়েছে। তবে আমপ্রিয় মানুষ ও অনুরাগীরা এখনও লালন করে যাচ্ছে অনেক বড়ো বড়ো পুরোনো আম গাছ।

আমের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

শুধুমাত্র আম বাগানকেই কেন্দ্র করে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। একসময়ে পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সনের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা তথা গোটা বাংলা স্বাধীনতা হারিয়েছিল। আবার মেহেপুরের আমঝুপিতে লর্ড ক্লাইভ ও মীর জাফর কর্তৃক সরকার উৎখাতের গোপন ষড়যন্ত্রের সভাটিও আয়োজিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথের ২০০ বিঘার আম বাগানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী সভার প্রথম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটিরও আয়োজন করা হয়েছিল। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতেও রয়েছে আমের প্রাধান্য। তাই বলা যায়, ঐতিহাসিক, বহুল আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পেছনে এই বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা মোটেও ফেলে দেবার মতো নয়।

বিভিন্ন জাতের আম:

জলবায়ু ও মাটির গুণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দেশের সেরা আমের ভাণ্ডার বলে সবার কাছে এখনো সুপরিচিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের আম অনুরাগীরা জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণ মধুর মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের স্বাদের বৈচিত্র্য আহরণের প্রতীক্ষায় দিন গুনে থাকেন। নিচে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন জাতের আম সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হলো:

ক্ষীরশাপাতি:

বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে জামদানি ও ইলিশের পর স্বীকৃতি পেল চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম। এই আমটি হিমসাগর আম নামেও অন্যান্য অঞ্চলে পরিচিত। আকারে মাঝারি এই আম অত্যন্ত মিষ্টি ও আঁশহীন। আধা-পাকা ক্ষীরশাপাতি আম কাঁচা খেতেও দারুন লাগে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ঐতিহ্যবাহী আমের রাজধানী
ক্ষীরশাপাতি আম

গোপালভোগ:

মধুমাসের শুরুতেই গোপাল ভোগ আম পাওয়া যায়। এই আম খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু, আঁশ বিহীন, আটি ছোট। মাঝারি সাইজের ও কেজিতে ৫টা থেকে ৬টা ধরবে। দেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত এই আমের বেশ চাহিদা রয়েছে।

আম্রপালি:

আম্রপালি আমের নামকরণ একজন নারীর নামে করা হয়েছিল, যার নাম আম্রপালি। ভারতের শ্রেষ্ঠ নর্তকীর নাম ছিল আম্রপালি। ভারতের আম গবেষকরা ১৯৭৮ সালে দশহোরি ও নিলাম-এই দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে আম্রপালি আমের জাত উদ্ভাবন করেন ও এই জাতের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আম্রপালিতে প্রতিবছর ফলন ধরে। এই আমের মিষ্টতার পরিমাণ ল্যাংড়া বা হিমসাগরের চেয়েও বেশি। আকার লম্বাটে আমটি আষাঢ় মাসে পাকে। আঁটি সরু, সুস্বাদু ও আঁশবিহীন এই আমের গড় মিষ্টতার পরিমাণ ২৩ শতাংশের বেশি।

মিয়ার চারা:

আমটির নাম মিয়ার চারা কেন তা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, হয়তো কোনো মিয়াঁ সাহেবের আমটি অনেক পছন্দের ছিল। গোপাল ভোগের সাথে সাথেই এটি প্রায় পাকে। আকারে মাঝারি, খুবই মিষ্টি, একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছা করবে এমন ধরনের একটি আম।

লখনা:

আকারে অনেক বড়ো হাইব্রিড জাতীয় আম হলো লখনা। দেখতে অনেক সুন্দর, ফলনের পরিমাণ বেশি, পাকলে ঈষৎ সোনালি বর্ণ ধারণ করে। এর স্বাদ অনেকটা পেঁপের মতো ও দামও তুলনামুলক কিছুটা কম।

ফজলি:

বহুল আলোচিত আম হলো ফজলি। বৃহত্তর রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের গর্ব এই ফজলি আম। এই আমের যেমনি আকার তেমনি তার স্বাদ। দীর্ঘসময়ের জন্য কাঁচা খেতে যেমন মজা তেমনি পাকা খেতেও মজা লাগে। কাঁচা আম কেটে লবণ, মরিচ, কাসুন্দি দিয়ে মেখে কলা পাতার ওপর রেখে খাবার মজাই আলাদা।

আশ্বিনা:

আশ্বিন মাস পর্যন্ত গাছে থাকে বলে এর নাম আশ্বিনা। আকারে বেশ বড়ো, অনেকটা ফজলির মতো। কাঁচা অবস্থায় এই আম ভয়ংকর রকমের টক, কিন্তু পাকলে আবার সেই রকমেরই মিষ্টি ও সুস্বাদু। এই আম নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় একটা ছড়া প্রচলিত-
“আশ্বিনা রে আশ্বিনা গাছ তলাতে যাস ন্যা,
কাঁচাতে খাইস ন্যা, পাকাতে পাইস ন্যা।”

দুধসর:

দেখতে অনেকটা বিদেশিদের মতো তাই এর নাম দুধসর। সুস্বাদু তবে কাঁচা অবস্থায় খুব টক তবে পাকলে আবার ব্যাপক মিষ্টি।

ফনিয়ার চারা:

লম্বাটে গড়নের এই আমটি খুবই সুন্দর সুগন্ধ যুক্ত। এই আম খেতে অত্যন্ত মিষ্টি এবং খোসা পাতলা।

জালিবান্ধা:

জালিবান্ধা আম সাইজে বড়ো। এর খোসা পাতলা হয় অতিরিক্ত মিষ্টি না হয় না তবে স্বাদটা ভাল হয়।

কাঁচামিঠা:

কাঁচা অবস্থায় খেতে মিষ্টি এই আম কাঁচাতে মিষ্টি আবার পাকলে এটা টক হবে এমনটা নয়, পাকলেও বেশ সুস্বাদু।

কুয়া পাহাড়ি:

কুয়ার পাড় হতে এই আমের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আমটা লম্বা নিচের দিকে ঈষৎ বাঁকা আর খেতে মিষ্টি ও সামান্য আঁশযুক্ত।

কুমড়া জালি:

ছোটো কুমড়ার মতো এর আকার বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে কুমড়াজালি। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটি আম না কুমড়া। এই আম খেতে অনেকটা জেলির মতো আবার মনে হয় দানাদারের মতো। স্বাদটা আলাদা ধরনের ও খুব দুর্লভ।

মোহন ভোগ:

মোহন ভোগ আমের আঁটি ছোটো, বেশ বড়ো আকারের, খেতে মিষ্টি, অনেকটা গোপালভোগের মতো।

পাটনায় গোপালভোগ:

এটি হাইব্রিড গোপালভোগ। আকারে গোপালভোগের চেয়ে বড়ো। তবে স্বাদে গোপালভোগের চেয়ে কিছুটা কম। গোপালভোগের চেয়ে আকারে ছোটো পাটনায়ের গোপালভোগ আম।

রানী প্রসাদী:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয়রা আমটির নাম দিয়েছেন ‘রানী পছন্দ’। অনেক মিষ্টি, লম্বা আকারের, খোসা পাতলা হলো এই আমের বৈশিষ্ট্য।

ভাদ্রি:

অনেক লম্বা অনেক এই আমটা ঈষৎ কৃষ্ণ বর্ণের, খোসা মোটা, খেতে গতানুগতিক ভাবে মিষ্টি।

রাজভোগ:

রাজভোজ আম আকারে গোল, বেশ বড়ো বড়ো হয়, খেতে প্রচণ্ড মিষ্টি কিন্তু এই আম খেতে শক্ত দাঁত থাকা আবশ্যক। বেশ আঁশ যুক্ত বিধায় খাওয়ার পর দাঁত খেলান করা লাগে।

ল্যাংড়া:

ল্যাংড়া আমকে আমের রাজা বলা যায়। স্বাদে ঘ্রাণে অনন্য এই আমের তুলনা আর কোনো আমের সাথে করাই যায় না। নামে ল্যাংড়া হলেও এই আম অতি সুস্বাদু। আঁটি ছোটো, পাতলা, খোসা খুবই পাতলা, রসালো, গায়ে শুধুই মাংস আর এর স্বাদ অসাধারণ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর আম উপভোগের সময়:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম উপভোগের জন্য শুধু এ জেলার মানুষ নয় বিভিন্ন জেলার মানুষ সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন। নানা আকার ও বর্ণের বাহারি রকমের কাঁচা-পাকা আম অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। আমে রয়েছে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান, বিশেষ করে এতে ভিটামিনস ও মিনারেলসের পরিমাণ খুবই বেশি থাকে। একজন মানুষের দেহের দৈনিক সব পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণ হয় দিনে ২-৩টা পাকা আম আহার করলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ মৌসুমে ৩-৪ মাস ধরে প্রচুর কাঁচা-পাকা আম খাওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। আম বেশি খাওয়ার প্রভাবে তারা চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী হন আবার এ সময় তাদের ভাত আহার করার প্রবণতাও অনেক কমে যায়। তারা মনের আনন্দে আম উপভোগ করেন। সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বাগানে মুকুল আসার সাথে সাথে মৌমাছির আনাগোনা বেশি দেখা যায় আম বাগানে। এতে মধু আহরণের সুযোগ বাড়ে ও ফুলে পরাগায়ন বৃদ্ধি পায়। বাদুড়, কাক, ঘুঘু, কবুতর, ফিঙে, বুলবুল, দোয়েল, কোয়েল, কোকিল, টিয়া, শালিক, সাতভায়াসহ হরেকরকম রঙ-বেরঙের পাখির সুমিষ্ট কলকাকলিতে প্রকৃতি মুখরিত হয়, ঠিক যেনো প্রাণ ফিরে পায়। আম বাগানে মাকড়সা, প্রজাপতি, লাল পিঁপড়া, মৌচাক প্রচুর দেখা যায়। আবার এ সময়ে লাল পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে ছেলেমেয়েরা ছিপ বা বড়শী দিয়ে মাছ ধরার আনন্দ উপভোগ করে থাকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ – এ আম বাগান সৃষ্টি ও পরিবেশের ওপর তার প্রভাব:

এককালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শত শত বছরের পুরাতন বড়ো বড়ো বৃক্ষ গাছ দেখা গেলেও ইটের ভাটার চাহিদার কারণে তা কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে গিয়েছে। শত বছরের অনেক পুরাতন আম গাছগুলোও নিধন করা হয়েছে রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে। আবার শতাধিক বছরের অনেক বয়স্ক আম গাছও এখনও নিজ মহিমায় টিকে আছে। বরেন্দ্র প্রকল্পের অনুকূল প্রভাবের কারণে এক ফসলা জমি রূপান্তরিত হয়েছে দু-তিন ফসলি জমিতে। এজন্য গাছপালায় ভরপুর সবুজ মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। প্রচণ্ড খরার প্রভাবে ৩০-৪০ বছর আগেও শুধুমাত্র সাঁওতাল ছাড়া সেখানে অন্য কোনো মানুষ বাস করার চিন্তা করত না। কিন্তু দিন পাল্টেছে তাই এখন অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। খরার প্রভাব কেটেছে আর লু হাওয়া তেমন বইতে দেখা যায় না ফলে এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অনেকাংশে বেড়েছে। এদিকে পানির স্তর নিচে নামার প্রবণতা কমার কারণে স্থানীয় মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে। এখানে প্রচুর স্থানীয় ও অতিথি পাখিদের আশ্রয়, খাদ্য ও প্রজনন ক্ষেত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে পাখির কলকাকলী, গান ও বিচরণে এলাকায় পরিবেশে অনুকূল প্রভাব ফেলেছে। এ জেলায় হাট-বাজার, রাস্তাঘাট অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, ঈদগাহে আমগাছ রোপণ চর্চা চলে আসছে, যা মূলত বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সৃষ্ট আম বাগানের বনায়ন এই এলাকা ও দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। বড়ো বড়ো আম বাগান থেকে প্রতি বছর কত হাজার টন যে অক্সিজেন অবমুক্ত হচ্ছে এবং আমগাছ কত হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নামক বর্জ্য চুষে নিয়ে প্রাণিকুলের প্রাণ বাঁচাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্যও সুফল বয়ে আনছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর আম সংগ্রহের পদ্ধতি:

চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীরা তাদের প্রিয় আম অতি পরম যত্নে সংগ্রহ করেন। হাত দিয়ে যত্ন সহকারে অথবা ঠুঁসি দিয়ে আম পাড়া হয়ে থাকে। আম যাতে কোনো প্রকার আঘাত প্রাপ্ত না হয় সেদিকে তারা অতি সচেতন থাকে। তবে এলাকাবাসী কেউ কারও গাছের আম ছিঁড়বে না। তবে ঝড়-বাতাসে ঝরে পড়লে তা কুঁড়িয়ে খাবার প্রচলন রয়েছে, যেটি অন্য জেলায় বিরল ঘটনা। গোরু-ছাগল যেনো কোনো বাগানের আম নষ্ট করতে না পারে সেদিকে সবাই সামাজিকভাবে সচেতন থাকে। এলাকায় আম পাহারার জন্য কাউকে বাড়তি খরচ বহন করতে হয় না এবং তারা পরস্পর সামাজিকভাবেই কাজটি করে থাকেন।

চাপাইনবাবগঞ্জ – এ আমের অর্থনৈতিক প্রভাব:

চাঁপাইনবাবগঞ্জ – এ মৌসুমে ৩-৪ মাসব্যাপী চলে আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণসহ সংশ্লিষ্ট কাজ। আমের মৌসুমে যে পরিমাণ আম বাজারজাত হয় তার শতকরা ৫০ ভাগই আম্রপালি আমের উৎপাদন হয় উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। শুধুমাত্র আম্রপালি আম ক্রেতা-বিক্রেতা সবারই কাছে অতি সমাদৃত। সকল শ্রেণি ও বয়সের মানুষ প্রচুর কাজের সুযোগ পান এ সময়ে, মানুষের আয় বাড়ে, পারিবারিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের ব্যস্ততা বাড়ে এসময়ে। স্থানীয় পরিবহন যেমন- গরু-মহিষের গাড়ি, রিকশা, বাইসাইকেল, অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, মিনিট্রাক, পিকআপের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই এ সময় লাভবান হয়। এছাড়াও এ সময়ও আন্তঃজেলা পরিবহন যেমন- বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলার, কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে জড়িত সবারই প্রচুর আয় বৃদ্ধি পায়। আম পাড়া, আমের টুকরি, ঝুড়ি তৈরি, ঝুড়ি, কার্টুনে আম ভর্তি করা সহ নানা কাজে এলাকার দরিদ্র মানুষ প্রচুর কাজের সুযোগ হয়। আম মৌসুমে তারা দিন-রাত কাজ করে যথেষ্ট আয় করে। এ মৌসুমে প্রচুর হোটেল, রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠে সেখান থেকে আমের ব্যাপারী, আড়তদার সবার জন্য এলাকার বাহারি কালাই রুটির বিপণনও বাড়ে। ভ্রাম্যমাণ খাবার সরবরাহকারী দরিদ্র পুরুষ মহিলাদের এ সময় বাড়তি আয়ের সুযোগ বাড়ে। শুধুমাত্র আমের ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই এ এলকায় ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে আবার এ এলাকার মানুষজন আমের বাগান ও মৌসুম ভিত্তিক আম বিক্রি করেই সংসার চালায়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ঐতিহ্যবাহী আমের রাজধানী
আমের ব্যাপারী

চাঁপাইনবাবগঞ্জ – এ আমের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার:

চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী বাগানে বসে লবণ, মরিচ, কাসুন্দি দিয়ে কচি আম কেটে, বেটে, ঘুটে মজা করে খায়। আবার মাসকলাই ডালে আম ডাল, টক-ডাল, আম-বড়ি-বেগুনের তরকারি, আম দিয়ে সজিনা রান্না, আম মাছের চড়চড়ি, আমের ভর্তা, আম দুধ, আম চিতাই, আম চুর, আমের পায়েস, পান্তা ভাতে পাকা আম এবং ছাতু দিয়ে আমের লাহারিসহ নানভাবে আমের বৈচিত্র্যময় আহার করে চাঁপাইবাসী পরিতৃপ্তি পান। এ সময় বেহাই ও আত্মীয়ের বাড়িতে নানা রঙের আম, আটা, বাতাসা পাঠানোর উৎসব চলে আবার তা রীতিও বটে। বাইরের জেলাগুলোতে কেবল কাঁচা আম বিপণন করা হয়ে থাকে। পাকা আমগুলো স্থানীয়ভাবে খুব সস্তায় বিক্রি করা হয় এখানে। তাই ধনী-দরিদ্র সকলেই তিন বেলা পাকা আম খাওয়ার প্রচুর সুযোগ হয়। শিশুদের আস্ত পাকা আম চুষে খাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে, যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর আমকেন্দ্রীক লোকসংস্কৃতি:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকেন্দ্রীক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আরও অনেক আগেই। শুধু এ জেলাতেই নয় বাংলায় আমের যথেষ্ট কদর রয়েছে। আমের মৌসুমে মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে আম পাঠানোর রীতি এখনও রয়েছে। আবার জামাইষষ্ঠীতে জামাই বাড়িতে আম-কাঁঠাল নিয়ে যাবার রীতি রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে আম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিয়ে। প্রতিটি হিন্দু বাড়িতেই ২-৩ টি আম গাছ রয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির আগে কাঁচা আম খায় না তারা। স্বরস্বতি পূজায় আমের মুকুল খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাচার। প্রথার সাথে লোকসংস্কারও প্রচলিত রয়েছে। লোকবিশ্বাস ছিল যে, পোকায় খাওয়া আম খেলে শিশুরা তাড়াতাড়ি সাঁতার শিখতে পারে। আবার বলা হয়, আমের ফসল ভালো হলে ঝড় তুফান বেশি হয়। প্রবাদ আছে- আমে বাণ, তেঁতুলে ধান। আমের মৌসুমে নারীর মনের আকুতি ফুটে ওঠে গীতিকার মাধ্যমে- জৈষ্ঠ্য না মাসেরে বন্ধু গাছে পাকা আম আমার বন্ধু নাইরে, দেশে কারে খাওয়াইতাম।

বৃহত্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম বাগানের সুশীতল ছায়ার মনোরম পরিবেশে নানা ধরনের মেলার আয়োজন হয় ঈদ, পূজা-পার্বণসহ নানা উৎসব উপলক্ষে। এসব মেলার মধ্যে তত্ত্বিপুর, মহারাজপুর, কানসাট, ভুজনীতলা, বানেশ্বরে আয়োজিত মেলা অন্যতম। মেলাকে কেন্দ্র করে এখানে চলে ঐতিহ্যবাহী আলকাপ, যাত্রা, পুতুলনাচ, কবিগান, বাউল গান ইত্যাদি। লোকায়ত মানুষের প্রাণের বিনোদনের এগুলো। আবার আম বাগানে আয়োজন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানের আসর। এলাকা ও দেশভিত্তিক নানা সমস্যা উঠে আসে নানা নাতির হাস্যরসে, গম্ভীরা গানের মাধ্যমে। এখানে আম কাঠের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি হয়ে থাকে। কামার, কুমার, চামার, ছুতার, কৃষাণ, কৃষাণীর তৈরি হরেকরকম দ্রব্যাদি ও নকশিকাঁথা এসব মেলায় প্রচুর বিক্রি হয়, বেচা-বিক্রির হিড়িক পড়ে চারিদিকে। ছায়াঘেরা আম বাগানে হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, ডাংগুলি, কাবাডি, বাঘ-বকরী, লুকোচুরি, লুডুসহ নানা রকম লোকক্রীড়ায় মেতে উঠে ছেলে, মেয়ে, বড়রা সবাই। আবার প্রচণ্ড খরায় মাইচা, মোড়া, খাটলায় আম বাগানে বসে বিশ্রাম নেবার সময় আম বাগানের শ্রমিকরা গল্পগুজব, বিনোদন ও আয়বৃদ্ধিকারক কাজ সমাধান করে থাকে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা সারা দিন আম বাগানে ঘুরে ঘুরে আম কুড়ায় আর ছড়া কাটে- ‘আইরে বাতাস লইড়া, হাতির উপর চইড়া, ঝড়ি এলে কড়ি দিব, আম পড়লে টাকা দিব’। ঝড়-বাতাসের সম্ভাবনা দেখলে বাগান মালিকরা বা বাগান ক্রেতার যখন বুক দুরু দুরু করে আবার তখনই ছেলে মেয়েরা এমনকি বড়রাও ডালি, ধামা, আড়হি, গাইনঞ্জা নিয়ে পরম আনন্দে আম বাগানে আম কুড়াতে ছুটেন। প্রচলিত আছে ‘ফাগুনে আগুন, চৈতে কাটিকুটি, বৈশাখে আঁটি, জ্যৈষ্ঠেতে চুষি’। মুকুলসহ ছোট-বড় আম ঝরলেও বাগানিরা হতাশ হয় না। কেননা তারা বিশ্বাস করে ‘আমের আনা, মাছের পাই, যদি থাকে কেবা খায়’। আম বিক্রির যখন হিড়িক পড়ে তখন সকলে ব্যস্ত। এলাকায় প্রবাদ আছে ‘আম কালে ডোম রাজা’। এভাবে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গ্রামীণ ঐতিহ্য।

#আরও পড়ুন: মঙ্গলপুর: জন-মানবশূন্য এক গ্রামের গল্পকথা!

পরিশেষে বলা যায়, আম একটি রসালো ও সুস্বাদু, সুমিষ্ট ফল। আম বাঙালির প্রিয় ফল। বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমকে কেন্দ্র করেই জীবন-জীবিকা গড়ে উঠেছে। বছরে আমের মৌসুমে কেন্দ্র করেই এখানে সকল আয়োজন। আমের রাজধানীর এ আম যেনো অমৃতসম। তাই উপকারী ও পছন্দনীয় এই প্রিয় ফলের আবাদ ও ফলন বৃদ্ধিকল্পে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসা উচিত।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।