কীভাবে এলো গণিত এর যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ চিহ্নগুলো?
গণিত হলো এক ধরনের ভাষা, এই গণিতের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে মহাবিশ্ব সবটুকুই যেন খুব সহজে হিসাব করে নেওয়া যায়। আমাদের প্রতিদিনকার জীবন গণিত ছাড়া একদমই অচল। একটু অবাক হলেন? তাহলে শুনুন আপনি ঘুম থেকে কয়টায় ওঠবেন! এখানে এই ‘কয়টা’ গণিতের সংখ্যা দ্বারাই প্রকাশ করা হয়। আবার, কখন কী কাজ করবেন সবই গণিত দিয়ে হিসাব করা হয়। এইজন্য মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নিল ডিগ্রেস টাইসন বলেছেন- “গণিত হচ্ছে বিশ্বের ভাষা। তাই আপনি যত বেশি সমীকরণ জানবেন, তত বেশি মহাজগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন।” এই গণিতের ইতিহাস নিয়ে বলতে গেলে আজ আর শেষ হবে না। তবে আজকের গল্পটা অন্য কিছু নিয়ে, এই যে আমরা গণিতে যোগ, বিয়োগ গুন, ভাগ, সমান ইত্যাদি চিহ্ন দেখি! কিন্তু কীভাবে এলো গণিতের যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ চিহ্নগুলো?
গণিতের এই চিহ্নগুলোকে সাধারণত গাণিতিক চিহ্ন বলা হয়। এই গাণিতিক চিহ্নের সংখ্যা কম নয়। যেমন: যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ, সমান, বর্গমূল, পাই, বন্ধনী,সমানুপাতিক, ব্যস্তানুপাতিক, ইত্যাদি। এই চিহ্ন আবিষ্কারের আগে চিহ্নের যে কাজ, তা লেখার প্রচলন ছিল। তবে সেক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটি কথায় লিখে প্রকাশ করতে হতো। যা খুবই সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য ছিল। এইজন্য এক সময় শুরু হয় এই চিহ্নের ব্যবহার। একটু সহজে বলি, এই যে আমরা ২ ও ৩ খুব সহজে যোগ করার জন্য লিখি ২+৩। কিন্তু যখন এই যোগ চিহ্ন আবিষ্কার হয়নি, তখন লেখা হতো এভাবে—২ এর সাথে যোগ করো ৩।
এরপর এই ২+৩ এর ফলাফল লিখতে গিয়ে আমরা যে = চিহ্নের ব্যবহার করি। এই সমান চিহ্ন আবিষ্কার হবার আগে লেখা হতো, ‘ইজ ইকুয়ালস টু’। যে লেখা বেশ সময়সাপেক্ষ ছিল। কিন্তু, ২+৩=৫ লিখতে কিন্তু কম সময় ও শ্রম লাগে। তো চলুন পাঠক, আলাদা আলাদা গাণিতিক চিহ্নের গল্প করি।
•যোগ— আমরা যখন দুই বা ততোধিক সংখ্যা একত্রে গণনা করতে যাই, তখন যে চিহ্নের ব্যবহার হয় তাই মূলত যোগ চিহ্ন। আরও বাড়ানোর নিমিত্তেই এই যোগ করার প্রক্রিয়া। যোগ শব্দটি আসে ল্যাটিন শব্দ Plus হতে। যার অর্থ ‘ আরও’। এরপর ল্যাটিন ‘Et’ থেকে & (And) এর উৎপত্তি। পরিবর্তিতে এই ‘And’ এর পরিবর্তে ‘+’ চিহ্ন ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। ইতিহাস অনুযায়ী, চতুর্দশ শতাব্দীতে এই যোগ চিহ্নের প্রচলন শুরু হয় এবং নিকোলাস ওরেসমে তার ‘অ্যালগোরিসমাস প্রোপোর্শনাম’-এ সর্বপ্রথম ‘+’ চিহ্ন ব্যবহার করেন। তবে তখুনি যে এর প্রচলন সারা বিশ্বব্যাপী হয়েছে, এমনটি নয়। তখনকার সময় অনেকেই অনেক প্রতীক ব্যবহার করতেন। যেমন: ইতালিয়ান গণিতবিদ লুকা প্যাসিওলি তখন যোগের ব্যবহার বুঝাতেন ইংরেজি বর্ণ ‘P’ এর ওপর ছোটো দাগ দিয়ে। তবে এই ‘+’ চিহ্নের প্রচলন জনপ্রিয়তা পায় জার্মান গণিতবিদ জোহানেস উইডম্যানের লেখা ‘মার্সেন্টাইল অ্যারিথমেটিক’ বইয়ের মাধ্যমে। মূলত এই বইয়ে তিনি ‘+’ চিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন।
•বিয়োগ—বিয়োগ মানেই কোনো কিছু বাদ দেওয়া। এই ‘বিয়োগ’ শব্দের সূচনা ঘটে ল্যাটিন শব্দ ‘Minus’ হতে। এই minus অর্থ less বা কম। গণিতবিদ লুকাস প্যাসিওলি যোগের মতোন বিয়োগের ক্ষেত্রে ইংরেজি বর্ণ m এর ওপর ছোটো দাগ দিয়ে ব্যবহার করতেন। তবে বিয়োগ চিহ্ন হিসাবে ‘-‘ কবে ব্যবহৃত হয়েছে তার সঠিক বা স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। ধারণা করা হয়, চতুর্দশ শতাব্দীতেই যোগের সাথে বিয়োগ চিহ্নের ও উৎপত্তি ঘটে। আর যোগের মতো বিয়োগ চিহ্নের প্রচলন জনপ্রিয়তা পায় সেই একই বই ‘মার্সেন্টাইল অ্যারিথমেটিক’ বইয়ে ব্যবহার করার পরেই। তবে ইংরেজ বা ব্রিটিশদের কাছে এই যোগ ও বিয়োগ চিহ্ন প্রথম তুলে ধরেন রবার্ট রেকর্ড তার বই দ্য ওয়েটস্টোন অব উইট এ এই চিহ্নগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে।
•গুণ—গুন (×) কিংবা (.) বর্তমান সময়ে এই দুইটি চিহ্ন দ্বারাই গুন বুঝানো হয়। যদিও ডট চিহ্নের আলাদা ব্যবহার আছে, তবে গুণ হিসাবে অধিক ব্যবহার হয় প্রথম চিহ্নটি। এই গুণ চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয় সেই ষোড়শ শতাব্দীতে। ধারণা করা হয়, ইংরেজ গণিতবিদ উইলিয়াম অটরেড সর্বপ্রথম এই গুন চিহ্নের ব্যবহার করেন। তবে তিনি এটি কী কারণে বা কী হিসাবে প্রয়োগ করেন তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। বলা হয়ে থাকে, তিনি সেন্ট এন্ডু ক্রস হতে এর ব্যবহার করেন। তবে অনেকে মনে করেন, যেহেতু গুণব্দ্বারা অনেক বড়ো যোগ প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। এইজন্য যোগ চিহ্নকে আড়াআড়ি ব্যবহার করে গুন বুঝানো হয়েছে। তবে এই গুণ চিহ্ন ইংরেজি বর্ণ ‘X’ এর সাথে মিলে বিধায় অনেকেই (.) চিহ্ন ব্যবহার করে থাকেন, এবং এই দুটি চিহ্নই সমানভাবে প্রচলিত।
•ভাগ—এই একবিংশ শতাব্দীতে ভাগ চিহ্ন হিসাবে অনেকগুলো চিহ্নের ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে এদের সবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ÷, /, ‘) (‘ ও ‘।’ এই চিহ্নগুলো। এই চিহ্নগুলো মধ্যে ‘।’ চিহ্নটি সবার প্রথম ব্যবহার করা হয় বলে অনুমান করা হয় এবং তা ত্রয়োদশ শতাব্দীরও আগে। কিন্তু ভাগ চিহ্ন ব্যবহারের জনপ্রিয়তা পায় ষোড়শ শতাব্দীতে এসে। বলা হয়, এই ভাগ চিহ্ন সামনে আনে আরবীয়রা এবং পরবর্তীতে ইয়োরোপীয় গণিবিদ ফিবোনাচ্চি এর প্রয়োগ ঘটান। এছাড়াও ডি মরগান ১৮৪৫ সালে ভাগ চিহ্নকে / এই চিহ্ন দিয়ে বোঝানো শুরু করেন। তবে জনপ্রিয় ÷ এই চিহ্নটা ভাগ চিহ্ন হিসাবে প্রথমে ব্যবহার করেন সুইস গণিতনিদ জোহান রাহন। তিনি ১৬৫৯ সালে তার বই ‘Teutsche Algebra’ তে এই চিহ্ন ব্যবহার করেন। কিন্তু বর্তমানে আন্তজার্তিক কোনো স্বীকৃতি নেই। ভাগ চিহ্ন হিসাবে / এর ব্যবহারকে আর্দশ চিহ্ন বলা হয় এবং স্বীকৃত।
•সমান— ওয়েলসের গণিতবিদ রবার্ট রেকর্ড ১৫৫৭ সালে তার বই ‘দ্য ওয়েটস্টোন অব উইটে’ লিখছিলেন ইংরেজ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এবং সেই বইয়ে তিনি বার বার ‘is equals to’ লিখতে খুব বিরক্ত বোধ করেন এবং এর ফলে দুটি সমান আনুভূমিক ও সমান্তরাল দাগ (=) ব্যবহার করেন। আর এটিই পরবর্তীতে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এখন অবধি সমান বুঝাতে এই চিহ্নই ব্যবহৃত হয়।
আমরা যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ ও সমান চিহ্নের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করলেও গাণিতিক চিহ্নের সংখ্যা কম নয়। অগণিত চিহ্ন আছে। আরও কয়েকটি নিয়ে সংক্্ষেপে আলোচনা করছি। চলুন—
১৬৫৫ সালে ব্রিটিশ জন ওয়ালিস প্রথম অসীম বা ইনফিনিটি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এরপর ১৭০৬ সালে উইলিয়াম জোনস π এই পাই চিহ্নের প্রচলন করেন। ১৫২৫ সালে রুডলফ প্রচলন ঘটান স্কোয়ার রুট বা বর্গমূল চিহ্নের, এবং বীজগণিতের প্রথম জার্মান পাঠ্যবইটি তারই লেখা। এছাড়াও sin, cos, tan এর ব্যবহার প্রথম শুরু করেন ইউলার, আনুমানিক ১৭৪৮-১৭৫৩ সালে। এরপর ১৮০৮ সালে ক্র্যাম্প ফ্যাক্টোরিয়াল চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন ‘!’-কে।
আরো পড়ুন: বিশ্ব গণিত আসরে ব্রোঞ্জপদক পেল বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা!
এই যে আমরা বিভিন্ন গাণিতিক চিহ্ন ব্যবহার করি। এগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অজস্র ম্যনুষের হাত ধরে বিভিন্ন বাধা ও শ্রমের দ্বারা বিবর্তিত হয়ে আজকে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। আমাদের জীবনকে করেছে সহজ ও সুন্দর। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী এই সব চিহ্নকে আর্দশ হিসাবে ব্যবহার করতে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমানে আইএসও বা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অভ স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন। আমরা এতো সহজ জীবন পেয়ে অনায়াসে ভুলে যাই অতীত বা এই সহজ জীবনে যাদের ভূমিকা তাদেরকে। আপনি যদি এই গাণিতিক চিহ্নগুলো একবারের জন্যও ব্যবহার করেন তবে অবশ্যই আজকের এই আর্টিকেলটি আপনার কাছে অন্য রকম এক আশ্চর্য বা গুপ্তধনের মতো মনে হবে।
আর আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই অন্যদের সাথে শেয়ার করবেন এবং আপনি যদি এই ধরনের আরও আর্টিকেল পেতে চান, তবে অনুলিপির সাথেই থাকুন।
বাংলাদেশেসহ বিশ্বের সকল খবর সবার আগে জানতে অনুলিপির সাথেই থাকুন।