ক্যাম্পাসফিচারশিক্ষা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি!

বাংলাদেশের যতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তারমধ্যে আয়তনে সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালের দিক দিয়ে এটি দেশের ৩য় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৬ সালে মোট ২১১০ একর জায়গা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। চলুন আজ জেনে নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানা অজানা সব তথ্য।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় আজ থেকে প্রায় ১০১ বছর আগে ১৯২১ সালে। সে বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এরপর দীর্ঘ ত্রিশ বছর দেশে নতুন কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৩ সালে উত্তরের মানুষ পায় নতুন এক বিদ্যাপীঠ তথা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় । তারপর ধারাবাহিকভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলেও একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিলে ১৯৬৬ সালের ১৮ই নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জোবরা নামক গ্রামে  প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ইতিহাস:

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টিত হয়। সে সময় চট্টগ্রাম বিভাগে কোন বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চট্টগ্রামের অধিবাসিরা স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৪০ সালের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন, মওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। সভাপতির ভাষণে তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ নির্মাণের কথা জানান এবং একই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ভূমি ক্রয় করেন। এর দুই বছর পর, ১৯৪২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। তবে নানান কারণে এ দাবি পূরণ হয়নি।

পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মানের স্থান হিসেবে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম কলেজকে সম্ভাব্য ক্যাম্পাস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬২ সালে, তৎকালিন পূর্ব-পাকিস্তানের জনশিক্ষা উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেন। একই বছর, ১৯৬২ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ফজলুল কাদের চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাধারণ প্রতিশ্রুতি দেন। এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হওয়ার পর, ১৯৬১ সালের ৭ মে চট্টগ্রামের নিবাসির উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম হলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে ৩০ ডিসেম্বর, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ নামে আরেকটি পরিষদ গঠিত হয়। এই সকল সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ ও স্মারকলিপি প্রদান, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি, সেমিনার অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬২ সালের ৯ ডিসেম্বর লালদিঘী ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালের ৮ জানুয়ারি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালিত হয়।

আরও পড়ুন# বলপয়েন্ট কলম যেভাবে এলো!

১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর, ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার মনোনীত হন। প্রথমদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে স্থাপনের পরিকল্পনা করা হলেও ১৯৬৩ সালের ১২ ডিসেম্বর, রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের অনুপস্থিতিতে মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে সভাপতিত্বকালে ফজলুল কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী এ.টি.এম মোস্তফাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি কুমিল্লার পরিবর্তে চট্টগ্রামে স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর এম ওসমান গণিকে চেয়ারম্যান এবং ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা, ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, এম ফেরদৌস খান ও ডক্টর মফিজউদ্দীন আহমদকে সদস্য নির্বাচিন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম পট্টি মৌজার নির্জন পাহাড়ি ভূমিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে সুপারিশ করে। ১৯৬৪ সালের ১৭-১৯ জুলাই পাকিস্তানের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ফজলুল কাদের চৌধুরীর সভাপতিত্বে ইসলামাবাদে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’-এর সুপারিশের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহণ এবং এর চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করা হয়। ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রাক্তন কিউরেটর ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প-পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর আজিজুর রহমান মল্লিককে চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৩নং সড়কের ‘কাকাসান’ নামের একটি ভবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের অফিস স্থাপন করেন। ১৯৬৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর, এক সরকারি প্রজ্ঞাপনবলে তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা পরিদপ্তরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমস্ত কর্মকর্তা কর্মচারীকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প অফিসে বদলি করা হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ‘বাস্তকলা’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাষ্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। প্রাথমিকভাবে ১টি দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন, বিভাগীয় অফিস, শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারে জন্য একতলা ভবন তৈরি করার পাশাপাশি শিক্ষক ও ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়।

প্রাথমিকভাবে ১টি দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন, বিভাগীয় অফিস, শ্রেণিকক্ষ ও লাইব্রেরির জন্য একতলা ভবন তৈরি করা হয়। শিক্ষক ও ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়।

১৯৬৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ড. এ. আর. মল্লিককে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আব্দুল মোনেম খান। প্রথমে কলা অনুষদের অন্তর্গত বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি বিভাগে ২০০ জন শিক্ষার্থী এবং ৭ জন শিক্ষক নিয়ে ১৯৬৬ সালের ২৮ নভেম্বর এম.এ প্রথম পর্ব (প্রিলিমিনারি) ক্লাস শুরু হয়।

অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম:

বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় -এ ৭টি অনুষদ- কলা, বিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, সমাজবিজ্ঞান, আইন অনুষদ, ফ্যাকাল্টি অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারীজ ও জীববিজ্ঞান অনুষদ। আছে ৫টি ইনস্টিটিউট- চারুকলা ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস, সমাজবিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ও ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস সায়েন্স এন্ড ফিজিক্যাল এডুকেশন। ১টি অধিভুক্ত অনুষদ- চিকিৎসা অনুষদ। ২টি অধিভুক্ত ইনস্টিটিউট- ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফ থালমোলজি, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ এবং ১১টি অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে।

খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড:

পড়াশুনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড,  খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিএনসিসি,  রোভার স্কাউট-সহ বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে।

এই বিশ্ববদ্যালয়ে রয়েছে প্রথম-আলো বন্ধুসভা, এডভেঞ্চার ক্লাব, হিস্ট্রি ক্লাব, উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ, নিরাপত্তা মঞ্চসহ অনেক ক্লাব ও সংগঠন। এসব সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সমাজসেবা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:

এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে। অপূর্ব বৃক্ষরাজি, বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছে ভরপুর এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্যে রয়েছে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। আছে কলা অনুষদের পেছনের প্রাকৃতিক ঝর্ণা, চালন্দা গিরিপথ, পাম বাগান ও এর পার্শ্ববর্তী প্রাকৃতিক লেক। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা এই ক্যাম্পাসে দেখা মিলবে অনেক প্রজাতির বন্য প্রাণির। এদের মধ্যে রয়েছে কয়েক প্রজাতির সাপ, বন মোরগ, সজারু, বন্য শুকর ও মায়া হরিণ। এসব প্রাণিরা ক্যাম্পাসের ভেতরকার বিভিন্ন পাহাড় ও জঙ্গলে বসবাস করে।

কলা অনুষদের পেছনের প্রাক্কৃতিক ঝর্ণা
কলা অনুষদের পেছনের প্রাকৃতিক ঝর্ণা
পাহাড় ঘেঁষা বঙ্গুবন্ধু হল
পাহাড় ঘেঁষা বঙ্গুবন্ধু হল       ছবি: আফরিদা অপি

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদে রয়েছে ড. আবদুল করিম ভবন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদে ড. মুহাম্মদ ইউনুস ভবন, আইন অনুষদে এ কে খান ভবন। এছাড়াও জিরো পয়েন্টে স্মরণ চত্ত্বর, জয় বাংলা চত্ত্বরে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও জয় বাংলা ভাষ্কর্য।  আছে জামাল নজরুল ইসলাম ভৌত গবেষণা কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং কলা অনুষদের সামনে অবস্থিত স্বাধীনতা ম্যুরাল ও একটি সুবিশাল লাইব্রেরি। প্রশাসনিক ভবনের সামনে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাশে রয়েছে একটি মিলনায়তন (পরিত্যক্ত) এছাড়াও ছেলে ও মেয়েদের জন্যে রয়েছে পৃথক পৃথক হল। আছে বিভিন্ন অনুষদের পার্শ্ববর্তী ঝুপড়ি।

জয় বাংলা ভাস্কর্য
জয় বাংলা ভাস্কর্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়   ছবি:আফরিদা অপি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার ছবি: আফরিদা অপি

শাটল ট্রেন:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ হলো শাটল ট্রেন। পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে নিজস্ব শাটল ট্রেন। প্রতিদিন বিভিন্ন সময়ে মোট দু’টি ট্রেন ক্যাম্পাস থেকে ২২ কিলোমিটার দূরবর্তী চট্টগ্রাম শহরে ও শহর থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করে। এই ট্রেনের মাধ্যমেই শহরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করে। এই ট্রেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিচালনা করলেও সময়সূচী নির্ধারণ ও পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

 

শাটল ট্রেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শাটল ট্রেন্, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: 

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র কর্মচারী সকল পেশার মানুষই মুক্তিযুদ্ধে  একাত্তরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মহানায়কেরা ক্যাম্পাসে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা গেছে, বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে চবির কমপক্ষে ১৫ জন মতান্তরে আরো অনেক শিক্ষক, ছাত্র-কর্মচারী শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে একজন বীরপ্রতীক খেতাবেও ভূষিত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ থেকেই। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ডাক শুনে পরের দিনই তৎকালীন চবি উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান (এ. আর.) মল্লিকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের শ্রেণীকক্ষে (বর্তমানে চবি স্কুল) একটি সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এ সংগ্রাম পরিষদ আলাওল হলকে ঘাঁটি করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। এ প্রতিরোধ চলে ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত।  ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেৃতেৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন। পরে ২৫ ডিসেম্বর তাঁরা পাক হানাদারদের হাত থেকে ক্যাম্পাস মুক্ত করেন। এ যুদ্ধে বিজয় অর্জনে চবির ১৫ জন শহীদ হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তলে ধরা হলো পাঠকদের উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুন# নকশি পাখা: সুতোয় গাঁথা স্বপ্ন যেন!

শহিদ আবদুর রব: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ হচ্ছেন তৎকালীন চাকসুর সাধারণ সম্পাদক শহীদ আবদুর রব। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের পরদিন অর্থাৎ ৮ র্মাচ এ সাহসী তরুণ নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযুদ্ধাদের ভারতে পৌঁছে দেওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ অথচ সাহসী দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ একটি প্রশিক্ষণার্থী দলকে একটি জিপে করে রামগড় পৌঁছে দেবার পথে পাক হানাদারদের অ্যামবুশে দিলিপ চৌধুরী সহ শহীদ হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর অক্ষয় স্মৃতিকে অম্লান করার জন্য তাঁর নামে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করেছে।

শহিদ অবনীমোহন দত্ত: এই মহান শিক্ষক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগ খোলার প্রবল বাসনা নিয়ে তিনি দর্শনের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। কিন্তু পাক বাহিনী তাঁর এ বাসনাকে পূর্ণ হতে দেয়নি। মুক্তিযোদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের যোগান দিতেন নিজ গৃহ থেকে। তাছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শত্রুপক্ষের অবস্থানের নির্ভুল সংবাদ পৌঁছে দিতেন। অবনীমোহন দত্ত একাত্তরের দালালদের বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ৮ মে ১৯৭১ তাঁকে এক আত্মীয়সহ ক্যান্টনমেন্ট ডেকে নেওয়া হয়, সেই থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি।

শহিদ ফরহাদ: ইতিহাস বিভাগের এম, এ শেষ বর্ষের ছাত্র ফরহাদ ১ নম্বর সেক্টরে মেজর জিয়ার অধীনে কক্সবাজার মুক্তিবানীতে যোগ দেন। আলবদররা ফরহাদ ও তার সঙ্গীদের হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সেদিন খুরুসকূল খালের চরে সবাইকে দাঁড় করিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। ফরহাদের বুকের ডান পাশে গুলি লাগে। তাকে মৃত ভেবে অন্যদের সাথে বালি চাপা দেওয়া হয় । সেখান থেকে উঠে এসে কোথাও আশ্রয় না পেয়ে মসজিদে আশ্রয় নেন তিনি। তাঁকে মসজিদে দেখে এক আলবদর সদস্য ক্যাম্পে খবর পৌঁছায়। পরে পাক সেনা ও দালালরা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে মসজিদ থেকে বের করে নির্মমভাবে হত্যা করে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানিতে ভাসিয়ে দেয়।

শহিদ খন্দকার এহসানুল হক: এম কম শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র এহসানুল হক চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার হতে অস্ত্রলুট করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর বোন মুশতারী শফি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ৭ এপ্রিল ১৯৭১ পাক বাহিনী তাদেও গতিবিধি লক্ষ্য করে গভীর রাতে তাদের বাড়ি ঘেরাও করে। শিশু সন্তানদের কান্নার কারণে মুশতারী শফিকে ছেড়ে দিলেও স্বামী ডা: শফি ও ভাই খন্দকার এহসানুল হক আনসারীকে ট্রাকে তোলা হয়। সেই থেকে তাঁরা আর স্বাধীন বাংলার বুকে আর ফিরে আসেনি।

শহিদ মোহাম্মদ হোসেন: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র বীরপ্রতীক বীরত্ব খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন চট্টগ্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান। তিনি ছিলেন আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। যার কারণে তিনি নৌ-কমান্ডো আক্রমণের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ১৬ মে ১৯৭১ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও জাহাজ বিধ্বংসী মাইন নিয়ে কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত পাক জাহাজে আক্রমণ করেন। তাঁর সে অভিযান সফল হয়েছিল কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেন নি। যখন তাঁর ছিন্ন-বিছিন্ন লাশ ভেসে উঠেছিল তখনও তাঁর কোমওে বাধাঁ ছিল জাহাজ বিধ্বংসী লিম্পেট মাইন।

আরও পড়ুন# বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের চিত্রকথা!

শহিদ আবুল মনসুর: ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সংগ্রামী সাথী আবুল মনসুর ছিলেন রাজনীতি বিজ্ঞানের এমএস এস ক্লাসের ছাত্র। তিনি মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করার দায়িত্বে ছিলেন। ২৩ নম্বেভর ১৯৭১ আলবদর বাহিনী তাঁকে তার বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

এরা ছাড়াও আরো অনেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ করেছেন। যাদের মধ্যে গণিত বিভাগের ছাত্র ভুবন, বাংলার মোহাম্মদ হোসেন, মনিরুল ইসলাম খোকা ও মোস্তফা কামাল, অর্থনীতির আব্দুল মান্নান ও নাজিম উদ্দিন খান, ইংরেজির আশুতোষ চক্রবর্তী, সমাজতত্ত্বের ইফতেখার উদ্দিন, প্রকৌশল দপ্তরের প্রভাস কুমার ও সৈয়দ আহমদ শহীদ হন। এছাড়াও আরো অনেকের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণ চত্ত্বরে (জিরো পয়েন্ট) নির্মিত হয়েছে একটি ভাস্কর্য।

স্মরণ চত্ত্বর
স্মরণ চত্ত্বর

এক নজরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়:

প্রাতিষ্ঠানিক নাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৬৬

আয়তন: ২১১০ একর

উপাচার্য: শিরিন আখতার

প্রক্টর: রবিউল হাসান ভূঁইয়া

মোট শিক্ষক: ৮৭২ জন

মোট ছাত্রছাত্রী: ২৭৫০০ জন

ওয়েবসাইট: www.cu.ac.bd

বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বৃহত্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের নানান দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা নিজেদের অর্জিত মেধা কাজে লাগিয়ে সুনাম বয়ে আনছে। দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এছাড়া ড. জামাল নজরুল ইসলাম, শিল্পী মর্তুজা বশীর, সৈয়দ আলী আহসান (জাতীয় অধ্যাপক), সাহিত্যিক আবুল ফজল, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক আহমদ শরীফ, নদী গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া, ফজলে কবির (গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক), মেয়র আনিসুল হক, মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ প্রমুখ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/শিক্ষক ছিলেন।

উপসংহার:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস। এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিন জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে এমনটাই প্রত্যাশিত।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।