স্বাস্থ্য

ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়ার কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা!

মুখের একপাশ বেঁকে গেছে জনপ্রিয় গায়ক তাসরিফ খানের! ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়ার আসলে কারন কি? জেনে নিন এর লক্ষণ ও চিকিৎসা!

এইতো কিছুদিন আগে দেশের জনপ্রিয় গায়ক তাসরিফ খান তার ফেসবুকে একটি পোষ্ট এর মাধ্যামে জানালেন তার মুখে ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা মুখের একপাশ বেঁকে গিয়েছে। এ নিয়ে অনেকে জানতে চেয়েছেন এই রোগ আসলে কি। চলুন ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়ার কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নেই..

হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, হঠাৎ আপনার মুখ একদিকে বেঁকে গেছে। কিছুতেই কুলি করতে পারছেন না, পানি ঠোঁট বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে, চোখ ও বন্ধ করতে পারছেন না! কী ভয়ংকর পরিস্থিতি হবে তখন, কেমন অনুভূতি হবে ভাবলেই সিউরে ওঠছেন বুঝি। এটা এমনই একটি রোগ যার নাম ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়া। আজকে আমরা জানব- ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস কী? এটি হওয়ার কারণ কী? এর লক্ষণ কী? এবং ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস এর চিকিৎসা কী?

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস কী?

ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়া এক ধরনের প্যারালাইসিস৷ সাধারণত আমাদের সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভটিকে ফেসিয়াল নার্ভ বলা হয়। যখন এই নার্ভ আংশিক বা পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে যায়, তখন একে ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বলে। এই ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগটি প্রথম আবিষ্কার করেন জন বেল নামক একজন। আর এইজন্য এই রোগকে বেলস পলসি বা ফেসিয়াল পলসিও বলা হয়ে থাকে।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস কি সম্পূর্ণ ভালো হয়?

ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস হলে মুখের পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যা বা মুখের একপাশে প্যারালাইজড হয়ে যায়। এই রোগ সাধারণত মুখের মাংসপেশীর সাথে যুক্ত থাকা স্নায়ুগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে হয়। তবে এই পেশীগুলো স্থায়ী ভাবে আক্রান্ত হয় না এবং যদি নিয়মিত চিকিৎসা করা হয়, তবে এই ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস ভালো হয়ে যায়। সাধারণত এই ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা বেলস পলসি বা ফেসিয়াল পলসি দুই হতে তিন সপ্তাহের মধ্যেই ভালো হতে শুরু করে। মূলত, ফেসিয়াল নার্ভ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার উপর নির্ভর করে এর ভালো হয়ে ওঠার সময়কাল।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস কাদের বেশি হয়?

ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস সব বয়সী নারী ও পুরুষদের হতে পারে। তবে এই রোগে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হোন। তাছাড়াও নারীদের প্রেগনেন্সির সময়, কারো ফুসফুসের ইনফেকশন থাকলে, ডায়াবেটিস থাকলে এবং পূর্বে ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগে পরিবারের কোনো সদস্য আক্রান্ত হলে, তাদের ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা ফেসিয়াল পলসি হবার ঝুঁকি বেশি থাকে।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস কী কারণে হয়?

*যদি ব্যক্তির ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে, কোনো ভাইরাল ইনফেকশন হয়।
*যদি মধ্য কর্ণে কোনো ইনফেকশন থাকে।
*ঠাণ্ডাজনিত কোনো রোগ থাকলে।
*যদি ব্যক্তির মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কোনো সমস্যা বা স্ট্রোকজনিত কোনো সমস্যা থাকে।
*মুখে কোনো টিউমার হলে।
*যদি পূর্বে কানের কোনো অপারেশন করা হয় এবং পরবর্তীতে ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি ইত্যাদি।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগের লক্ষণগুলো কী কী?

ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা ফেসিয়াল পলসি রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর মুখ সাধারণত একদিকে বেঁকে যায়। তবে, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে মুখের দুই পাশই আক্রান্ত হয়ে থাকে। এদের সংখ্যা শতকরা এক ভাগ। যেসব রোগীর এক পাশ আক্রান্ত হয়, সেই পাশের চোখ বন্ধ হয় না এবং অনবরত সেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। আবার, অনেক সময় দেখা যায় চোখ সম্পূর্ণ খুলতেই রোগীর কষ্ট হয় এবং কপাল ভাঁজ করতে পারেন না। তাছাড়াও আরও বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন: চোখে জ্বালা-পোড়া করে, অনেক সময় ড্রাই আই নামক সমস্যা হয়, কুলি করতে গেলে পানি মুখ হতে গড়িয়ে পড়ে যায়, গালের মাংস ঝুলে যায়, খাবার খেতে গেলে চিবাতে ও গিলতে কষ্ট হয়, মুখের হাসিও বেঁকে যায়, জিভ ও গলা শুকিয়ে যায়, জিভের সামনের অংশে স্বাদ অনুভূতি জমে যায়, মুখের যে পাশে আক্রান্ত হয়েছে সেই পাশে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়, চোয়াল ও মাথা ব্যথাও হয়, কথা বলতে কষ্ট হয়, ইত্যাদি।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগটি কীভাবে নির্ণয় করা যায়?

ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগটি সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং রোগীর ইতিহাস জেনে নির্ণয় করে থাকেন। তবে, অনেক সময় এই ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস নির্ণয় করতে বেশ কিছু প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস এর চিকিৎসা কী?

ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস এর চিকিৎসা এটি হওয়ার কারণের উপর নির্ভরশীল। ঠিক কী কারণে ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস হয়েছে, এর উপর নির্ভর করে মেডিসিন বা চিকিৎসা প্রদান করা হয়। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগের মেডিসিনের পাশাপাশি মূল চিকিৎসা হিসাবে দেওয়া হয় ফিজিওথেরাপি। ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু করা হলে, এই রোগের আক্রান্ত রোগী খুব দ্রুত সুস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে।
সাধারণত ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রীগে স্টেরয়েড মেডিসিন ব্যবহৃত হয়। আর যাদের ড্রাই আই সমস্যা হয় তাদের জন্য বিশেষ চোখের ড্রপ দেওয়া হয়। এছাড়াও যাদের চোখ একবারেই বন্ধ হয় না, তাদের ঘুমানোর সময় চোখে সার্জিক্যাল টেপ দিয়ে চোখ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস এর চিকিৎসা ফিজিওথেরাপি কী?

যদি ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগীর ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয়। তবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্ট চিকিৎসক রোগীর অবস্থা অনুসারে নানা ধরনের চিকিৎসা প্রদান করার পরিকল্পনা করে থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফেসিয়াল মাসল এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম, স্পিচ রি-এডুকেশন, বেলুনিং এক্সারসাইজ, ইলেক্ট্রো থেরাপি, ইত্যাদি। রোগীকে অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি থেকে ২-৩ বার ফিজিওথেরাপি নিতে হয়, এতে দ্রুত রোগী সুস্থ হয়। তবে যদি রোগীর ফেসিয়াল নার্ভ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে রোগীর সুস্থ হতে ৩-৬ মাস অবধি সময় লেগে যায়।

•ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা কী?

১।ঘরে বসেই বেশ কিছু ফেসিয়াল ম্যাসাজ করা যেতে পারে। ফেসিয়াল ম্যাসেজ করলে মুখের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে।

২|যদি রোগীর চোখ জ্বালা-পোঁড়া এবং ব্যথা হয়, তবে নরম টাওয়াল গরম পানিতে ভিজিয়ে সেঁক দিলে, রোগী আরাম পাবে। তবে, খুব বেশি গরম পানিতে টাওয়াল ভিজালে তাতে হাত ও চোখ পুঁড়ে যেতে পারে। তাই কুসুম গরম পানিতে ভেজাবেন।

৩| একটা গ্লাসে অল্প পানি নিয়ে এর ভেতর স্ট্র দিয়ে বুদবুদ তুলবেন, এতে ঠোঁটের চারদিকের মাংসপেশী শক্তিশালী হবে এবং পানি পান করতে গেলে আর গাল বেয়ে নিচে পড়বে না।

৪| ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে কথা বলতে বলুন। এতে করে রোগীর কথা বলার জড়তে কমে আসবে। আর যদি কোনো শব্দ উচ্চারণে সমস্যা হয়, তবে রোগীকে প্রথমে জোরে জোরে স্বরবর্ণগুলো উচ্চারণ করান এবং এরপর ব্যঞ্জনবর্ণ অনুশীলন করান।

৫| ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হলে রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন। এমন অস্থির না হয়ে রোগীকে রিলাক্স রাখার চেষ্টা করুন। আর রিলাক্স রাখতে রোগীকে ব্রেথিং এক্সারসাইজ, ইয়োগা ইত্যাদি করাতে পারেন।

৬|রোগীকে নিয়মিত ফিজিওথেরাপিস্টদের শেখানো ব্যায়ামগুলো গুরুত্ব সহকারে করাবেন।

৭| রোগীকে নিয়মিত ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। হেলদি ডায়েট বা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে এবং প্রচুর পানি পান করতে। এক কথায়, হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলতে হবে। এতে করে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে।

আরো পড়ুন: ক্যান্সার ধরা পড়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের

এছাড়াও এই রোগের কোনো লক্ষণ যদি প্রকাশ পায় দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। না হলে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। কেননা, ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস ঠিক কী কারণে হচ্ছে, তা না জানা থাকলে রোগীর সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। যাই হোক, আমরা ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়ার কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত অনেক কিছুই জানলাম। আজ এই পর্যন্তই, পরবর্তীতে আবারও চলে আসবো নতুন কোনো বিষয় নিয়ে। আর হ্যাঁ, আজকের আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন এবং এই ধরনের আরও আর্টিকেল পেতে অনুলিপির সাথেই থাকুন। সচেতন থাকুন এবং সুস্থ থাকুন।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।