শিল্প ও সাহিত্য

কৈশোর মনে দাগ কাটা চার বই

ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি এক অদ্ভুত নেশা জন্মেছিল। বাড়িতে শুধু বাবা একা বই পড়তেন।বাবাকে দেখেই হয়তো বইয়ের প্রতি প্রথম ভালো লাগার জন্ম নেয়। ছোটবেলায় মা গল্পের বই কিনে দিতেন, রঙ-বেরং এর সেসব বইয়ে থাকত রাজা-বাদশা আর প্রাসাদের কাহিনী, ঘুমন্ত রাজকন্যা কিংবা ব্যাঙ হয়ে যাওয়া ছোট্ট রাজকুমারের গল্প। থাকতো ডাইনি বুড়ির গল্পসহ আর কত কি।

বয়স বারো কিংবা তেরো হবার মধ্যেই আমি অনেক দেশের রূপকথার বই পড়ে ফেললাম। রূপকথার প্রতি সে এক আলাদা টান। একে একে পড়া হলো আফ্রিকার রূপকথা,জার্মানির রূপকথা, রুশদেশের রূপকথা সহ আরও কত কি। মাথায় ঝোঁক এসে পড়ল, সারা বিশ্বের সমস্ত রূপকথার বই আমার পড়া চাই। সেই থেকেই সংগ্রহ করতে শুরু করে দিলাম।

আরো পড়ুন: Cruella: সহজ সরল এক মেয়ের নিষ্ঠুর হয়ে উঠার গল্প

গল্পের বই কেনার সে সময় আমাদের একমাত্র মাধ্যম ছিল বইমেলা। বছর ঘুরে প্রতিবার বইমেলা আসলে আমার আর বাবার অপেক্ষার পালা শেষ হত। এরপর দুহাত ভরে, সারা বছরেও যাতে পড়ে শেষ করা না যায় এত এত বই নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। ছোটবেলায় পড়া বইগুলোর প্রায় সবই সুন্দর, সবই মনের মতো। যা এখনো মনে আনন্দ দেয়। তবু আলাদা করে আজ তার  মধ্য থেকে ০৪ টি বইয়ের কথা বলব।

রবিনসন ক্রুশো

একটি নির্জন দ্বীপ, একজন মানুষ আর একরাশ গাছপালা -পশুপাখি, চারধারে শুধু জল আর জল।

ভাগ্যাহত সেই মানুষটির নাম রবিনসন ক্রুসো। যার ভাষা বিনিময়ের সুযোগ নেই, অনুভূতি বিনিয়োগের স্থান নেই। যা আছে শুধু নির্জন নিরবতা, বিষন্ন একাকিত্ব।

একটি কাকাতুয়া আছে- যার নাম পোল।

যে শুধু ঘোরে ফেরে আর ডেকে বেড়ায় -রবিন ক্রুসো,রবিন ক্রুসো, তুমি কোথায়, কোথায়??

দীর্ঘ আঠাশ বছরের জীবন,এক  বিজন  দ্বীপে যিনি কাটিয়ে দেন।বেঁচে থাকার লড়াই,সংগ্রামে প্রতিদিন যুক্ত করেন নতুন অধ্যায়।

শেষের ক’বছরে ফ্রাইডেকে সখী হিসেবে পায়।চমৎকার সব ঘটনার সূত্রপাত ঘটতে শুরু করে।নরখাদক বর্বরদের হাত থেকে রেহাই পেতে শুরু হয় নতুন আর আশ্চর্য সব কাহিনী।

সেই রেশ কাটতে না কাটতেই পুরোদস্তুর নতুন লোমহর্ষক কাহিনী।দ্বীপের বন্য জগৎ থেকে পুনরায় সভ্য জগতে ফিরে আসার সব চমকপ্রদ ঘটনা আর আরেক নতুন যাত্রা।

অরণ্য,নেকড়ে, হাজার হাজার সব ভয়াল ভয়ার্ত ডাকের পাশ কাটিয়ে আত্নরক্ষার লড়াই। যার প্রতিটি পাতায় পাতায় বিস্ময়ের চমক।

আরো পড়ুন: সমবায় ব্যাংকে চাকরির সুযোগ, আবেদন করতে পারবেন ষাটোর্ধ ব্যক্তিরাও!

আর সেই দ্বীপ? সেখানে গড়ে উঠেছে বিস্তীর্ণ জনপদ। বিচিত্র সব কাহিনী নিয়ে ড্যানিয়েল ডিফো রচিত এই বিস্ময়কর চিরন্তন  কিশোর ক্ল্যাসিক আমি আজও যতবার পড়ি নিজেকেই রবিনসনক্রুসো ভেবে বসি।এই বিস্ময়কর ক্লাসিক আমার বই পড়ার আগ্রহকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল সেসময়।

ড.জেকিল ও মি.হাইড

একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধকার রবার্ট লুই স্টিভেনসন এর কোন লেখা পড়েননি এমন সচেতন কিশোর পাঠক পাওয়া বিরল। যার মৌলিক, অভিনব, স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রানবন্ত রচনাগুণে আমরা যেনো তার নাম ভুলে গিয়ে সৃষ্টচরিত্র গুলোকেই স্মরণে রাখি।স্টিভেসন সেই বিরল গোত্রের একজন শক্তিমান লেখক।যিনি ট্রেজার আইল্যান্ডের স্রষ্টা।যার অবিস্মরণীয় স্বাদ নেয়নি এমন কোনো কিশোর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

স্টিভেনসনের আরেকটি অবিস্মরণীয় কীর্তি ড.জেকিল ও মি.হাইড এর কাহিনী।অভূতপূর্ব কল্পনাশক্তি,ঘটনার নাটকীয়তা,চরিত্র নির্মাণের উজ্জ্বলতা এবং সর্বোপরি বিস্ময়কর রকমের মৌলিক কাহিনীই একে ভিন্নতা দিয়েছে।

গল্পের লোভনীয় আস্বাদন,চমৎকার আঁটসাঁট বাঁধুনি এবং জাদুকরি ভাষাই পাঠককে শেষ  পর্যন্ত পড়তে উদ্ধুদ্ধ করে।মানুষের দুটি সত্তার মতোই গল্পের  মূল চরিত্রে দ্বৈত সত্তা বিরাজমান।

সমাজের সনামধন্য ও সম্ভ্রান্ত এক ব্যাক্তিত্ব ড.জেকিল। যিনি  বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানসাধনা,গুপ্ত রহস্য  ও অতিপ্রাকৃত শক্তির রহস্য উন্মোচনে একসময় মি.হাইডে রুপান্তরিত  হন। হাইড— যিনি খুনি,অসৎ এবং কুৎসিত —সম্পূর্ণ  জেকিলের বিপরীত সত্ত্বা ধারণ করেন।

ঢাবির ঘ ইউনিটের ফল প্রস্তুত, প্রকাশ যেকোনো সময়!

সৎ চরিত্রের মি.জেকিল থেকে অসৎ চরিত্রের মি.হাইড হয়ে ওঠার মাধ্যমে লেখক মূলত  মানুষের ভেতরকার ভালো – মন্দের অবস্থান এবং যাপিত জীবনে এর প্রভাব  তুলে ধরেন।

সেসময় এই বইটিও নতুন করে এক ভাবনার সঞ্চার করতে বেশ সহায়তা করেছিল।

আনা  ফ্রাঙ্কের ডায়েরী

১৯২৯ সাল,জামার্নির মাটিতে মাথা তুলেছে হিটলার।সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তার নাৎসি বাহিনী।ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘোষণাকৃত জিহাদে পুরো দেশ লণ্ডভণ্ড।অনেক ইহুদিই জার্মানির পাট চুকিয়ে হচ্ছেন দেশান্তরি, শুধুমাত্র নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ,বেঁচে থাকার ইচ্ছায়।

এমনই এক তান্ডব আর নৈরাজ্যঘেরা পরিবেশে,পিতা অটো ফ্রাঙ্ক ও মাতা এডিথের কোল জুড়ে   এক  ইহুদি পরিবারে ১৯২৯ সালের ১২ জুন জন্ম নেন আনা ফ্রাঙ্ক। আনা ছিলেন অটো – এডিথের দ্বিতীয় সন্তান।

১৯৩৩ সালে নাৎসি বাহিনীর প্রকোপ বেড়ে গেলে দেশ ছাড়েন অটো ফ্রাঙ্ক।চলে যান হল্যান্ডে।আনা তখন মাত্র চার বছরের শিশু।

তার ঠিক ছ’ বছর পরে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।পৃথিবী দখলের স্বপ্ন নিয়ে হিটলার এগিয়ে চলছে নিজ গতিতে।  বেঁচে থাকার লড়াইয়ে  বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও জার্মানি ছেড়ে চলে যান শুধুমাত্র ইহুদি হবার দায়ে।

একসময় হল্যান্ডও নিরাপদ রইল না।১৯৪১ সালে হিটলারের নাৎসিবাহিনী হল্যান্ড দখল করে।সেখানে বসবাসরত  ইহুদিদের উপর চলে অমানবিক নির্যাতন।অসংখ্য ইহুদিদের পাঠানো হয় বন্দিশিবিরে। একসময় আনার পরিবারের উপরেও শমন জারি হয়।অর্থাত,হাতছানি দিল বন্দিশিবির। অটো ফ্রাঙ্ককেও যেতে হবে।

তবে অটো সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পরিবার সমেত  বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পালিয়ে যান এক গোপন আস্তানায় । আনা তখন তের বছর এক মাসের সদ্য কিশোরী।

তারপর পঁচিশটা মাস।

পঁচিশ মাসের অমানবিক নির্যাতনের অন্ধকার জগত থেকে শুধু ফিরে এসেছিলেন একজন,যার নাম অটো ফ্রাঙ্ক। যার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সেই পঁচিশ মাস বন্দীশিবিরে থাকা আনার ডায়েরি।

যাতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, কিশোরী আনাকে।

খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল পাঠককে বিস্মিত করা আশ্চর্য জীবনবোধ , দর্শন,ইতিহাস,ঈশ্বর, মানবচরিত্র, প্রেম- প্রকৃতি আর সমকালীন ইতিহাস ও ইহুদিদের লাঞ্চনা- যন্ত্রনা- সংগ্রাম তথা সমগ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছবি।

 

মূল লেখক:রবার্ট লুই স্টিভেনসন

অনুবাদক: আমিরুল ইসলাম

কয়েকটি মৃত্যু

 

জহির রায়হান  রচিত কয়েকটি মৃত্যু বইটি সেবার আমি প্রথম পড়েছিলাম।এর আগে আমার গন্ডি শিশুতোষ বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।এ বইটি পড়েই মৃত্যুর মতো কঠিন অথচ বাস্তব বিষয়কে বুঝতে শিখেছিলাম। নতুন করে পরিচিত হই জীবনের এ অধ্যায়ের সাথে।

মৃত্যুর মতো নিদারুণ ও শাশ্বত সত্যি আমরা প্রায়ই ভুলে যাই।দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা, পার্থিব জগতের মোহের আড়ালে মুদ্রার ওপিঠটি দেখার সুযোগ যেন ক্রোশ পথ দূরে সরে যায়।

মূলত লেখক,আমাদের পার্থিব জগৎ থেকে পরলৌকিক জগতের এ বিস্তর দূরত্বকে অসামান্য বাস্তবতার ছাঁচে ফেলে তুলে ধরেছেন।মোহ,জশ,ক্ষ্যাতি,আনন্দ,বেদনাকে ছাপিয়ে যে আরও  একটি দূর্বার পথ আছে- তাই তুলে ধরেছেন নিজস্ব আঙ্গিকে।

 

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।