গ্রন্থাগার ও এই সময়ের তরুণেরা

গ্রন্থাগার, যেখানে বন্দি থাকে মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য। সেখানে পুঁথির লেখায় থাকে মানুষকে চিরঞ্জীব করে গড়ে তোলার আমৃত্যু প্রয়াস।
যুগ-যুগান্তরের সমস্ত চিন্তাকে একীভূত করা থাকে সেখানে, মানুষ যার বন্দনা করে; সুখ আর তৃপ্ততা খুঁজে নিয়ে লাভ করে নির্বাণ। আর তাই পুঁথির এই অমূল্য উপকরণগুলো সংগ্রহ জরুরি হয়ে পরে। মানুষ তখন বিভিন্ন পুঁথি আর বই সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠা করে গ্রন্থাগার।
মূলত এই গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তারা জানার এই পিপাসাকে একটা সুসংগঠিত রূপ দেয়।
আরো পড়ুন: আবুল মনসুর আহমেদ, জীবনী ও সাহিত্য ভাবনা
তাই হয়ত রবী ঠাকুর বলেছিলেন—,”মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যেন সে ঘুমন্ত শিশুটির মত চুপ করিয়া থাকিত। তবে সেই নিরব মহাশব্দের সহিত এই কারাগারের তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবতার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।”
গ্রন্থাগার হলো মুক্তির সনদ
শিক্ষান্বেষী কিংবা জ্ঞ্যানপিপাসুদের কাছে গ্রন্থাগার এক প্রকার মুক্তির সনদ। তারা যেন খুঁজে পায় দূর্লভ ঐশ্বর্যের খনি।
হ্যাঁ ঠিক তাই, হৃদয়ের কল্লোল যখন সভ্যতার শ্বাশত ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়, সে অনুভূতি কি আর ভাষায় প্রকাশ হয়?
গ্রন্থাগার তো তাই যা অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে একই সুতোয় বেঁধে সমান্তরালে পথ চলে। গ্রন্থ পাঠে মানুষের মনে জাগে আনন্দ-বেদনার কাব্যিক ও দার্শনিক সত্যবোধ।
গ্রন্থ পাঠেই আমাদের মনে জাগ্রত হয় মায়া-মমতা, নীতি, সহানুভূতি আর প্রেম। এছাড়াও, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ভূগোল, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানার ক্ষুধা মেটায় গ্রন্থাগার।
গ্রন্থপাঠের আনন্দকে বোঝাতেই জনৈক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্তয় বলেন,”Three things are essential for life and these are books, books and books.”
বিনোদনের হাজার মাধ্যমের মাঝেও গ্রন্থপাঠের আনন্দ সবকিছুর উপরে। সারাদিনকার ক্লান্তি কিংবা অবসাদ অথবা যেকোনো জিজ্ঞাসাতেও বই আমাদের সত্যের পথ দেখায়। আর সত্য সবসময়ই নির্মল আর সুন্দর, যা মনকে প্রশান্ত করে। আলাদা এক নিজস্ব ভুবন সৃষ্টি করে যার মধ্যে আমাদের অবাধ বিচরণ।
পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন,”রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।”
কবি ওমর খৈয়াম তাই মৃত্যুর পরেও স্বর্গে গিয়ে যাতে তার পাশে একটি বই থাকে, সে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বইপড়ায় যে কি আনন্দ সে কথা শুধু বইপড়ুয়ারাই জানে। যে আনন্দের ভুবনে চারিদিক ঝলমলে হয়ে ওঠে।আলোকরাশিতে ভরে যায় নিজ অন্তরআত্না।
না জানা গ্রন্থাগারের ইতিহাস
গ্রন্থাগারের ইতিহাস বেশ পুরনো। সংহত এবং ক্রমবর্ধমান এ দুটি ভাগে গ্রন্থাগারকে ভাগ করা হয়। সংহত গ্রন্থাগার নির্দিষ্ট গ্রন্থসম্ভারের মধ্যে সীমিত থাকলেও ক্রমবর্ধমান গ্রন্থাগারের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।
বর্তমানে গ্রন্থাগারের যে ধারণা কিংবা ধারা আমরা দেখি তা বেশিরভাগ ক্রমবর্ধমান গ্রন্থাগারেরই ভাগ মাত্র।
ধারণা করা হয়, প্রাচীন রোমেই সর্বসাধারণের জন্য গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল। তবে এর আগেও গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যাবিলনের ভূগর্ভ খনন করে আবিষ্কৃত হয়েছে সাড়ে চার হাজার বছরের পূর্বেকার এক গ্রন্থাগার। এছাড়াও সন্ধান মিলেছে খ্রিস্টপূর্ব ছ’শ অব্দের আগে আসিরিয়ার রাজা আশূর্বানিপাল এর নিজস্ব গ্রন্থাগারের সঞ্চিত পোড়ামাটির গ্রন্থ।
খ্রিস্টপূর্ব চারশো অব্দে আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল গ্রীক শাসনকর্তা টলেমি প্রতিষ্ঠিত প্রাচীনকালের বৃহত্তম গ্রন্থাগার। তবে গ্রন্থাগারের প্রথম ধারণা দেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার।
আরো পড়ুন: কাশ্মীর আসলে কার?
মধ্যযুগের প্রায় সকল জাতিই বেশ উন্মাদ মানসিকতায় ভুগতেন। তাদের মধ্যে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার এক প্রবল উন্মাদনা ছিল। তাদের হিংস্রতায় সেসময় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
হাজার বছরের সংগৃহীত দুর্লভ সম্পদ, মানুষের সাধনার সব অমর কীর্তি নিমিষেই ভস্মীভূত করে দেওয়া হয়। তাইতো ১২০১-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে অনেকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বা বন্ধ্যা যুগ বলে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশে গ্রন্থাগার সূচনা ও অবদান
পৃথিবীতে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের সাধারণ গ্রন্থাগার এর সংখ্যা অতি নগণ্য সত্য, তবে বর্তমানে আমাদের দেশের তরুণ সমাজ গ্রন্থাগারের প্রতি ঝুঁকছে।
যা নিঃসন্দেহে অসাধারণ। স্বাধীন দেশে এ ধরণের জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যে বাড়ছে এটাই আমাদের ভবিষ্যৎকে আলোকজ্জ্বল করতে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে ১৯৫৩ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা হয় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির সহযোগিতায় শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হয়। মূলত জনগণের পাঠাভ্যাস সৃষ্টি এবং বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি- বেসরকারি গ্রন্থাগার গুলোর কার্যক্রম আরো গতিশীল করতেই ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রতিবছর পাঁচই ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বিভিন্ন প্রকাশক, পাঠক, লেখক এবং গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের দীর্ঘদিনের চাহিদার ফল এই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল বলেই তার ধারাবাহিকতায় জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
যার রেশ ধরেই দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে নতুন পুরনো সাধারণ গ্রন্থাগার দেখা যায়। সমাজের বিভিন্ন জনহিতকর সংস্থা এবং বিভিন্ন ক্লাবের সম্মিলিত প্রয়াসেই ছোট-বড় বিভিন্ন গ্রন্থাগার গড়ে উঠছে। তবে বর্তমানে এ কাজে তরুণদের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো।
স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেকেই ব্যাক্তি উদ্যোগে কিংবা শিক্ষকদের সহায়তায় নিজ নিজ স্থান থেকেই গড়ে তুলছে পাঠাগার।বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে পাঠাগার নির্মাণ শুরু হলেও তার ফল সুদুরপ্রসারি।
এতে যেমন পাঠক আকৃষ্ট হচ্ছে,তেমনি নতুন করে পাঠ্যবইয়ের বাহিরেও যে আরেক জগৎ আছে শিক্ষার্থীরা তা অনুধাবন করতে পারছে।সারাদেশে তরুণ তথা ছাত্রসমাজের হাত ধরে তৈরি হওয়া এমন কিছু পাঠাগারের তালিকা তুলে ধরছি।
ছাত্রসমাজের হাত ধরে নির্মিত কিছু গ্রন্থাগার
১/রানীগঞ্জ পাঠাগার, ত্রিশাল।
২/মিলন স্মৃতি পাঠাগার,জামালপুর।
৩/গ্রাম নিখাই পাঠাগার,জামালপুর।
৪/খসরুজ্জামান চৌধুরি পাঠাগার।বিয়ানিবাজার, সিলেট।
৫/শশীভূষন পাঠাগার।চরফ্যাশন, ভোলা।
৬/বগুড়া,সোনা তলা উন্মুক্ত পাঠাগার।
৭/ইচ্ছা উন্মুক্ত পাঠাগার।গাজিপুর।
৮/লক্ষীপুর,গন্ধর্ব্যপুর শুভেচ্ছা পাঠাগার।
৯/উদ্দীপন পাঠাগার,গাইবান্ধা।
১০/লক্ষীপুর জ্ঞ্যানকুটির পাঠাগার।
১১/ পাঠশালা রাঙগুনিয়া পাঠাগার।
১২/বাতিঘর আদর্শ পাঠাগার।টাংগাইল।
১৩/বীর শহীদ মোস্তফা কামাল পাঠাগার।
১৪/জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা পাঠাগার
মিরপুর -২
১৫/আলোর দিশা পাবলিক পাঠাগার।ঠাকুরগাঁও।
১৬/মাজালিয়া গনপাঠাগার।জামালপুর।
১৭/জাগ্রত আছিম গ্রন্থাগার, ফুলবাড়িয়া,ময়মনসিংহ।
১৮/ইস্টিশন পাঠাগার।ময়মনসিংহ
১৯/ আল-ফালাহ পাঠাগার।নোয়াখালী
২০/বোধিগ্রন্থাগার।উখিয়া,কক্সবাজার।
২১/আলোঘর পাঠাগার।সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী।
২২/গ্রন্থকুটির পাঠাগার।কুড়িগ্রাম।
২৩/নারায়ন মিস্ত্রী গ্রন্থাগার।ঝালকাঠি।
২৪/চন্দন হেয়ার কাট অনু পাঠাগার।
২৫/দক্ষিন চর আইচা গ্রন্থাগার। চরফ্যাশন, ভোলা।
২৬/আলহাজ্ব আমজাদ হোসেন জ্ঞ্যানদ্বীপ পাঠাগার।রংপুর।
২৭/হোয়াইক্যং কেন্দ্রীয় পাঠাগার। ঝাউতলা,কক্সবাজার।
২৮/মাস্টার ফাহিমা বেগম স্মৃতি পাঠাগার।চট্টগ্রাম।
গ্রন্থাগারের প্রতি তরুণদের আগ্রহ
সমাজের ভিন্ন পেশা কিংবা বয়সের পাঠকেরও এখানে কমতি নেই, একসময় যারা নানান কারণে তাদের বই পড়ার ইচ্ছাকে আর প্রাধান্য দিতে পারেন নি, তারাও আজ নতুনদের সাথে যেন কাঁধ মিলিয়ে চলছে।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠাগারেও সংযোজন হচ্ছে নতুন বই,নতুন পাঠক। এক্ষেত্রে চাহিদা মাফিক তেমন বই না থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই সেগুলো উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছে। পাঠ্যবইগুলোর বাহিরেও সব ধরনের বই রাখা হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মনের খোরাক জোগাচ্ছে।
নতুন পাঠক তৈরি এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতেই ক্ষুদ্র পরিসরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন দিবসকে ঘিরে সারাদেশে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার অঙ্গনগুলো নানামুখী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। তুলে ধরছে গ্রন্থপাঠের তাৎপর্য, যা সত্যিই অভূতপূর্ব আয়োজন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থাগারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি আমাদেরকে একটি রুচিসম্মত ও জ্ঞ্যানে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সমাজহিতৈষীগণ।
জান্নাতুল ফেরদৌস, পরিচালক
দুর্দিন ম্যাগাজিন বইঘর