ইতিহাসফিচারবিখ্যাত জায়গা

পিরামিড: মনুষ্যনির্মিত সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম বিস্ময়!

আপনি কি জানেন পিরামিড কী? পৃথিবীতে মানবসৃষ্ট যে ক’টি স্থাপনা সপ্তাশ্চর্যের বুকে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় স্থাপনাটি হলো পিরামিড। প্রিয় পাঠক, চলুন আজ জেনে নিই পিরামিডের ইতিবৃত্ত। সেই সাথে চলুন, অজানা কিছু রহস্যের সমাধানের পথ খুঁজে বের করি।

পিরামিড

পিরামিড মূলত এক ধরনের ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক নকশা। এই নকশার ভূমি হয় একটি বহুভুজাকৃতির ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রের প্রতিটি বাহু থেকে ত্রিভুজাকার ক্ষেত্র উপরের দিকে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। এর ফলে যে ত্রিমাত্রিক অবয়ব তৈরি হয়, তাকেই বলা হয় পিরামিড।

মিশরের পিরামিড:

খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর আগে প্রাচীন মিশরীয় শাসকদের বলা হতো ফারাও নামে। প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের ধারণা ছিলো মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে মানুষ আবারও জীবিত হয়। আর তাদেরকে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে সহজ করতেই তাদের মমি করে রাখা হতো। তারপর বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, ধনসম্পদ, পোষা প্রাণি ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিশপত্র সহ সেই মমি কফিনে ভরে পিরামিডের ভেতর রেখে আসার প্রচলন ছিলো। তাই মিশরের পিরামিডগুলো ছিলো মূলত ফারাওদের সমাধিক্ষেত্র। ফারাও তথা রাজপরিবারের সদস্য ছাড়াও রাজ দরবারের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি ও পুরোহিতরা মমি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতেন। এখন পর্যন্ত মিশরে মোট ১১৮ টি ছোট বড় পিরামিড তথা সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হয় মিশরে অনাবিষ্কৃত এমন আরও অসংখ্য পিরামিড রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় পিরামিডটির নাম ‘গ্রেট পিরামিড অব গিজা’ বা গিজার পিরামিড। এই পিরামিডের উচ্চতা ৪৮১ ফুট। একে খুফুর পিরামিডও বলা হয়।

গিজার পিরামিড:

মিশরের সবচেয়ে বড়, পুরোনো এবং আকর্ষনীয় পিরামিড হচ্ছে গিজার পিরামিড যা খুফু’র পিরামিড হিসেবেও পরিচিত। এটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক ১ লাখ। পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল বিশাল পাথর খন্ড দিয়ে। পাথর খন্ডের এক একটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মত। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর দুরান্তের পাহাড় থেকে। পাথরের সাথে পাথর জোড়া দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হতো। চার হাজারের বছরের পুরানো এক সমাধিতে অঙ্কিত এক চিত্রে দেখা যায় এক বিশাল স্তম্ভকে স্লেজে করে সরানো হচ্ছে। অনেক মানুষ রশি দিয়ে সেই স্লেজ টেনে নিচ্ছে। আর তাদের মধ্যে একজন পাত্র থেকে জল ঢালছে বালির উপরে। এতে ঘর্ষণ প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আড়াই টন ওজনের এক একটা ব্লক। অনেকেই ধারণা করেন গিজার পিরামিড তৎকালীন সময়ের মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। গিজার পিরামিডটি ভীনগ্রহ বাসী তথা এলিয়েন কর্তৃক নির্মিত এমনটিও মনে করে থাকেন অনেকেই। যদিও বিজ্ঞানীরা সেসব মতবাদকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। উঁচু দালান বা স্কাই স্ক্র‍্যাপার নির্মানের আগে গিজার এই পিরামিডটিই প্রায় ৬৯০০ বছর ধরে মানব নির্মিত সবচেয়ে উঁচু স্থাপনার জায়গাটি দখল করে রেখেছিল।

গিজার পিরামিড
গিজার পিরামিড

মেসোপটেমীয় সভ্যতার পিরামিড:

প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার অধিবাসীরা সর্বপ্রথম পিরামিড আকৃতির স্থাপনা তৈরি করেছিল। এদের জিগুরাত নামে ডাকা হত। প্রাচীনকালে এদের উজ্জ্বল সোনালী/তামাটে রঙ করা হতো। যেহেতু এদের রোদে শুকানো কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল তাই এদের খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। স্থানীয় ধর্মের জন্য সুমেরীয়, ব্যাবিলনইয়ান, এলামাইট,আক্কাদীয় এবং আসিরীয়ানরা জিগুরাত বানাতো। প্রতিটি জিগুরাত একটি মন্দির কমপ্লেক্সের অন্তর্গত ছিল যেখানে অন্যান্য স্থাপনাও থাকত। জিগুরাতের পূর্বসুরী উত্তোলিত মাচা যা চার হাজার খ্রিস্টপূর্বের উবাইদ আমল থেকে বিদ্যমান। সবচেয়ে প্রাচীন জিগুরাতগুলো নির্মাণ শুরু হয়েছিল প্রাথমিক সুমেরীয় সভ্যতার শেষ দিকে। আর সর্বশেষ মেসোপটেমীয় জিগুরাত ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বের।

আরও পড়ুন# মঙ্গলপুর: জন-মানবশূন্য এক গ্রামের গল্পকথা!

বর্গাকার,ডিম্বাকার অথবা আয়তাকার ভিত্তির উপর ক্রমহ্রাসমান স্তরে স্তরে তৈরী জিগুরাত ছিল একটি পিরামিড আকৃতির স্থাপনা, যার চূড়া ছিল সমতল। জিগুরাত এর কেন্দ্র হত রোদে পোড়ানো ইটের তৈরি, আর এর সম্মুখভাগ ছিল আগুনে পোড়া ইট মোড়ানো। এদের সম্মুখভাগ প্রায়ই বিভিন্ন রঙের প্রলেপ দেয়া থাকত, যা জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত গুরুত্ব বহন করত। মাঝে মাঝে রাজারা তাঁদের নাম এসব রাঙানো ইটে নিজেদের নাম অঙ্কন করে রাখতেন। স্তরের সংখ্যা দুই থেকে সাতের মাঝে উঠা নামা করত। এটা ধরে নেওয়া হয় যে এদের চুড়ায় মন্দির থাকত। কিন্তু এর পক্ষে কোন ভূতাত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় না এবং একমাত্র লিখিত প্রমাণ হচ্ছে হেরোডোটাস। মন্দিরে প্রবেশ করার পথ ছিল জিগুরাতের এক পাশে সারি সারি সিঁড়ি অথবা এর চারদিক ঘেরা সর্পিল সিঁড়ি যা তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত থাকত। মেসোপটেমিয়ান জিগুরাত সাধারণ মানুষের উপাসনা বা অনুষ্ঠানের জায়গা ছিল না। এদের ঐশ্বরিক বাসস্থান হিসেবে মানা হত এবং প্রতিটি নগরের নিজস্ব ঈশ্বর ছিলেন। কেবল পুরোহিতরা জিগুরাতের উপরে বা এর তলদেশের ঘরসমূহে প্রবেশ করতে পারত কারণ ঈশ্বরদের দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। সুমেরীয় সভ্যতায় পুরোহিতরা বেশ প্রভাবশালী সদস্য ছিল।

গুইমারের পিরামিড:

গুইমারের পিরামিড স্পেনের টেনেরিফে অবস্থিত বিখ্যাত একটি স্থাপনা। পিরামিডটি এই দ্বীপের একটি জনপ্রিয় আকর্ষণ।  সারা বিশ্বে বিন্দুযুক্ত অন্যান্য পিরামিডগুলির থেকে ভিন্ন, তবে, তারা বিশেষভাবে প্রাচীন নয়। এই পিরামিডগুলো ১৯ শতকের গোড়ার দিকে আবিষ্কৃত হয়।

গুইমারের পিরামিড
গুইমারের পিরামিড

মায়ান পিরামিডের কথা:

প্রাচীন মায়ান সভ্যতাতেও পিরামিড তৈরির নজির পাওয়া যায়। মায়ান পিরামিডগুলি একটি বিলুপ্ত জাতিগত সভ্যতা দ্বারা নির্মিত হয়েছিল যা প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ মেক্সিকো, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, বেলিজ এবং এল সালভাদরে বাস করত। এই ভবনগুলি প্রায় 3.000 বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এবং সম্ভবত মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে বড় পর্যটন আকর্ষণ; তাদের মধ্যে দুটি ধরণের পিরামিড তৈরি করা হয়েছিল: একটি বলিদানের আচারের জন্য এবং দ্বিতীয়টি পবিত্র অনুষ্ঠানের জন্য। অনেক মায়ান পিরামিডও জনসংখ্যার জন্য ল্যান্ডমার্ক হিসেবে কাজ করার জন্য জঙ্গলের উপরে উঠেছিল।

মায়ান পিরামিড
মায়ান পিরামিড

প্রথম ধরনের পিরামিডের শীর্ষে একটি মন্দির ছিল এবং দেবতাদের বলি দিতে পুরোহিতদের সেখানে আরোহণ করতে হতো; এই পিরামিডগুলির পাশের সিঁড়িগুলি খাড়া ছিল, তবে পুরোহিতদের আরোহণের পক্ষে খুব বেশি খাড়া ছিল না। এই পিরামিডগুলির শীর্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি সংঘটিত হতো।

আরও পড়ুন# ‘৪৬০ কোটি বছর আগের’ মহাকাশের ছবি দেখল বিশ্ববাসী!

ইনকা সভ্যতার পিরামিড:

অনিন্দ্যসুন্দর এবং বিশালাকৃতির স্থাপত্যশৈলীর নমুনা দেখতে পাওয়া যায় পেরুর ইনকা সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শনে। আর এর মাঝে সবচাইতে পরিচিত বোধহয় মাচু পিচু।

এটি একটি ইনকা পিরামিড আকৃতির শহর, যা আকার আকৃতি এবং সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনেকগুনে হার মানায় মিশরীয় পিরামিডকেও। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই ৪৩০ মিটার ওপরে মাচু পিচু দাঁড়িয়ে আছে একটি বিষুবীয় পাহাড়ি বনের মাঝে। এর চারপাশের পাথুরে দেয়াল, ছাদ এবং নকশা দেখে মনে হতে পারে এটি আলাদাভাবে তৈরি করা হয়নি বরং উঠে এসেছে গাছগাছালির মাঝে থেকেই। আন্দেজ পর্বতমালার পূর্ব পাশের ঢালে অবস্থিত এই এলাকাটি ঢেকে থাকে নীল মেঘের আড়ালে।

শেষ কথা: 

পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা ও জনপদে বিভিন্ন কারণে পিরামিড নির্মিত হয়েছে। সমাধি, স্মৃতিস্তম্ভ, মন্দির ইত্যাদি নানান কাজে তৈরি করা হয়েছিল এসব পিরামিড। এই পিরামিডগুলো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। একইসাথে এসব পিরামিড বহন করে চলেছে হাজার বছরের ইতিহাস ও সভ্যতার চিহ্ন। বৈচিত্রময় নির্মাণশৈলী এসব পিরামিডকে করে তুলেছে আরও অনন্য!

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।