সেপিয়েন্স – এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড রিভিউ

সেপিয়েন্স : এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড
লেখক: ইউভ্যাল নোয়া হারারি
সেপিয়েন্স: জেমস ওয়েব বা হাবল টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের বিশালত্বকে যেমন আমাদের সামনে হাজির করেছে, তেমনি এই পৃথিবীর প্রাণ সঞ্চারের শুরু থেকে আজ অবধি মানব সভ্যতার সৃষ্টি ও বিকাশের ধারাবাহিকতা আমাদের সামনে নিয়ে হাজির করেছেন “ইউভ্যাল নোয়া হারারি” তার বিখ্যাত গ্রন্থ “সেপিয়েন্স-এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড” এর মাধ্যমে।
বাস্তবিক অর্থে এই গ্রন্থটি আজকের মানবজাতির সামনে দর্পনস্বরূপ যা আজকের হোমো সেপিয়েন্সদের সৃষ্টি ও বিকাশের নিষ্ঠুরতার সাক্ষ্য দেয়। বইটির আলোচনা ব্যাপ্তি এতটায় বেশি যে লেখক তার লেখার ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন চ্যাপটারে ভাগ করেছেন বইটিকে।
প্রস্তরযুগের আদিম মানুষ থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক হোমো সেপিয়েন্সদের ধারাবাহিক বিবর্তনকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, মানবজাতির ঐক্যবন্ধন ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এই চারটি ভাগে ভাগ করেছেন।
জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন অলিগলির মধ্য দিয়ে আলোচনা চলতে চলতে সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, উদ্ভিদ-প্রাণীর উত্থান-পতন কিসের হিসাব নেই এইখানে!
প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে জন্ম হওয়া এই পৃথিবীতে ৩৮০ কোটি বছর আগে প্রাণের সঞ্চার হয় আর প্রায় ২৫ লাখ বছর পূর্বে আবির্ভাব ঘটে আদি মানবের। কিন্তু হোমো সেপিয়েন্সদের পাশাপাশি হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ার্থান্ডাল, হোমো রুডলফেনসিস ইত্যাদি গণের মানব প্রজাতি ছিল এই পৃথিবীতে।
কিন্তু ৩০ হাজার বছর পূর্বে সেপিয়েন্সরা অন্য সকল আদি মানব গোষ্ঠীকে হত্যা করে পৃথিবীতে নিজেদের একছত্র আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। তবে হোমো নিয়ার্থান্ডালরা হোমো সেপিয়েন্সদের থেকে অনেক বেশি উন্নত ও শক্তিশালী ছিল।
কিন্তু উন্নত কল্পনা শক্তি, নিজেদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরার ইচ্ছা, নতুন নতুন স্থান আবিস্কার ও টিকে থাকার স্বার্থে নিজেদের অভিযোজন ক্ষমতা তাদেরকে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করেছে এবং টিকে রেখেছে আজও অবধি। খাদ্যের সন্ধানে ও অনুকূল পরিবেশ খুজে পাওয়ার জন্য বর্তমান পৃথিবীর সবখানেই ছড়িয়ে বেড়িয়েছে, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তর এমনকি ইন্দোনেশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া।
জীবনযুদ্ধে লড়াই করার জন্য জীবন বাজি রেখেছে। আর এইসবই অন্যান্য গোত্রদের থেকে হোমো গণই ছিল অনন্য।
লেখক বিজ্ঞান ও এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন মতাদর্শকে আলোচনা করতে লেখক পুরো একটা অধ্যায়। পশ্চিমা দেশগুলো বিজ্ঞান ও কর্পোরেশন থিউরিকে ব্যবহার করে কিভাবে বিশ্বমঞ্চে স্থান করে নিয়েছে; উপনিবেশ, পুজিবাদ, শিল্পায়নের সাথে বিজ্ঞানের বিজ্ঞাপন ও গবেষণা ফান্ডিং এর ওতোপ্রতো সম্পর্ক খুব নিখুত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই অধ্যায়ে।
গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, পুজিবাদ ইত্যাদিকে এক একটি বিশ্বাস বা ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একইভাবে কোম্পানি, সাম্রাজ্য, অর্থব্যবস্থা- সবগুলোকেই মানুষের দলবদ্ধ কল্পনার ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন লেখক।
এসবের পাশাপাশি টাকাও একটা বিরাট বড় মিথ। একটা কাগজের টুকরা। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে বলেই তার এত মূল্য। ধর্ম নিয়ে আলোচনায় টেনে এনেছেন প্রচলিত একেশ্বরবাদী, বহুঈশ্বরবাদী ও নাস্তিকতার ব্যাখ্যা।
লেখকের মতে, মানুষের বানানো রুপকথাকে বিশ্বাসে পরিনত করা এবং তা বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার পিছনে আজকে মানুষের এই সাফল্যের কারন। মাত্র কয়েকশ বছর আগেও পৃথিবীতে কোন দেশ ছিল না।
তখন ছিল সাম্রাজ্য। মিশরীয়, রোমান, অটোমান, ব্রিটিশ ইত্যাদি সাম্রাজ্যের নামেই তখন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় ছিল। আর এখন দেশভিত্তিক, জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবোধ। আর এই সব মিথের সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন গোত্র, দেশ, কোম্পানিভিত্তিক মিথ এবং সেই সব মিথকে বিশ্বাসে পরিনত করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইতিহাসই মানব সভ্যতার ইতিহাস।
ইতিহাস শেষ করেই ক্ষ্যান্ত হন নি প্রফেসর হারারি। তিনি মনোযোগ দিয়েছেন বর্তমান ও বর্তমানের নিরিখে আগত ভবিষ্যতে। সভ্যতার উন্নয়ন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি, মানবিকতার এত উন্নয়নের পরেও মানুষ যে আগের থেকে বেশি সুখী হতে পারেনি তার তাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দিয়েছেন।
জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষ যে তার ক্ষমতা বহুগুন বাড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন, অমরত্ব লাভের চেষ্টা করছেন সেসবের অবতারণা করেছেন আর সেই প্রেক্ষাপটে ফ্র্যাঙ্কেনষ্টাইনের গিলগামেশ প্রফেসি আলোচনা করতেও বাদ দেন নি।
আলোড়ন সৃষ্টি করা এই বইটির সব থেকে ভালো দিক ছিল আলোচনার পরথে পরথে ছিল ইতিহাসের ছোঁয়া, মানব জাতির সৃষ্টি ও বিবর্তনের সত্য ইতিহাস।
#আরও পড়ুন: বয়স ভেদে বদলে যাওয়া কিছু বই
আর পাঠক হিসেবে সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো ইতিহাস ও গবেষণালব্ধ সত্য তত্ত্বকে তুলে ধরতে যেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করে ফেলেছেন লেখক যা পাঠক থেকে পাঠক পার্থক্য তৈরি করতেই পারে।
তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মানব জাতির আগমন, বিবর্তন ও সম্প্রসারণ নিয়ে লেখা এই সেপিয়েন্স বইটি অবশ্যই অনন্য ও সুপাঠ্য।
দেবব্রত দাশ
সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নোয়াখালী