বিজ্ঞানস্বাস্থ্যস্বাস্থ্য ও লাইফস্টাইল

থানকুনি,র উপকারিতা ও অপকারিতা!

থানকুনি আমাদের গ্রাম বাংলার পরিচিত একটি উদ্ভিদ। বহু যুগ ধরে থানকুনির পাতাকে মানুষ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করেছে, পাশাপাশি থানকুনির ভেষজ গুনাবলীকেও কাজে লাগিয়েছে। আজকে আমরা জানব, থানকুনি কী! এর রাসায়নিক উপাদান! পুষ্টি উপাদান! থানকুনির ব্যবহার! থানকুনির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে। থানকুনি হলো এক ধরনের ছোটো বর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম সেনটেলা এশিয়াটিকা (Centella asiatica)। থানকুনি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন : আদামনি, ঢোলামনি, টেয়া পাতা ইত্যাদি। তবে এটি থানকুনি নামেই বেশি পরিচিত।

*পুষ্টি উপাদান: থানকুনিতে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যেমন: এশিয়াটিক এসিড, ম্যাডিক্যাসিক এসিড,এসিয়াতকসাইড এ, এসিয়াতকসাইড বি, ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ,পটাসিয়াম,বিটা ক্যারোটিন ,থায়ামিন, রিবোফ্ল্যাবিন,নিয়াসিন ,এসকর্বিক এসিড , ইত্যাদি।
*থানকুনির ব্যবহার: থানকুনির নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। তবে থানকুনি তার ভেষজ গুনেই বেশি পরিচিত। থানকুনিকে গ্রাম বাংলায় ঘন্ট, ভরা, ভর্তা, ভাজি কিংবা বিভিন্ন মাছের পাশে রান্না করে খাওয়া হয়। এছাড়াও, থানকুনির রস ও থানকুনি বড়ি আয়ুবের্দিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

*থানকুনির উপকারিতা: থানকুনি এমন একটি ভেষজ উদ্ভিদ। যার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। নিচে থানকুনির নানাবিধ উপকারিতা লেখা হলো:
১| চুল পড়া রোধ করে: বর্তমানে চুল পড়ার সমস্যায় নেই, এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। এই চুল পড়া রোধ করে থানকু,নি। থানকুনি পাতা থেঁতলে এর রস চুলের গোড়ায় লাগালে চুল পড়া কমে। কিন্তু, অবশ্যই পরিষ্কার চুলে থানকুনির রস লাগাতে হবে, এবং তা শুকিয়ে গেলে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। ফল পেতে সপ্তাহে দুইদিন ব্যবহার করতে হবে।
২|কাটা ও ক্ষত সারায়: কোথাও কেটে গেলে থানকুনির রস লাগালে তৎক্ষনাৎ আরাম পাওয়া যায়। এছাড়াও দীর্ঘদিনের ক্ষত সারাতেও থানকুনি বিশেষ ভূমিকা রাখে। কেননা, থানকুনি পাতায় আছে এসিয়াটোকসাইড যা কোলাজেন বৃদ্ধি করে ঘা বা কাটা ছেড়া ও জখম সারিয়ে তুলতে সহায়তা করে।

৩| হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে: থানকু,নি পাতা হজম ক্ষমতা বাড়ায়। কেননা, থানকু,নিতে আছে বিভিন্ন উপাদান যা পাকস্থলির এসিডকে নিয়ন্ত্রণ করে হজমের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে।
৪|আমশয়ের সমস্যা দূর করে: আমশয়ে সমস্যা কম বেশি আমরা সবাই পড়ি। তবে, শিশুরা বেশি এই সমস্যার মুখোমুখি হয়৷ আমাশয়ের সমস্যা হলে থা,নকুনি পেস্ট করে খাওয়ালে, আমাশয়ের প্রকোপ কমে। তবে একটানা সাতদিন এই নিয়ম মেনে চলতে হবে।
এছাড়াও আরেকটি উপায়ে থানকুনি পাতা আমাশয়ের সমস্যা কমায়। তা হলো- প্রথমে পরিমাণ মতো থানকু,নি পাতা বেটে, তার সঙ্গে অল্প করে চিনি মিশিয়ে খেলে। এটি দিনে দুই বার খেতে হবে।
৫|শরীরের টক্সিক উপাদান বের করে: আমাদের শরীরে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান প্রবেশ করে। এইসব টক্সিক বা ক্ষতিকর উপাদান যদি শরীর থেকে যথা সময়ে বের না হয়, তবে তা মারাত্মক ঝুঁকির কারন হয়। তবে, আশার কথা হলো, এইসব টক্সিক উপাদান বের করতে থানকু,নির জুড়ি মেলা দ্বায়। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে এক চমচ মধুর সাথে থান,কুনির রস খেলে তা শরীর থেকে ক্ষতিকারক উপাদান অপসারণ করে।
৬| ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ঘটায়: থানকুনি পাতায় আছে
অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিটা ক্যারোটিন, ফলিক অ্যাসিড এবং ফাইটোকেমিকাল। এইসব উপাদান ত্বকের ভেতরে পুষ্টির অভাব দূর করে এবং সানটার্ন, বলিরেখার মতো সমস্যার প্রতিকার করে। যার দরুণ ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় ও ত্বক থাকে মসৃণ। এছাড়াও থানকুনির এই উপাদনগুলো অল্পতে বুড়িয়ে যাওয়াও রোধ করে।

৭| সর্দি-কাশির সমস্যা কমায়: থানকুনি পাতা কাশির প্রকোপ কয়ায়। দুই চামচ থানকু,নির রসের সাথে অল্প চিনি মিশিয়ে খেলে কাশি কমে যায়। তবে নিয়ম করে এক সপ্তাহ খেলে, খুব ভালো উপকার মেলে।
৮| জ্বর কমায়: বিভিন্ন মৌসুম পরিবর্তনের কারনে অনেকেই জ্বরের কবলে পড়ে। এই সিজন্যাল জ্বরের প্রকোপ কমায় থান,কুনি। এছাড়াও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও এই বিষয়ে বলা আছে যে, এক চামচ থানকু,নি, এক চামচ শিউলি পাতার রস মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেলে জ্বর কমে। দুর্বলতা কমে যায়, ফলে শরীরে জোর ফিরে আসে।
৯|গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করে: আজকাল গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা যেন ডাল-ভাত। এই সমস্যা নেই এমন মানুষ পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। মজার ব্যাপার, এই সমস্যা দূর হয় থান,কুনি পাতার রস খেলে।
১০| মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়: থানকুনি পাতার রস মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায় এবং মস্তিষ্কের সকল কার্যকারিতা সচল রাখতে সহায়তা করে। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি ও শেখার ক্ষমতা উন্নত করতে থানকুনির জুড়ি মেলা ভার। এছাড়াও থানকুনিতে থাকা ফলিক এসিড মানসিক চাপ কমায়, মন প্রফুল্ল রাখে।

১১|অ্যালজাইমার রোধ করে: থানকুনি পাতায় আছে বিশেষ ওষুধি গুনাবলি যা মস্তিষ্কের স্নায়ু সচল ও সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এতে করে বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি দীর্ঘায়ু হয়। এছাড়াও বয়স বাড়ার সাথে স্মৃতি নষ্ট কারক উপাদানগুলোকে প্রতিরোধ করে অ্যালজাইমার ও ডিমেনশিয়ার মতো স্মৃতিভ্রম রোগগুলো হওয়া থেকে বাঁচায়।
১২| রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: উচ্চ রক্তচাপ রোধ বা হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রবে থানকুনি বেশ কার্যকরী। থানকুনিতে থাকা উপাদানগুলো রক্ত সঠিক মাত্রায় সঞ্চালন ও রক্তকনিকা উন্নত করে। তবে অবশ্যই থানকু,নি ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
১৩|গর্ভাবস্থার দাগ দূর করে: গর্ভাবস্থায় নারীরের ত্বক প্রসারিত হয় এবং এই সন্তান জন্ম দানের পর পেটে
প্রসারিত চিহ্ন হয়। থানকুনি ত্বকের এই পোস্টপারেটিভ স্কার্চ মার্ক রোধ করে। কেননা, থানকুনি পাতায় স্যাপোনিন উপাদানে ভরপুর, যার সহায়তায় ত্বক টানটান হয় ও সকল দাগ দূর হয়।
১৪|লিভার ভালো রাখে: থানকুনির নানাবিধ উপকারিতার মাঝে অন্যতম একটি উপকারিতা হলো থানকুনি লিভারকে সুস্থ ও সবল রাখে। থানকুনির মাধ্যমে এন্টি অক্সিডেন্ট উৎপন্ন হয়, যা ইনফ্লেমেশন কমায়।
১৫| ওজন কমাতে সহায়তা করে: ওজন হ্রাস করতেও থানকুনির রয়েছে বিশেষ গুন। তবে এই সম্পর্কে এখনো পর্যাপ্ত সফল গবেষণা নেই। কিন্তু, আয়ুবের্দিকসহ বিভিন্ন ওয়েট লস চিকিৎসাতে থানকুনি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

আরো পড়ুন: বেশি পাকা কলা খেলে কী হয়?

*থানকুনির অপকারিতা: ওপরে আমরা এতক্ষণ পড়েছি থানকুনির নানাবিধ উপকারিতা সম্পর্কে। তবে, মানতে কষ্ট হলেও সত্য; এই থানকুনির বেশ কিছু অপকারিতা রয়েছে।
১| গর্ভাবস্থা ও স্তন্যপান করার সময় থানকুনি পরিহার করা উচিত। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা বলে এই সময় থানকুনির রস খেলে তা ক্ষতির কারন হয়। কেননা, এই সময় একজন নারীর বিভিন্ন হরমোন্যাল পরিবর্তন ঘটে।
২|একটু আগেই আমরা জেনেছি যে, থানকুনি লিভার ভালো রাখে। কিন্তু, অতিরিক্ত থানকুনির রস গ্রহন করতে তা হতে বিপরীত ঘটায়। তাই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে থানকুনি ব্যবহার করা উচিত।
৩| ডাক্তাররা বলেন বিভিন্ন সার্জারি বা অপারেশনের পরে থানকুনি পাতার রস বা ট্যাবলেট না খেতে। কেননা, এতে অতিরিক্ত নিদ্রাভাব আসে। তাই সার্জির কয়েক সপ্তাহ আগে কিংবা পরে থানকুনি পাতার রস বা ট্যাবলেট ব্যবহারে সর্তক হোন।
৪|থানকুনি বিভিন্ন এলার্জিজনিত সমস্যাও ঘটাতে পারে। এর ফলে ত্বকে চুলকালি, লালচে ভান, শ্বাসকষ্ট স্পমস্যা, ঠোঁট ফুলে যাওয়া, জিভ ও গলায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই থানকুনি খাওয়া বা ব্যবহারের আগে নিশ্চিত হয়ে নিন এতে আপনার এলার্জি আছে কিনা!
৫| কিছু ওষুধের সাথে ব্যবহার করা উচিত নয়। বিশেষ করে যদি নিচের কোনো রকম ওষুধ প্রত্যেহ ব্যবহার করেন৷ যেমন:
*ক্লনোপিন, এম্বিয়ান, এটিভান ইত্যাদি ধরনের কোনো ঘুমের ওষুধ।
*লিভারের বিভিন্ন ওষুধ, যেমন : টাইলেনল,এলডোমল, কোর্দারণ, জোকোর, ডাইল্যান্টিন, ইত্যাদি।

যাই হোক, থানকুনির কিছু ক্ষতিকর দিক থাকলেও এর উপকারিতাই বেশি এবং কার্যকরী। এছাড়াও এর স্বাদ অনেকের কাছেই অতুলনীয়। তাই এত ভালো একটি উদ্ভিদের সঠিক গুনাগুন পেতে, অবশ্যই মাঝে মাঝে রসনাভোজে বা রস করে থানকুনি খাওয়া উচিত। ধন্যবাদ।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।