বিজ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

একজন মেধাবী স্টিফেন হকিং এর গল্প!

বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম একজন সেরা মেধাবী গুণী ব্যক্তি স্টিফেন উইলিয়াম হকিং কিংবা স্টিফেন হকিং। যিনি ছিলেন একজন ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী , গণিতবিদ, বিশ্বতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞান-বিষয়ক জনপ্রিয লেখক। বর্তমান সময়ে পড়াশুনা করছে, অথচ এই স্টিফেন হকিং নাম শুনেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। স্টিফেন হকিং শুনলেই সবাই বুঝতে পারে বিং ব্যাং থিওরির জনক। যার ছিল নিজস্ব বেশ কিছু মতাদর্শ। অথচ, এই মানুষটার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়ে হুইলচেয়ারে; হারিয়েছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি, অথচ তিনি থামেননি। এত প্রতিকূলতার পরও তার অর্জনের এক বিশাল ভাণ্ডার। তো চলুন, আজকে আমরা জানব, এই গুণী মানুষটার জীবনী! জানব— একজন মেধাবী স্টিফেন হকিং এর গল্প।

•জন্ম ও জন্মের ইতিহাস: স্টিফেন হকিং যুক্তরাষ্ট্রের অক্সফোর্ড ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মটা হয়েছিলো মেধাবী এক পরিবারে, রোমাঞ্চকর এক পরিবেশে। হকিংয়ের বাবা ড.ফ্রাঙ্ক হকিং ছিলেন একজন জীববিজ্ঞান গবেষক এবং অন্যদিকে হকিংয়ের মা ইসোবেল হকিং ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। তারা দুইজনই লন্ডনে বসবাস করতেন। তখন লন্ডনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। আর সেই সময়টায় একটি চিকিৎসা গবেষণাগারে পরিচয় হয় তার মা ও বাবার। মূলত তার মা সেই চিকিৎসা কেন্দ্রের একজন মেডিক্যাল সহকারী ছিলেন, অন্যদিকে সেই মেডিকেলেই তার বাবা চিকিৎসা গবেষক হিসাবে নিযুক্ত ছিল।
এরপর হকিং তার মায়ে গর্ভে আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিরাপদ থাকতে হকিংয়ের মা অক্সফোর্ডে চলে যান এবং হকিং অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহন করে। যদিও তার জন্মের পর আবার তার মা বাবা লন্ডনে ফেরত যান। তখন লন্ডনে তার বাবা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চের বিভাগ প্যারাসাইটোলজির প্রধান হিসাবে দায়িত্বরত ছিলেন।
তার পরিবারে তখন মা-বাবা ছাড়াও দুই বোন ছিল। যাদের নাম ছিল ফিলিপ্পা ও মেরি। এছাড়াও একটি পালক ভাই ছিল, যার নাম এডওয়ার্ড।

•শৈশব ও শিক্ষা জীবন: স্টিফেন হকিংয়ের শৈশব মূলত লন্ডনেই কেটেছেন। তার শিক্ষাজীবনের শুরু ঘটে লন্ডনের হাইগেটের বাইরন হাইস্কুল নামক একটি স্কুলে। তবে তিনি এই স্কুলে পড়া অবস্থায় সঠিক ভাবে পড়তে না পারার জন্য স্কুলটির শিক্ষা পদ্ধতিতে অভিযোগ করেন।
এর মধ্যে ১৯৫০ সালের দিকে তার পরিবার হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অল্যালবানসে স্থানান্তরিত হয়। আর সেখানের একটি মেয়েদের স্কুলে তিনি প্রায় ৩ বছর পড়েছেন। অবশ্য সে সময় ১০ বছর অবধি ছেলেরা স্কুলে পড়াশুনা করতে পারতো। তিন বছর পর তিনি সেই স্কুল ত্যাগ করে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি হন।৷ তবে স্কুলে তার রেজাল্ট ছিল মাঝারি ধাঁচের।

তবে হকিং এর বাবা-মা তর শিক্ষায় গুরুত্ব দিতেন। তার বাবা চেয়েছিলো হকিং বিখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে তিনি পড়াশুনা করুন। কিন্তু হকিংয়ের অসুস্থতা শুরু হলো। তিনি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে না পারায়, সেই দামী স্কুলে আর পড়াশুনা করতে পারলেন না। এটা হকিংয়ের ১৩ বছর বয়সী গল্প। তাই তিনি সেন্ট অ্যালবান্‌সে পড়াশুনা করেন। এতে হকিংয়ের উপকার ও হয় বটে, তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে রয়ে যায় এবং তাদের সাথে বিভিন্ন খেলা খেলতেন! যেমন- বোর্ড গেম, আতশবাজি, উড়োজাহাজ ও নৌকার মডেল,ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ছোট থেকেই তার বন্ধুদের সাথে খ্রিস্টধর্ম ও ইন্দ্রিয় বহিভূত অনুভূতি নিয়ে অনেক আলোচনা করতেন।
স্কুলে থাকতেই তার স্কুল শিক্ষক ডিকরান তাহতার সহায়তায় তিনি ১৯৫৮ সালে একটি কম্পিউটার তৈরি করেন। যার যন্ত্রগুলো তৈরি হয়ে পুরোনো ঘড়ির অংশবিশেষ, পুরনো টেলিফোনের সুইচবোর্ড, ও বিভিন্ন পুরোতন জিনিস দিয়ে।

এরপর আস্তে আস্তে স্কুলের প্রতি তার ভালোবাসা বাড়ে এবং তিনি স্কুলে ‘আইনস্টাইন’ নামে পরিচিত ছিল। যদিও তার প্রথমদিকে স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট খুব একটা আশানুরূপ ছিল না, তবে বিজ্ঞানের প্রতি জোঁক তার বরাবর ছিল।

আর পরবর্তীতে তিনি তার গনিত শিক্ষক তাহতার অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গনিত নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও হকিংয়ের বাবা চেয়েছিলো তার মতোই ডাক্তার বানাতে। কেননা, তখন গনিতের স্নাতকদের খুব একটা চাকুরী জুটত না এবং তার বাবা চেয়েছিল নিজের কলেজ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াতে।
তবে তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গনিতের কোর্স ছিল না, তাই হকিং ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিভাগে।

এরপর, ১৯৫৯ সালের মার্চে তিনি বৃত্তি পান, যার দরুণ তাকে পড়াশুনার খরচ নিয়ে আর ভাবতে হলো না। তখন তার আগ্রহের বিষয় দাঁড়ায়—তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।

হকিং ১৯৫৯ সালে বৃত্তি পাওয়ার পর, কয়েকমাস বাদে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে প্রথম ১৮ মাস তিনি বেশ বিরক্ত ও একাকী বোধ করে। কেননা তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা তার কাছে খুবই সহজ মনে হতো। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি বিভিন্ন বোট ক্লাবে যোগদান করে নিজেকে আরও স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ক্ষোভ ও দূর হয়।

পরবর্তীতে তিনি কেমব্রিজে স্নাতকোত্তর করতে আসেন৷ কিন্তু এখানে আসার পরপরই তিনি মটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন। ধীরে ধীরে তিনি হুইল চেয়ারের বাসিন্দা হন। যার দরুণ, কেমব্রিজের প্রথম দিনগুলোয় তার কাজ খুব একটা আশানুরূপ ছিল না। তবে কিছুটা সুস্থ হলে তিনি তার সুপারভাইজার ডেনিশ উইলিয়াম শিয়ামার সহায়তায় পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন এবং কাজে এগিয়ে যান।

•কর্মজীবন ও আবিষ্কার: যখন তিনি কলমটাও ঠিকমতো ধরতে পারতেন না। তখনই শুরু হয়েছিল তার কর্মজীবন। তার প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র ছিল তত্ত্বীয় কসমোলজি ও কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ।

১৯৭৯-২০০৯ সাল অবধি হকিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসীয় অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্বরত ছিলেন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজ শহরের গনভিল অ্যান্ড কিজ কলেজের ফেলো হিসেবেও নিযুক্ত ছিল।

তার আবিষ্কারসমূহ—হকিং বিকিরণ, পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব,বেকেনস্টাইন-হকিং সূত্র,হকিং শক্তি,গিবন্স–হকিং আনসাৎজ,গিবন্স–হকিং প্রভাব, গিবন্স–হকিং মহাশূন্য, গিবন্স–হকিং–ইয়র্ক বাউন্ডারি টার্ম, থর্ন–হকিং–প্রেস্কিল বাজি,কৃষ্ণগহ্বর, তত্ত্বীয় সৃষ্টিতত্ত্ব, কোয়ান্টাম মহাকর্ষ, ইত্যাদি।

•প্রাপ্ত পুরষ্কার ও সম্মাননাসমূহ: অ্যাডামস পুরস্কার (১৯৬৬),এডিংটন পদক (১৯৭৫),ম্যাক্সওয়েল পদক ও পুরস্কার (১৯৭৬), গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় ড্যানি হাইনম্যান পুরস্কার (১৯৭৬),হিউ পদক (১৯৭৬),আলবার্ট আইনস্টাইন পদক (১৯৭৮),রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির স্বর্ণ পদক (১৯৮৫),ডিরাক পুরস্কার (১৯৮৭),উলফ পুরস্কার (১৯৮৮),প্রিন্স অব অ্যাস্টুরিয়াস পুরস্কার (১৯৮৯),অ্যান্ড্রু গেম্যান্ট পুরস্কার (১৯৯৮),নেলর পুরস্কার ও লেকচারশিপ (১৯৯৯),লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার (১৯৯৯),রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের আলবার্ট পদক (১৯৯৯),কপলি পদক (২০০৬),প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯),ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স পুরস্কার (২০১২),বিবিভিএ ফাউন্ডেশন ফ্রন্টিয়ারস অব নলেজ পুরস্কার (২০১৫), ইত্যাদি।

এছাড়াও ২০০৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজি বিভাগেব তার সন্মানর্থে একটি মুর্তি স্থাপন করা হয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ শহরে আরেকটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়। তাছাড়াও মধ্য আমেরিকার দেশ সালভাদরে তার নামে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়।

হকিংকের জীবনী ও কাজ নিয়ে এছাড়াও বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিক তৈরি করা হয়। তার মধ্যে কয়েকটি হলো—আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম (১৯৯২), স্টিভেন হকিংস ইউনিভার্স (১৯৯৭), হরাইজন: দ্য হকিং প্যারাডক্স (২০০৫), স্টিভেন হকিং অ্যান্ড দ্য থিওরি অব এভরিথিং (২০০৭),দ্য বিগ ব্যাং থিওরি (২০১২, ২০১৪ ও ২০১৭)
,জিনিয়াস বাই স্টিভেন হকিং (২০১৬), ইত্যাদি।

আড়ু পরোন: যেকোনো বিরিয়ানি রান্নার সহজ পদ্ধতি

•ব্যক্তিজীবন: তিনি যখন কেমব্রিজর শিক্ষার্থী তখন তার বোনের বান্ধুবী জেন ওয়াইল্ডের সাথে সম্পর্ক হয়। ১৯৬৩ সাকে হকিং মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন, তবে এর আগেই জেন এবং তার মধতে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে তার ও জেনের বাগদান হয় এবং ১৯৬৫ সালে তাদের বিয়ে হয়।
তাদের তিন সন্তান জন্ম হয়। তাদের নাম- লুসি, রবার্ট, টমোথি।

•মৃত্যুবরণ: মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ সবাইকেই করতে হয়, স্টিফেন হকিংকেও করতে হয়েছিল। তিনি ২০১৮ সালের ৩১ শে মার্চ তার কেমব্রিজের নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। ক্যামব্রিজের গ্রেট সেন্ট ম্যারিস গির্জায় স্টিফেনের শেষকৃত্য সম্পূর্ণ হয় এবং তার মরাদেহ পুড়িয়ে ফেলার পর তার ছাইভম্ম ২০১৮ সালের ১৫ই জুন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে আইজাক নিউটনের সমাধির ও চার্লস ডারউইনের সমাধির পাশে পুঁতে দেওয়া হয়।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।