বিলুপ্ত হওয়া ম্যামথর এর গল্প!
সর্বশেষ ম্যামথের বাসস্থান: গবেষকদের মতে, ১০-১৪ হাজার বছর পূর্বে উত্তর আমেরিকার বুক হতে ম্যামথরা হারিয়ে যায়

সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ অবধি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে অসংখ্য জীব। তাদের অনেকের হদিস এখনো আমরা পাইনি, আবার সংখ্যাটাও সঠিকভাবে আমরা জানি না। তেমনই বিলুপ্ত হওয়া এক প্রাণি নিয়ে আজকের আর্টিকেল। বলছিলাম, হারিয়ে যাওয়া প্রাণি ম্যামথের কথা। সাধারণত ম্যামুথুস গণের সকল প্রজাতিকেই ম্যামথ বলা হয়৷ কিন্তু, পৃথিবীতে ম্যামথদের সর্বশেষ টিকে থাকা প্রজাতি হলো লোমশ ম্যামথ। যাদেরকে আধুনিক হাতিদের পূর্বপুরুষ হিসাবে গণ্য করা হয়। তবে সেই প্রজাতির আকার বর্তমান হাতির আকারের তুলনায় অনেকটা বড়ো ছিল। তাদের ছিল সুবিশাল দাঁত, সারা দেহ লোমে ভির্তি এবং বড়ো আকৃতির শুঁড়।
প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে, বরফ যুগে পৃথিবী হতে হারিয়ে গিয়েছে এই লোমশ ম্যামথ৷ ধারনা করা হয়, এই প্রাণিরা আরও ৫০ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে পৃথিবীতে টিকে ছিল। যা আমাদের পূর্ব পুরুষ, আদিম মানুষদের আঁকা গুহার চিত্রকলাতে দেখা মিলেছে। কিন্তু এই ম্যামথরা কীভাবে হারিয়ে গেল? জলবায়ুর তুমুল পরিবর্তন নাকি অন্যকিছু দায়ী তাদের এই বিলুপ্ত হবার পেছনে?
•সর্বশেষ ম্যামথের বাসস্থান: গবেষকদের মতে, ১০-১৪ হাজার বছর পূর্বে উত্তর আমেরিকার বুক হতে ম্যামথরা হারিয়ে যায়। কিন্তু, এরপরেও আরও পাঁচ হাজারের অধিক সময় ধরে ম্যামথরা টিকে ছিল আলাস্কার সেন্ট পল দ্বীপে। ধারনা করা হয়, এই দ্বীপে ম্যামথের দল পানির অভাবেই হারিয়ে গিয়েছে। বর্তমানের হাতিদের মতোই ম্যামথদেরও প্রতিদিন কমপক্ষে ৭০-২০০ লিটার পানির দরকার পড়তো। কিন্তু ওই সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় এবং খাবার উপযোগী পানির উৎসগুলো ভরে যায় সমুদ্রের লবনাক্ত পানিতে৷ আর পান করার জন্য উপযুক্ত পানি না পেয়েই আস্তে আস্তে ম্যামথরা এগিয়ে যায় বিলুপ্তির পথে।
তবে সর্বশেষ ম্যামথদের দলটি পৃথিবীতে বেঁচে ছিল রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব প্রান্তসীমার দ্বীপ র্যাঙ্গালে। এই দ্বীপের বর্তমান প্রশস্ত প্রায় ১২৫ কিলোমিটার এবং আয়তন প্রায় ৭,৬০০ কিলোমিটার। একসময় দ্বীপটি তুষারসেতুর দ্বারা যুক্ত ছিল পৃথিবীর মূল ভূখন্ডের সঙ্গে। কিন্তু, পৃথিবীর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াতে সেই সেতু এক পর্যায়ে মূল ভূখন্ড হতে আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে যায় আর সেই দ্বীপে আটকা পড়ে ম্যামথের দলটি। এরপর, বিভিন্ন কারণে এই দ্বীপে টিকে থাকতে না পেরে ম্যামথরা এক পর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর যে বিলুপ্তি ঘটে এই দ্বীপে মানুষের প্রথম পা পড়ার প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে।
•ম্যামথের সন্ধানে—ম্যামথদের আদি বাসস্থান যদিও ছিল আফ্রিকাতে, কিন্তু এরা পরবর্তী সময়ে সমস্ত পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। সাইবেরিয়ার ইয়ামাল পেনিনসুলা হতে ২০০৭ সালে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় প্রায় ৪০, ০০০ বছর পুরানো একটি শিশু ম্যামথের মরা দেহ৷ সাইবেরিয়ার কঠিন বরফের তলে এই মৃতদেহটি চাপা পড়ে ছিল বলে, তা একদমই অক্ষত রয়েছিল। এখনো মাঝে মধ্যে দেখা মিলে আলাস্কা কিংবা সাইবেরিয়াতে ম্যামথদের এমন দেহাবশেষ।
গবেষকরা ধারণা করেন, সাইবেরিয়ার বিশাল বরফ ঢাকা অঞ্চলে অন্তত কোটি বিলুপ্ত হওয়া ম্যামথের মৃতদেহ ঢাকা পড়ে রয়েছে। এখন অবধি আলাস্কা ও সাইবেয়াতে প্রচুর পরিমাণে ম্যামথের দাঁত, হাঁড়-কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে। আলাস্কা ও সাইবেরিয়া অঞ্চলের মানুষেরা ম্যামথের দাঁত দিতে বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার তৈরি করে। প্রতি বছর এসব অঞ্চলের মাটির তলদেশ হতে প্রায় অর্ধশত টনের মতো ম্যামথের দাঁত উদ্ধার হয়। আর এই থেকেই ধারনা করা হয়, এই অঞ্চলে এক সময় বিপুল সংখ্যক ম্যামথদের বসবাস ছিল।
•ম্যামথদের বিলুপ্তি কীভাবে হয়েছিল?
ঠিক কী কারণে পৃথিবী হতে বিশাল আকৃতির এই ম্যামথদের বিলুপ্তি ঘটেছিল, তা নিয়ে প্রচুর তর্ক বির্তক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, মানুষই তাদের বিলুপ্তির কারণ, মানুষের অধিক শিকারের ফলেই হয়েছে এমন বিলুপ্তি। একটি ম্যামথেত শরীর হতে প্রচুর মাংস পাওয়া যেত, এছাড়াও ম্যামথদের শরীরের হাঁড় দিয়ে তৈরি করা যায় বিভিন্ন অস্ত্র ও অলঙ্কার। আর এভাবেই হয়তো ঘটেছে ম্যামথদের বিলুপ্তি। তবে শিকারকে কখনোই ম্যামথদের হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ বলা যায় না। কারণ, অনেক জায়গায় ম্যামথদের বিলুপ্তি ঘটেছিল সেখানে মানুষের পদচিহ্ন পড়ার বহু আগেই।
অনেক গবেষক মনে করেন, বরফযুগ শেষে বিশাক তৃণভূমি ক্রমে ক্রমে বনে পরিণত হলে তখন ম্যামথরা খাদ্যের অভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তাদের এমন নিরবিচ্ছিন্নতাই ম্যামথদের টিকে থাকাতে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তখন ক্রমশ বাড়তে ছিল পৃথিবীর তাপমাত্রা। সেই সাথে বেড়ে চলছিল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং তৃণভূমি পরিণত হচ্ছিল বনে। আর হুর হুর করে বেড়ে যাচ্ছিল ম্যামথদের খাদ্যের অভাব। যেহেতু ম্যামথরা বরফযুগের প্রাণি ছিল, তাই বরফের পরিবেশে তারা মানিয়ে নিয়েছিল। যার প্রমাণ তাদের গায়ের প্রচুর লোক ও চর্বি৷ কিন্তু যখনি পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াতে বরফ যুগ শেষ হলো, তখন ম্যামথদের ও হারিয়ে যাওয়া শুরু হলো। তারা এমন তুমুল পরিবর্তিত
তাপমাত্রায় অভিযোজিত হতে পারেনি, আর সেই সাথে খাবার আর পানির অভাব তো ছিলই। এছাড়াও ক্রমশ শিকার ও ছিল।তবে এই ম্যামথদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। যেমন: হুট করে নতুন কোনো রোগজীবাণুর প্রকোপ, এছাড়াও কোনো মহামারি বা দূর্যোগ। আবার এমনও হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আস্তে আস্তে ম্যামথদের জিন বৈচিত্র্য কমে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে তারা। তবে এইসবকিছু কেবল অনুমান৷ এগুলোর পেছনে এখনো পাওয় যায়নি তেমন শক্ত কোনো প্রমাণ।তাই ম্যামথরা আসলে কী জন্য হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী হতে, তা এখনো মোটামুটি অন্ধকারেই রয়ে গেছে!
আরো পরুন:
•পৃথিবীতে কি ম্যামথরা আবার ফিরে আসছে?
সম্প্রতি সময়ে বেশ কিছু বিজ্ঞানী ও গবেষকের দল কঠোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে হারিয়ে যাওয়া ম্যামথদের ফিরিয়ে আনতে। অবশ্য এই প্রকল্প আশার আলো দেখেছে, কেননা ম্যামথদের নিকটবর্তী প্রজস্তি এশীয় হাতি পৃথিবীতে এখনো উপস্থিত। বিজ্ঞানীর দল আশা করছেম, অতি দ্রুতই হয়তো এই প্রকল্প সফলতার মুখ দেখবে।সাইবেরিয়ার বরফ ঢাকা অঞ্চল হতে সংগ্রহ করা হয়েভহে ম্যামথের ফ্রোজেন ডিএনএ এর নমুনা। আর এই নমুনা হতেই নানা প্রক্রিয়ায় চলছে ম্যামথদের ক্লোন করার চেষ্টা। যদিও এই সম্ভাবনা খুবই কম। তবুও কে জানে! হয়তো ভবিষ্যতে দেখা মিলবে কয়েক হাজার বছর পুরানো বিলুপ্ত হওয়া ম্যামথদের!
তবে এই ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষকই একমত নন। কারণ যদি জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ম্যামথদের ক্লোন করা সম্ভব ও হয়। তবুও এই নতুন ক্লোন ম্যামথরা কি টিকে থাকতে পারবে বর্তমান পৃথিবীতে? কোথায় পাবে তাদের বিপুল খাদ্য বা পানীয়? কিছুই তো আর আগের মতো নেই! বরং দিন দিন পৃথিনীর তাপমাত্রা বেড়েই চলছে, যা মানুষ বিলুপ্তি অবধি ঘটাতে পারে, সেখানে বিলুপ্ত হওয়া ম্যামথরাই আবার কীভাবে টিকে থাকবে! প্রশ্ন থেকেই যায়!