স্বাস্থ্য ও লাইফস্টাইল

গর্ভের পানি কী কারণে কমে যায়? এর লক্ষণ ও চিকিৎসা কী?

মাতৃত্ব পৃথিবীর সুন্দর একটি বিষয়। এই মাতৃত্ব হুট করেই হয় না। এর স্বাদ নিতে একজন নারীকে একটা দীর্ঘ সময় ও প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। গর্ভবস্থায় একজন নারী অনেক সমস্যারই সম্মুখীন হয়। অনেক সময় সমস্যা এতটাই প্রখর হয় যে সন্তান ও মায়ের জীবন হুমকিতে থাকে। তেমনই একটি জটিল সমস্যা গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড কমে যাওয়া। সাধারণ ভাষায় যাকে ‘পানি ভাঙা’ ও বলা হয়। তবে এই পানি ভাবগার সমস্যাটা গর্ভধারণের শুরুর দিকের চেয়ে শেষদিকেই বেশি ঘটে। প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা জানব—গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড কী? গর্ভের পানি কী কারণে কমে যায়? এবং এর লক্ষণ ও চিকিৎসা কী?

গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড:

মাতৃগর্ভে মানব শিশুর ভ্রুণ এক রকমের স্বচ্ছ, হালকা হলুদাভ তরলে ভেসে থাকে, এই তরলকেই বলা হয় এমনিওটিক ফ্লুইড বা গর্ভের পানি। সাধারণত গর্ভধারণের ১২ দিনের মধ্যেই এমনিওটিক স্যাক বা ভ্রুণের ধারক থলির সৃষ্টি হয় এবং এটি সৃষ্টি হবার সাথে সাথেই এই গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড উৎপন্ন হতে শুরু করে। আর এই এমনিওটিক ফ্লুইড শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে পান করে আবার এতেই প্রসাব করে। এভাবেই চক্রাকারে এমনিওটিক ফ্লুইডের মাত্রা ঠিক থাকে। আর এই ফ্লুইডই মাতৃগর্ভে মানব শিশু ভ্রুণের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম হিসাবে কাজ করে। তবে, আল্ট্রাসাউন্ড করে এই ফ্লুইড কম নাকি বেশি পরিমাণে আছে তা বোঝা যায় না।

মাতৃগর্ভে গর্ভের পানি ও এমনিওটিক ফ্লুইডের কাজসমূহ—

•ভ্রুণের বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড।
•বাইরের বিভিন্ন আঘাত হতে ভ্রুনকে রক্ষা করে এই ফ্লুইড।
•গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ভ্রুনের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখে।
•গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইডে বিভিন্ন অ্যান্টিবডি থাকে। এইসব অ্যান্টিবডি বিভিন্ন ধরণের ইনফেকশন হতে ভ্রুনকে রক্ষা করে।
•এই ফ্লুইড ভ্রুণের শ্বাসতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্রের স্বাভাবিক গঠনে ভূমিকা রাখে। মূলত, ভ্রুণ যখন ফ্লুইডে শ্বাস নেয় এবং ফ্লুইড গিলে ফেলে এই প্রক্রিয়াই মূলত শ্বাসতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্র গঠক করতে সহায়তা করে৷
•ভ্রুণ এই ফ্লুইডে ভেসে থাকার কারণে ভ্রুণের পেশী ও হাড়ের গঠন ত্বরান্বিত হয়।
•গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড অ্যাম্বিলিকাল কর্ড বা নাভিরজ্জুকে সংকুচিত হতে বাধা দেয়। এই অ্যাম্বিলিকাল কর্ড দিয়েই ভ্রুণ প্লাসেন্টার মাধ্যমে মায়ের শরীর হতে খাদ্য ও অক্সিজেন গ্রহণ করে।

গর্ভের পানি কমে যাওয়ার কারণ:

গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড কনে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন—

•যদি স্বাভাবিক লেবারের আগে এমনিওটিক ফ্লুইড এর মেমব্রেন বা এমনিওটিক স্যাক অর্থাৎ থলিটি ফেটে যায়।
•বংশগত বা জন্মগত ত্রুটির জন্য যদি গর্ভাস্থ মানব শিশুর ইউরিনারি ট্রাক্ট বা কিডনিতে বিশেষ সমস্যা থাকে।
•প্রসবের নির্ধারিত সময়ের বেশি বা দুই সপ্তাহের বেশি সময় অতিক্রম হয়ে গেলে।
•গর্ভবস্থায় যদি গর্ভবতী নারীটি কোনো ভারী কাজ করে।
•যদি গর্ভবর্তী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ বা প্রি-এক্লাম্পসিয়া থাকে।
•গর্ভবস্থায় গর্ভবতী মা যদি পানিশূন্যতায় ভোগে।
•যদি গর্ভবতী মায়ের টুইন টু টুইন ট্রান্সফিউশন সিন্ড্রম ঘটে। তবে এই টুইন টু টুইন ট্রান্সফিউশন খুবই রেয়ার কেস, যেখানে টুইন বাচ্চা দুইটির পরিবর্তে একটি মাত্র গর্ভফুল অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি সবারহ করে।

গর্ভের পানি কমে যাওয়ার লক্ষণসমূহ:

•সাধারণত গর্ভের ভেতর ভ্রুণের বয়স ৩৪-৩৬ সপ্তাহের পর হতে ডেলিভারির আগ অবধি এই ফ্লুইডের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমতে পারে।
•ডেলিভারি বা প্রসবের সময়ের আগেই যৌনাঙ্গ বা যোনিপথ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বা তার থেকেও অধিক পানির মতো তরল বের হয়।
•যদি গর্ভধারণের সময়ের চেয়ে মায়ের পেটের আকার ছোট হয় এবং মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর নড়াচড়া কম হয়।
•গর্ভবতী মায়ের গর্ভধারণের সাথে সাথে ওজনের বৃদ্ধির হার কমে গেলে।
•হঠাৎ করে গর্ভের শিশুর হার্টবিট বা হার্ট রেট কমে গেলে।
*গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড কমে গেলে সেসব জটিলতার সৃষ্টি হয়:
•গর্ভের পানি কমে গেলে জরায়ু সংকচিত হয়ে চাপ সৃষ্টি করে; এতে গর্ভের শিশুর অঙ্গ প্রতঙ্গ বিকৃত হয়ে যেতে পারে।
•নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই শিশু ভূমিষ্ট হতে পারে।
•গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ ঘটতে পারে।
•শিশু মৃত অবস্থায় জন্মাতে পারে।
•সময়ের আগে এই ফ্লুইড কমে গেলে শিশুর বিভিন্ন ইনফেকশন হতে পারে।
•শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
•অ্যাম্বিলিকাল কর্ড সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। ফলে শিশুরঅক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি আদান প্রদানে সমস্যা সৃষ্টি করে।
•সিজারের ঝুঁকি বাড়ায়।

আরো পড়ুন: সন্তান কথা না শোনলে এই উপায়গুলো মেনে চললে আর অবাধ্য হবে না।

গর্ভের পানি কমলে এর প্রতিকার ও চিকিৎসা:
১| কোনো দূর্ঘটনা ব্যতীত সাধারণ গর্ভবস্থায় পানি কমে গেলে তা রোধ করার উপায় থাকে না। তবে যদি নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ ও চেকাপ করানো হয় তবে এই সমস্যা এড়িয়ে চলা যায়।
২| গর্ভাবস্থায় গর্ভের পানি বা পানি ভাঙার চিকিৎসা গর্ভের সন্তানের বয়সের ওপর অবেকটাই নির্ভর করে। যদি গর্ভের সন্তানের বয়স ৩৭ সপ্তাহ হয়, এরপর পানি ভাবগে। তখন ডাক্তার শিশুর নিরাপত্তার জন্য দ্রুত প্রসব করানোর পরামর্শ দেন।
৩|তবে, গর্ভের শিশু বয়স ২৪ সপ্তাহের কম হলে তখন যদি এই ফ্লুইড বা পানি ভাঙে, তা গর্ভের শিশুর জন্য মারাত্মক ঝুঁকির। এক্ষেত্রে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডাক্তারের ক্লোজ মনিটরিংবে থাকতে হবে।
৪| যদি ২৪-৩৪ সপ্তাহের মধ্যে পানি ভাঙে, তবে অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড ইনজেকশন ব্যবহার করে ডাক্তাররা এই স্টেরয়েড সাধারণত গর্ভের শিশুর ফুসফুস বিকাশে সহায়তা করে।
৫| আর ৩৪ সপ্তাহের পর পানি ভাঙা শুরু হলে—
গর্ভবতী মায়ের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে সম্পূর্ন বেড রেস্টে রেখে ৩৭ সপ্তাহ অবধি অপেক্ষা করা হয়। কেননা, ৩৭ সপ্তাহের পর শিশু ডেলিভারির উপযুক্ত হয়।
৬| তবে জরুরি কারণে ২৮ সপ্তাহের পর ডেলিভারি করেও শিশুকে বাঁচানো সম্ভব। এক্ষেত্রে যদি গর্ভবতী নারী ডাক্তারের ক্লোজ মনিটরিং এ থাকে।

প্রিয় পাঠক, পানি কমে বা এমনিওটিক ফ্লুইড কমে গেলে দুশ্চিন্তা না করে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের শরাপন্ন হোন। যদি চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলেন অথবা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকেন তবে গর্ভের শিশু অনেকটাই নিরাপত্তায় থাকবে। তাই অযথা ভয় না পেয়ে চিকিৎসকের কাছে যান এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হোক শিশু। এছাড়াও যদি আজকের এই আর্টিকেলটি ভালো লাগে তবে অবশ্যই অন্যকে শেয়ার করুন এবং এই ধরনের আর্টিকেল পেতে অনুলিপির সাথেই থাকুন।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।