ইতিহাসফিচার

নোবেল পুরস্কার কি? কেন দেওয়া হয়।

নোবেল পুরস্কারকে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচাইতে দামি পুরস্কার ও সম্মাননা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৯৫ সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের করা একটি উইল অনুসারে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়

নোবেল পুরস্কার কী ? নোবেল পুরস্কার কেন দেওয়া হয়? নোবেল পুরস্কার কাকে দেওয়া হয়? চলুন জেনে নেই নোবেল পুরস্কার সমন্ধে খুটিনাটি।

নোবেল পুরস্কারঃ পৃথিবীর সম্মানজনক পদক এর মধ্যে নোবেল পুরস্কার সবচাইতে বেশি উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৫ সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের করা একটি উইল অনুসারে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবকল্যাণে অবদান রাখার জন্য প্রতিবছর বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নোবেল পদকে ভূষিত করা হয়। আর এটিকে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচাইতে দামি পুরস্কার ও সম্মাননা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আলফ্রেড নোবেলের উইল কেঃ আলফ্রেড নোবেল একাধারে ছিলেন রসায়নবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং অস্ত্র নির্মাতা। বিজ্ঞানী নোবেল বিভিন্ন উদ্ভাবনের জন্য তার নিজের নামে ৩৫৫ টি পেটেন্ট করান। সেগুলোর মধ্যে তার সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার হল “ডিনামাইট”। “ডিনামাইট” বারুদের চেয়েও উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক। বিভিন্ন ধরনের খনিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ডিনামাইটের বহুল ব্যবহার রয়েছে। আপনি হয়তবা ইতিমধ্যেই এই ডিনামাইটের নাম শুনে থাকবেন। আলফ্রেড নোবেল তার পেটেন্ট গুলো খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি বোফর্স নামের একটি অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। এছাড়া সুইডেন, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে আলফ্রেড নোবেলের একাধিক বিস্ফোরক দ্রব্যের কোম্পানি ছিল। বহু পেটেন্ট এবং কোম্পানির কারণে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। ১৮৮৮ সালে বিজ্ঞানী আলফ্রেডের ভাই মারা যায়। তখন একটি ফরাসি পত্রিকায় প্রকাশিত শোক র্বাতায় আলফ্রেড নোবেল কে ‘’দ্যা মার্চিন অব ডেথ’’ বা মৃত ব্যবসায়ি নামে অবহিত করা হয়। বিষয় টি তাকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। আলফ্রেড নোবেল এসব কিছু করে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছিল এবং তখন তাকে মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের কথা সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলেছিল। আর তখন তিনি এমন কিছু করে যাওয়ার কথা ভাবেন, যার ফলে তাঁর মৃত্যুর পর সবাই তাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। আর এজন্য ১৮৯৫ সালে আলফ্রেড নোবেল তার উইলে লিখে যান, তিনি তার ৯৪ ভাগ ভাবসম্পদ পুরস্কার আকারে দান করতে চান। সে সময় তার সম্পদ ছিল ৩১০ কোটি সুইডিশ ক্রোনা। যা বর্তমান সময়ে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার সমতুল্য।

নোবেল পুরস্কারের প্রচলন: আলফ্রেড নোবেল এর মৃত্যুর পর ১৮৯৭ সালের নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি এবং ১৯০০ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। পরবর্তীতে প্রথম ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল, নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করলেও তিনি কখনও এই পুরস্কার বিতরণ দেখে যেতে পারেননি। প্রথম কাউকে নোবেল পুরস্কারের দেবার আগেই সে মৃত্যুবরণ করে; তবে তার ইচ্ছা অনুযায়ী বিশ্ব মানবতার কল্যাণে কাজ করে যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে তাদেরকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে আলফ্রেড নোবেল এর নির্ধারিত সেই কয়েকটি ক্যাটাগরি এর বাইরে আরও একটি নতুন শাখায় নোবেল পুরস্কার দেবার প্রচলন শুরু করা হয়। আর এটি হচ্ছে, ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করা।

বর্তমানে মোট ছয়টি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। আর এগুলো হলো, ১. পদার্থবিজ্ঞান, ২. রসায়ন বিজ্ঞান, ৩. চিকিৎসা বিজ্ঞান, ৪. শান্তি, ৫. সাহিত্য ও ৬. অর্থনীতি। নোবেল ফাউন্ডেশন এর অধীনে একাধিক প্রতিষ্ঠান সংশ্লিস্ট ক্ষেত্রে মনোনয়ন সংগ্রহ করেন এবং যোগ্য প্রার্থী বাছাই করে পুরস্কার প্রদান করে। পদার্থ, রসায়ন এবং অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নির্ধারণ করে রয়েল “সুইডিশ একাডেমি সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস”। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নির্ধারণের “সুইডিশ একাডেমি”।

আলফ্রেড নোবেল। ছবি: ইন্টারনেট

পুরস্কার প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা: সুইডেনের গবেষণা ভিত্তিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নির্বাচন করে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। শুধুমাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার টি নরওয়ের রাজধানী থেকে রাজধানী থেকে প্রদান করা হয়। বাকি সকল ক্ষেত্রে নোবেল প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। নোবেল পুরস্কার শুধুমাত্র জীবিত ব্যক্তিদের কে দেওয়া হয়। তবে মনোনয়ন পাবার পর এবং পুরস্কার গ্রহণের আগে মারা যাবার কারণে মাত্র দুই বার মরণোত্তর নোবেল দেওয়া হয়েছে। কোন একটি নোবেল পুরস্কার শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির জন্য হতে পারে আবার অনেকগুলো ব্যক্তি মিলে একটি নোবেল পুরস্কার পেতে পারে। শুধুমাত্র শান্তি পুরস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় একক ব্যক্তির বদলে কোন প্রতিষ্ঠান ও শান্তিতে নোবেল পেতে পারে। শান্তি বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে একটি শাখায় সর্বোচ্চ তিন জনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া যায়।

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদের কে বলা হয় “নোবেল লরিয়েট”। অন্যান্য পুরস্কার এর তুলনায় নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন নির্বাচন ও মনোনয়ন পদ্ধতি বেশ কঠোর এবং দীর্ঘ। সে কারণেই নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার এর মর্যাদা পেয়েছে। কেননা এখানে শুধুমাত্র যোগ্য ব্যক্তিকেই সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব থেকে নির্বাচিত তিন হাজার জনকে মনোনয়ন পত্র দেয়া হয়। যাতে তারা পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে পারে। নোবেল কমিটি তিন হাজার জনের ভেতর থেকে ৩০০ জনকে বাছাই করে এবং তারপর তাদের মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত নোবেল বিজয়ী নির্বাচন করা হয়।প্রতি বছর ৩১ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ এবং অক্টোবর মাসের মধ্যে সে বছরের নোবেল লরিয়েট দের নাম ঘোষণা করা হয়। আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকী ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদক প্রদান করা হয়।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার: নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত। যিনি জাতিসমূহের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং বৃদ্ধি, যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত সেনাবাহিনীর অপসারণ বা হ্রাস এবং শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়। নরওয়ের রাজা উপস্থিতিতে শান্তি পদক এবং সুইডেনের রাজার উপস্থিতিতে বাকী পদক গুলো বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কোন বছর যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান স্থগিত থাকে, তাহলে সেই অর্থ অন্যান্য পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এ যাবৎকালের ১৯ বার শান্তিতে নোবেল পদক দেওয়া স্থগিত ছিল।

আরো পড়ুনঃ অর্ডার দেওয়া খাবার মিলবে ৩০ বছর পর! তুমুল ভাইরাল নেটদুনিয়ায়।

একাধিকবার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তি: নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে মাত্র ৪ জন ব্যক্তি দুইবার করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছে। তাদের মধ্যে মেরি কুরি একমাত্র নারী যিনি দুইবার নোবেল পান। তিনি ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে এবং ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপের বাইরের প্রথম ব্যক্তি এবং প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল অর্জন করেছিলেন।

নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্য: একজন নোবেল বিজয়ী কে একটি স্বর্ণপদক, সম্মাননা ডিপ্লোমা এবং প্রায় ১০ কোটি টাকার নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। গত বছর নোবেল বিজয়ীদের নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা প্রায় আট কোটি টাকা। নোবেল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বছর নগদ অর্থের পরিমাণ হবে ১১ লাখ ডলার, মানে ৯ কোটি টাকার কিছু বেশি।

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম মুসলিম ব্যক্তি: নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম মুসলিম ব্যক্তি হলেন, মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত। মিশর ও ইসরাইল শান্তি চুক্তির কারণে ১৯৭৮ সালে শান্তিতে নোবেল পান।
বাঙালি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যাক্তি: ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস নোবেল জয়ী একমাত্র বাংলাদেশী এবং তৃতীয় বাঙালি। এর আগে আরো দুই জন বাঙ্গালীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে পুরো বিশ্বে মিলে। যার মধ্যে একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২০০৬ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এখনও পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ নোবেল জয়ী হলেন, মালালা ইউসুফজাই। তিনি নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করারকারণে মাত্র ১৭ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।