ফিচারলোকসংস্কৃতি

ঐতিহ্যবাহী টাকার হাট!

‘ঐতিহ্যবাহী টাকার হাট’-হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। জীবনে হয়তো অনেক রকমের হাট দেখেছেন। গ্রামাঞ্চলে এখনও সপ্তাহে ১-২ দিন নিয়মিত হাট বসে। এসব হাটে মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের পসরা বসায়। গ্রামের মানুষ মূলত হাট থেকেই তাদের সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে থাকে। আবার গ্রামের মানুষ স্থানীয় হাটে সবজিসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য বা উৎপাদিত পণ্য, তৈরিকৃত পণ্য এগুলো বিক্রি করে থাকেন। প্রাচীনকাল থেকেই লোকায়ত বাংলায় হাটের প্রচলন রয়েছে। নদীর ধারে, গাছের নিচে, বটবৃক্ষের নিচে, বিশেষ কোনো স্থানে সাধারণত হাট বসে। আবার হাট বিভিন্ন প্রকারেরও হয়ে থাকে। যে অঞ্চলে যে পণ্যটি বেশি উৎপাদিত হয় সে অঞ্চলে সেই বিশেষ পণ্যের হাট বসে। যেমন- সবজির হাট, পানের হাট, ধান বা চালের হাট, কলার হাট প্রভৃতি। এছাড়া সপ্তাহে বা মাসে এক দিন বা বিশেষ উপলক্ষ্যে হাট বসে, যেমন- পশুর হাট। এসব হাট ঐতিহ্যবাহী ও অতি পুরাতন৷ এসব হাটের নাম কমবেশি সকলেই জানে।কিন্তু টাকারও হাট বসে। শুনে হয়তো একটু অবাকই হবেন! টাকার আবার হাট হয় নাকি? টাকা নিয়েই তো মানুষ দরকারি জিনিস কিনতে হাটে যায়। ব্যতিক্রমী এই টাকার হাট বসে ঢাকায়। এই হাট প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। ঐতিহ্যবাহী ঢাকার এই হাটের বিষয়েই আজ চলুন জেনে নেওয়া যাক।

টাকার হাট:

টাকা ও মুদ্রা শুধুমাত্র বিনিময়ের মাধ্যমই নয়, এটি মানব সভ্যতা সৃষ্টিরও মাধ্যম। প্রাচীনকালে পণ্যের বিনিময় প্রথা ছিল। একসময় পণ্যের বিনিময় উঠে গিয়ে শুরু হলো অর্থ বিনিময় প্রথা৷ বেচাকেনার মাধ্যম ও মূলদণ্ড হিসেবে প্রচলন শুরু হলো অর্থের। ধাতব মুদ্রারও প্রচলন ছিল একসময়৷ মুদ্রার এপিঠে-ওপিঠে রাজা বা শাসকদের পরিচয়ের প্রতিকৃতি খোদাই করা থাকতো। মুদ্রা দেখে যেন বোঝা যায় কোন আমলের বা কোন শাসকের আমলের প্রচলিত মুদ্রা। আবার মুদ্রায় নকশা করারও প্রচলন ছিল। টাকা ও মুদ্রার মাধ্যমে যেকোনো নির্দিষ্ট সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, শিল্প, অর্থনৈতিক প্রভৃতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া সম্ভব। এছাড়া টাকা ও মুদ্রা দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, তাই অর্থ দেখলেই বোঝা যায় তা কোন দেশের বা কার শাসনামলের টাকা বা মুদ্রা। অর্থ শুধুমাত্র বিনিময়ের সাথেই নয় শিল্প ও ঐতিহ্যের সাথেও জড়িত।

#আরও পড়ুন: বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্যবাহী ঈদ পালনের ভিন্ন রীতিনীতি

পণ্য কেনাবেচার মাধ্যম টাকারও হাট বসে। সাধারণ অর্থে, টাকার হাট বলতে বোঝায় যেখানে টাকার বিকিকিনি হয়। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট যে স্থানে নতুন ও পুরাতন টাকা ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তাই মূলত টাকার হাট। এই টাকার হাটে নতুন টাকার কেনাবেচা বেশি হয়। নতুন নতুন চকচকে বান্ডেলের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। টাকার ব্যবসায়ীরা মনে করেন সত্তরের দশকের আগে থেকেই টাকার হাটের প্রচলন হয়। তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নতুন টাকা সংগ্রহ করেন এবং পুরাতন টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেন। এভাবেই চলে তাদের টাকার ব্যবসা। সাধারণত সারাবছরই বসে টাকার হাট। কিন্তু ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই মূলত জমজমাট হয়ে ওঠে এই ঐতিহ্যবাহী টাকার হাট।

ঐতিহ্যবাহী টাকার হাট!
ঢাকার টাকার হাট

মানুষ কেন নতুন টাকা কিনতে আগ্রহী:

ঈদের আনন্দ সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে ছোট শিশুরা৷ ঈদকে কেন্দ্র করেই তাদের আনন্দ আরও বেড়ে যায়। ঈদের দিন সকাল বেলা শিশুরা নতুন জামায় সেজে ওঠে। তাদের কাছে  ঈদের দিনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ আগ্রহের বিষয় হলো ঈদ সেলামি। মুরব্বিদের সালাম করে ঈদ সেলামি নিতে কারও আগ্রহের কমতি থাকে না। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেই তারা সেলামি পায়। এই সেলামি দেওয়া হয় টাকার মাধ্যমে। ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০, ১০০০ টাকার সালামি দেওয়া হয়। শিশুরা এই সেলামি পেয়ে মহা খুশি হয়। তবে এই সেলামি যদি হয় চকচকে নতুন টাকার তবে তো কথাই নেই। তবে সেলামি শুধু যে বাচ্চারাই পেয়ে থাকে বিষয়টা এমন না। সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় সেলামি। শ্বশুর-শাশুড়ী তাদের জামাই বা বৌমাকে, দুলাভাই তাদের শ্যালক-শ্যালিকাদের, দাদা-দাদী বা নানা-নানী তাদের নাতি-নাতনীদের, বড় ভাই বা বোন ছোট ভাইবোনদের- এভাবে সম্পর্কের উপর নির্ভর করে সেলামি দেওয়া হয়৷ তবে সেলামিতে সবাই যদি নতুন টাকা পায় তাদের আনন্দ আরও একটু বেড়ে যায়।

ঈদের দিনে ঈদ সেলামি দেবার জন্য অনেকেই ঈদ উপলক্ষ্যে টাকার হাট থেকে নতুন টাকার চকচকে বান্ডেল ক্রয় করে থাকেন। যদিও এক্ষেত্রে ক্রেতাদের গুনতে হয় অতিরিক্ত বাড়তি কিছু টাকা। নতুন টাকা মানুষের কাছে অনেকটা শখের বিষয়। অনেকেই নতুন টাকা পেলে খরচ করতে চান না। জমানোর জন্য অনেকেই নতুন টাকা সংগ্রহ করে থাকেন। আবার অনেকেই খুচরা টাকার সংকট পড়ে যান। কেনাকাটা বা অন্যান্য কাজে খুচরা টাকার সংকট দেখা দিলে বিষয়টা বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সংকট মেটানোর জন্য বা বিভিন্ন প্রয়োজনে টাকার হাট থেকে অনেকে নতুন টাকা সংগ্রহ করে থাকেন। এছাড়াও ছেঁড়া-ফাটা নোট নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়েন। কারণ টাকার পরিমাণ বেশি হলে তা অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ ও তা নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। ছেঁড়া-ফাটা নোট বা নষ্ট নোট বা পুরাতন নোট বা কয়েন বা অচল নোট বা কয়েন বা বৈদেশিক মুদ্রা বা বৈদেশিক টাকা সবই বিক্রি করা যায় এই টাকার হাটে। আপনি পুরাতন টাকা দিয়ে নতুন টাকা সংগ্রহ করতে পারেন। তবে বছরের অন্যান্য সময়ের থেকে দুই ঈদেই মানুষ সেলামি দেবার উদ্দেশ্যে নতুন টাকা সংগ্রহ করে থাকেন।

নতুন টাকার হাট যেখানে বসে:

রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর দিকের সড়কের পাশে এবং গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের সিঁড়ির দক্ষিণ পশ্চিম পাশে বসে এই টাকার হাট। ব্যাংক পাড়া মতিঝিল ও গুলিস্তানে ৪০-৫০ টি টাকার দোকান রয়েছে। গুলিস্তানের এই টাকার হাটের বয়স প্রায় ৫০ বছরের বেশি। প্রায় অর্ধ-শতাধিক মানুষ এই হাটকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে। চকচকে নতুন টাকার বান্ডেল প্রয়োজন হলে এই হাট থেকে দরদাম করে টাকা কেনা যায়। এখানে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত নতুন টাকার বেচাকেনা হয়। টাকার ব্যবসায়ীরা টাকার বান্ডেলের পসরা সাজিয়ে বসেন। অনেকে আবার নতুন টাকা দিয়ে তোড়া তৈরি করে রাখেন।

ঐতিহ্যবাহী টাকার হাট!
নতুন টাকার তোড়া

নতুন টাকার বান্ডেলের মূল্য:

সাধরণত মানুষের টাকার চাহিদা মেটাতে গিয়ে বসে টাকার হাট। আর ঈদের সময় টাকার ব্যবসায়ীদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় নতুন টাকার জোগান দিতে গিয়ে। অভিনব এই টাকার হাটে তখন চলে বেচাকেনার ধুম। তাই নতুন টাকার বান্ডেলের দামও থাকে একটু চড়া। কিন্তু এ হাটেও দরদাম করে টাকা কেনাবেচা হয়। কেউ ১০ টাকার নোটের ১ হাজার টাকার বান্ডেল নিলে তাকে অতিরিক্ত ৪০-৫০ টাকা গুনতে হয়। ২০ টাকার নতুন নোটের ক্ষেত্র হাজারে ২০ টাকা, ৫০ টাকার নোটের ১ হাজারের বান্ডেলের দাম রাখা হয় ৬০-৭০ টাকা, ১০০ টাকার ১০ হাজারের দাম রাখা হয় ৬০-৮০ টাকা। কিন্তু ৫০০ ও ১০০০ টাকার নতুন নোট বিক্রি হয় না তাই দোকানীরা তা কম রাখেন। তবে গ্রাহকের চাহিদার তালিকায় ১০ ও ২০ টাকার বান্ডেল বেশি স্থান পায়। ঈদ আসলে দামের কম-বেশি হতে পারে। আবার পুরাতন ছেঁড়া-ফাটা নোট ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে কম মূল্যে, যেমন ১০০ টাকার একটি ছেঁড়া নোট কেনা হয় ৯০ টাকায় আবার টাকাটি বেশি ছেঁড়া বা পুরাতন হলে ৭০/৮০ টাকায় কেনা হয় বা দাম আরও কমে যায়।

#আরও পড়ুন: গোরু-ছাগলের হাট : আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে!

টাকার ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকা:

টাকার ব্যবসায়ীরা দিনে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা করলেও তারা নিজেরাই আর্থিক সংকটে ভোগেন। সারাদিন কেউ ৫০ হাজার, ১ লক্ষ বা ২ লক্ষ নতুন টাকার বান্ডেল হয়তো বিক্রি করতে পারেন। যা থেকে সারাদিনে হয়তো ৬০০-১০০০ টাকা ইনকাম করা সম্ভব। তবে ঈদ আসলে ৩-৪ লক্ষ টাকা পর্যন্তও অনেক সময় বিক্রি হয়ে থাকে। তখন ইনকামের পরিমাণটাও দ্বিগুণ হয়ে যায়। সারাবছর যা কেনাবেচা হয় তার অর্ধেক বিক্রি হয় দুই ঈদে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে নারীরা সাধারণত টাকার পসরা সাজিয়ে বসেন। এসব নারী ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত দরিদ্র। নতুন টাকা বিক্রি করে টাকার ব্যবসায়ীদের যে লাভ হয় তাতে বর্তমান সময়ে সংসার চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। দুবেলা ডাল-ভাত জোটানোই যেনো সবচেয়ে বড় জীবন সংগ্রাম। অনেকের ছেলে-মেয়ে আবার লেখাপড়া করে। তার উপর বাড়তি চাপ হলো ফুটপাতের দালালদের টাকা দেওয়া, এ টাকা না দিলে দোকান সাজাতে দেওয়া হয় না। সব মিলিয়ে তাদের এই সামান্য আয়ে আজকের দিনে সংসার চালানো সত্যিই কষ্টকর। লক্ষ লক্ষ টাকার কেনাবেচা করলেও হতদরিদ্র মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না শুধু নতুন টাকার ঘ্রাণটুকুই নেওয়া হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, ঢাকার এই অভিনব টাকার হাটে প্রতিদিন টাকার কেনাবেচা হয়। এই হাট বর্তমানে ব্যতিক্রমধর্মী ঐতিহ্যবাহী একটি হাটে পরিণত হয়েছে। টাকার ব্যবসায়ীরা গ্রাহকের কাছে নতুন টাকা বিক্রির বদলে সামান্য লাভ করে। আর গ্রাহক এই নতুন টাকার বান্ডেল পেয়ে হয় খুশি। বাড়ির বাচ্চা থেকে বড়দের নতুন টাকার ঈদ সেলামি দিলে ঈদের আনন্দ হয়ে যায় আরও দ্বিগুণ।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।