আমরা সবাই কমবেশি মমি শব্দটির সাথে পরিচিত। মমি নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে কফিনে রাখা লিলেন কাপড়ে প্যাঁচানো মৃতদেহের ছবি। ভেসে আসে মিশর আর পিরামিডের কথা। প্রাচীন মিশরে ‘ফারাও’ শাসক, ধনাঢ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মৃতদেহ মমি করে রাখার প্রচলন ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা প্রায় সাত হাজার বছর আগেই (খৃষ্টপূর্ব ৫০০০ বছর) মমি তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। যদিও মিশরীয়দের আগেই মমির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। আপনি কি জানেন পৃথিবীর আর কোথায় কোথায় মমি তৈরির প্রচলন ছিল? সাইবেরিয়া, চীন, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, পেরু, চিলিসহ আরও অজস্র জায়গায় খুঁজে পাওয়া গেছে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণির মমি। চলুন আজ জেনে নেই রহস্যময় এই মমির ইতিবৃত্ত!
মমি
মমি কী?
মমি হলো মৃতদেহ সংরক্ষণের এক ধরণের বিশেষ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে মানুষ বা অন্য যে কোন প্রাণির দেহের পঁচন রোধ করা হয়। এতে মৃতদেহটি হাজার হাজার বছর ধরে অবিকৃত অবস্থায় থাকে। কৃত্রিমভাবে ছাড়াও প্রাকৃতিকভাবেও মমি হয়ে যাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে আমাদের প্রকৃতিতে।
প্রাকৃতিকভাবে মমি কেন হয়?
মৃতদেহের পঁচন রোধের মাধ্যমেই মূলত মমি তৈরি হয়। মৃত্যুর পর আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর কার্যকর থাকে না। তখন পরিবেশ থেকে নানান ধরণের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক আমাদের দেহকে আক্রমণ করে। পাশাপাশি আমাদের দেহের টিস্যুগুলো ভেঙে যেতে শুরু করে। এভাবে কোষগুলো ভেঙে ভেঙে দেহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম কিংবা ঠাণ্ডায় কিংবা বায়ুশূন্য স্থানে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া টিকে থাকতে পারে না। ফলে বহুবছর মৃতদেহটি অবিকৃত অবস্থাতেই থেকে যায়।
মমিকরণের ইতিহাস:
মমির নাম শুনলেই প্রথমে মিশরের নামটি আপনাআপনিই চলে আসে। কিন্তু মিসরীয়দের আগেই মমি তৈরির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গেছে। উত্তর চিলি ও পেরুতে অবস্থিত চিনচেরো সভ্যতায় মিশরীয়দের চেয়েও আরো কয়েক হাজার বছর বছর আগেই মানুষ মমি তৈরি করতে শিখেছিল। উষ্ণ ও পানিবিহীন পরিবেশের সেসব মমি এখনও অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে। যার কয়েকটি নিদর্শন ঠাঁই পেয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।
চিনচেরোদের মমিকরণ পদ্ধতি:
চিনচরোদের মমি তৈরির পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উন্নত। চিনচরোরা বিশ্বাস করত মৃত্যুই শেষ নয়, মৃত্যুর পরেও থাকে আর এক জীবন। এই বিশ্বাস থেকেই মমি তৈরির শুরু। মিসরীয়রা যেখানে মমি করার সময় ব্যবহার করত কোনো অজ্ঞাত রাসায়নিক, সেখানে চিনচরোরা ব্যবহার করতো ‘ইকো ফ্রেন্ডলি’ পদ্ধতি।
আরও পড়ুন# অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: হার না মানা এক অভিনেত্রীর গল্প!
মমি তৈরির আগে তারা মৃতের হাত-পা কেটে গরম ছাই ঘষে শুকিয়ে ছোটো কাঠি আর ঘাসের বাঁধনে শরীর পুনর্গঠিত করতো। তারপর মাথার খুলির ভেতর ঘাস, চুল আর ছাই ভরে চামড়া লাগিয়ে দেওয়া হতো। ঠিক যেমনভাবে আজকাল জীবজন্তুর দেহ ‘স্টাফ’ করা হয়। মৃতের নিজস্ব চামড়া ছাড়াও সামুদ্রিক সিল ও পেলিকানের চামড়ায় মৃতদেহ ঢেকে দেওয়া হতো। শেষে মুখ ও শরীরে ছাইয়ের প্রলেপ দিয়ে লাল-কালো রঙে সাজানো হতো মমি। মাথায় লম্বা চুলে এদের অনেক জীবন্ত লাগত। তারপর মূর্তিপূজার মতো ওই স্টাফ করা দেহকে সামনে বসিয়ে সারা হতো মৃতের পরলৌকিক কাজকর্ম বা অন্তেষ্টিক্রিয়া। মমি তৈরির পরপরই সেগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো না। কোনো কোনো মমির মুখে বিভিন্ন রঙের কয়েক রকমের প্রলেপ দেখা গেছে। কেন চিনচরো সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যায় তা স্পষ্ট নয়। তাদের অনেক ধর্মীয় আচার-আচরণ ইনকাদের ধর্মবিশ্বাসের মতো ছিল বলে গবেষকরা মনে করেন। চিনচরোদের মধ্যে উন্নত জীবনধারার প্রচলন ছিল এবং বিকশিত সভ্যতার প্রকাশ ঘটেছিল। সুনিপুণভাবে সংরক্ষিত এই মমিগুলোর নিদর্শন থেকে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। কেন চিনচরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে মমি তৈরির ধারণা জন্মায়, তার কারণ আজও অস্পষ্ট।
মিশরীয় মমিকরণ পদ্ধতি:
মমিকরণের যতগুলো পদ্ধতি রয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, গবেষণা ও রহস্য তৈরি হয়েছে মিশরীয় মমি নিয়ে। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতো মৃত্যুর পর মানুষ পরকালে তাদের জীবন আবার শুরু করবে। আর সেই জীবনে যাওয়ার জন্য তাদের মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আর এই সংরক্ষণ করে রাখার জন্য মমি তৈরি করা হতো। তবে মমি কেবল মিশরের ধনী ও উচ্চবর্গীয় ব্যক্তিদেরই করা হতো। যেমন রাজ পরিবারের সদস্য, রাজসভার কর্মকর্তা ও পুরোহিতরা মমি হওয়ার সুযোগ পেতেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই সুযোগ মিলতো না। মমিকরণের সেই পদ্ধতিটি সংক্ষেপে দেওয়া হলো –
- একটি লোহার হুকের সাহায্যে নাকের ছিদ্র দিয়ে মস্তিষ্ক বের করে আনা।
- পেটের কাছে বামদিকে কিছু জায়গা কেটে ছিদ্র করা।
- সমস্ত অভ্যন্তরীন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বের করে আনা।
- অভ্যন্তরীন অঙ্গ গুলোকে শুকাতে দেয়া।
- যকৃত, পাকস্থলী, ফুসফুস এসব অঙ্গসমুহকে বিশেষ পাত্রে সংরক্ষণ।
- হৃদপিন্ডকে শরীরের ভেতর প্রতিস্থাপন করা।
- শরীরের অভ্যন্তর এলকোহল বা মদ এবং নানা মসলা দিয়ে পরিস্কার এবং পক্রিয়াজাত করা।
- দেহকে নেট্রন নামক প্রাকৃতিক লবন দিয়ে ৭০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষন করা।
- ৪০ দিন পর দেহটা লিলেনের কাপড় অথবা বালু দিয়ে ভর্তি করা হতো যাতে মানবাকৃতি পায়।
- ৭০ দিন পর পা থেকে মাথা পর্যন্ত লিলেনের কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজের মতো করে মোড়ানো হতো।
- এরপর মমিটিকে স্যারকোফ্যাগাস নামের একধরনের কফিনে স্থানান্তিরিত করা হতো।
মিশরীয়দের মমি তৈরির সচিত্র ধাপসমূহ:
১. মমি করার আগে প্রথমেই মৃতদেহটিকে নিয়ে যাওয়া হতো ‘ইবু’ (ibu) নামের একটি ঘরে। “ইবু” অর্থ হলো “বিশুদ্ধকরণ স্থান”। ইবুতে মৃতদেহটিকে ভালো মতো ধোয়া হত সুগন্ধযুক্ত তাড়ি নামের তালের রস থেকে তৈরি মদ দিয়ে। এরপর নীলনদের পানি দিয়ে ভালোমতো দেহটিকে পরিষ্কার করা হতো।
২. এরপর ইবু থেকে দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হতো “পার- নেফার” (per-nefar) এ। এটাকে ‘মমিকরণ’ কক্ষ বলা যেতে পারে কারণ এখানেই শুরু করা হতো মমি তৈরির মূল কাজ।
৩. পার নেফারে নেওয়ার পর দেহটিকে একটি টেবিলের উপর রেখে প্রথমে মৃতদেহটির বাম দিক থেকে এর ভেতরের পচনশীল অঙ্গগুলো, যেমন : যকৃত, ফুসফুস, পাকস্থলী এবং অন্ত্র বের করে আনা হতো। কিন্তু হৃদপিণ্ডটিকে কিছুই করা হত না। কারণ তারা ভাবতো মানুষের সব আবেগ অনুভূতি ও শক্তির মূল কেন্দ্র হলো এই হৃদপিণ্ড।
বের করে নেওয়ার পর অঙ্গগুলোকে ভালো করে ধুয়ে ‘রজন’ নামের এক ধরনের গাছের আঠালো রসের প্রলেপ দিয়ে পাটের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে এক ধরণের বিশেষ পাত্রে রাখা হতো। এ বিশেষ পাত্রগুলোকে বলা হয় “ক্যানোপিক জার” (canopic jar ) এই ক্যানোপিক জারগুলো আবার চার রকম, যেসবের আবার ভিন্ন ভিন্ন নামও আছে। নামগুলো হল- ইনসেটি, হাপি, ডুয়ামেটেফ, আর কেবেহসেনুয়েফ। এই চারটি জারে যথাক্রমে যকৃত, ফুসফুস, পাকস্থলী আর অন্ত্র রাখা হতো।
৪. পঁচনশীল অঙ্গগুলো বের করার পর এবার মগজটা বের করা হতো। একটা লম্বা মতন হুকের সাহায্যে নাকের ভেতর কায়দা করে একটা লম্বা চামচ এর মত জিনিস দিয়ে পুরো মস্তিষ্কটা বের করে আনত। তবে এত কষ্ট করে বের করা মস্তিষ্ক কিন্তু তারা সংরক্ষণ করতো না! কারণ তারা ভাবতো মগজ আসলে অপ্রয়োজনে একটা জিনিস, তাই তারা এটা বের করে ফেলে দিতো!
৫. এখন পুরো শরীরটিতে বাইরের অঙ্গগুলো ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই নেই। ভেতরের অঙ্গগুলো সরানোর পর যে জায়গাটি ফাঁকা হয়ে গেল, সে জায়গাটি এখন ভরে দেয়ার পালা। নয়তো মৃতদেহটিকে তো আর জীবিতদের মতো লাগবে না! তাই ফাঁকা স্থানটি ভালোমতো তাড়ি দিয়ে মুছে ফেলা হতো। এরপর ওই বাম দিকের কাটা অংশটা দিয়ে ধুপ ও অন্যান্য পদার্থ ভরে দেয়া হতো।
৬. এবার পুরো দেহটিকে ন্যাট্রন (natron ) পাউডারে মুড়ে দেয়া হতো। ন্যাট্রন হলো এক ধরণের লবণ। এই ন্যাট্রন এর কাজ হল চামড়ার রঙ খুব একটা পরিবর্তন না করেই মৃত দেহের সব জলীয় পদার্থ শোষণ করে ফেলা। আর এই শোষণ কাজটি করার জন্য ন্যাট্রনএর সময় লাগত ৩৫ থেকে ৪০ দিন।
৭. ৪০ দিন পর মমিটিকে নিয়ে আনা হতো ওয়াবেট নামক ঘরে। এই ঘরে শুকিয়ে যাওয়া মৃতদেহটি থেকে বের করে আনা হবে সেইসব ভরে দেয়া ধুপ ও অন্যান্য পদার্থ। তাহলে এখন ফাঁপা জায়গাটিতে কী থাকবে? এখন ওই ফাঁকা স্থান ভরে দেওয়া হবে ন্যাট্রন, রজনে সিক্ত পাটের কাপড় ও আরো কিছু পদার্থ দিয়ে। ফাঁকা জায়গা ভরাট করে আবার আগের মত হয়ে যাওয়া দেহটির কাটা স্থানগুলো এবার সেলাই হবে। এরপর দেওয়া হবে রজনের প্রলেপ। আর এর পরে শুরু হবে সবচেয়ে জটিল প্রক্রিয়া। ব্যান্ডেজ দিয়ে দেহটিকে মুড়িয়ে দেওয়ার কাজ।
৮. লিনেনের পাতলা কাপড়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে পুরো শরীরটিকে মুড়িয়ে দিতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগে যেত। ব্যান্ডেজ করার শুরু হতো মাথা ও গলা দিয়ে, এরপর থেকে একে একে হাত পা আর পুরো শরীরটাই মুড়িয়ে দেয়া হতো। আবার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে আলাদা করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হতো। এই ব্যান্ডেজটা কিন্তু কেবল এক স্তর করে দিয়েই শেষ হয়ে যেত না। কয়েক স্তর ব্যান্ডেজ করা হতো। আর প্রতি স্তরকে জোড়া লাগানোর জন্য ব্যবহার করা হতো রজেন। আর ব্যান্ডেজ করার পুরো সময়টিতে পড়া হত মন্ত্র। ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে মমির হাত-পা একসাথে বেঁধে হাতের মাঝে “ বুক অফ ডেড” থেকে নেওয়া প্যাপিরাসে লেখা মন্ত্র আটকানো থাকতো।
৯. এরপর মৃতের শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগানো হত শক্ত খাঁচা। আর মাথায় পরিয়ে দেয়া হত মুখোশ। মুখোশটি বানানো হতো হয় মৃত ব্যক্তির সাথে মিল রেখে, নয়তো কোন মিশরীয় দেবতার মুখের মত করে; মিশরীয়দের মতে এই খাঁচার পোশাক মৃতের আত্মাকে সঠিক দেহ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
১০. সবশেষে এখন খাঁচা সমেত মমিটিকে কফিনে ভরার পালা। কফিনে শুধু মমিটিকেই ভরা হত না, পরকালে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন খাবার আর মূল্যবান গহনা এমনকি মমি করা পোষা প্রাণিকেও ভরে দেয়া হতো! আর এভাবেই শেষ হতো পুরো প্রক্রিয়া।
অভিশপ্ত মমি:
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত মমি আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মমিটি হলো মিশরীয় সম্রাট তুতেনখামেনের। তুতেনখামেন ছিলেন মিশরীয় সম্রাট আখেনাতেনের পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সে ‘ফারাও’ উপাধি লাভ করেন তথা মিশরের সম্রাট হন। তার ঠিক পাঁচ বছর পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার জীবনাবসান ঘটে। তার সমাধিক্ষেত্র ও মমি আবিষ্কৃত হয় ১৯১৭ সালে। তার সমাধিক্ষেত্রের দেয়ালে পাওয়া যায় হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে খোদাই করা অদ্ভুত এক ভবিষ্যতবাণীর। সেখানে লেখা ছিলো, “যে রাজার চিরশান্তির ঘুম নষ্ট করবে, তার উপর নেমে আসবে অভিশাপ।”
তারপরই ঘটতে শুরু করে অদ্ভুত সব ঘটনা। ১৯২৩ সালের ৫ এপ্রিল এই খনন অভিযানে অর্থের যোগানদাতা লর্ড কার্নারভন মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ বলেন তিনি সামান্য এক মশার কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার কারও কারও মতে, শেভ করার সময় গলা কেটে অতিরিক্ত রক্তপাত হয়ে মারা যান তিনি। লর্ড কার্নারভনের মৃত্যুর কয়েক-ঘণ্টা পরেই তার কুকুরটি কোনো একটা কিছুকে তাড়া করতে গিয়ে মারা যায়।
সমাধিতে যারা পা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে আমেরিকান ধনকুবের জর্জ গোল্ড অন্যতম, যিনি পেশায় ছিলেন রেলপথ নির্বাহী। ১৯২৩ সালে তুতেনখামেনের সমাধি পরিদর্শনকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর সুস্থ হননি। কয়েক মাস নিউমোনিয়ায় ভুগে তিনি মারা যান। সমাধির ভেতরের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন তৎকালীন মিশরের যুবরাজ আলি কামেল ফাহমি। ১৯২৩ সালে নিজ পত্নীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান যুবরাজ। তুতেনখামেনের মমি সর্বপ্রথম এক্স-রে করেছিলেন স্যার আর্চিবোল ডগলাস বে। এক্স-রে করার পরের দিনই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সেই অসুস্থতা তার শরীরে বিদ্যমান ছিল বহুদিন। ১৯২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়। ফ্র্যাঙ্ক র্যালে নামক একজন ফটোগ্রাফার ছবি তুলেছিলেন তুতেনখামেনের কবর ঘরে। তিনি অন্ধ হয়ে ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ধনী ব্যবসায়ী ওল্ফ জোয়েল শখের বশে সাক্ষী হয়েছিলেন তুতেনখামেনের মমি দেখার। এর কিছুদিন পরেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক হয় তার। তাতে মারা যান তিনি। সমাধিটি দেখতে এসেছিলেন সুদানের গভর্নর জেনারেল স্যার লি স্ট্যাক। তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয় কায়রোতে। আর্থার মেস নামক এক খননকর্মী ছিল কার্টারের দলে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় তিনি বেঘোরে প্রাণ হারান ১৯২৮ সালে।
আরও পড়ুন# মঙ্গলপুর: জন-মানবশূন্য এক গ্রামের গল্পকথা!
তালিকায় আছে হাওয়ার্ড কার্টারের পার্সোনাল সেক্রেটারি রিচার্ড বেথেলও। তিনিই কার্টারের পেছনে সবার আগে সমাধিতে প্রবেশ করেছিলেন। ১৯২৯ সালের ১৫ নভেম্বর লন্ডনের একটি অভিজাত ক্লাবের কামরা থেকে তার পুড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করা হয়। রিচার্ড বেথেল তার বাড়িতে তুতেখামেনের সমাধি থেকে পাওয়া কিছু প্রত্ন সম্পদ তার বাড়িতে সাজিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। রিচার্ডের বাবা বৃদ্ধ লর্ড ওয়েস্টবেরি প্রায় সময়ই আপনমনে বিড়বিড় করে বলতেন, “এই জিনিসগুলো অভিশপ্ত। এগুলোতে ফারাওয়ের অভিশাপ রয়েছে।” তিনি নিজের লেখা সর্বশেষ চিরকুটে লিখে যান, “এই বিভীষিকা আমি আর সহ্য করতে পারছি না, আমি এর থেকে চির মুক্তি চাই।” তারপর তিনি সাত তলা দালান থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পাঁচ দিন পর লর্ড ওয়েস্টবেরির কফিনকে একটি গাড়িতে চাপিয়ে গোল্ডার্স গ্রিনের কবরখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন সেই গাড়িতে ধাক্কা লেগে আট বছরের এক বালক নিহত হয়।
উল্লেখ্য, তুতেনখামেনের মমি ও সমাধিক্ষেত্রে পাওয়া সকল ধনরত্ন মিশরের কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা আছে।
সবচেয়ে রহস্যময় মমি:
ফারাওদের ইতিহাসে মোট ১৭০ জন রাজার কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে নারী শাসক তথা রানীর সংখ্যা হাতেগোণা। রানী ক্লিওপেট্রার পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত যে রানীর কথা ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায় তার নাম ছিল নেফারতিতি। তিনি ছিলেন সম্রাট আখেনাতেনের স্ত্রী। যদিও তার কথা মানুষ ভুলতেই বসেছিল। নেফারতিতিকে প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাণী হিসেবে ঐতিহাসিকরা গণ্য করেন। তাকে অসংখ্য নামে ও উপাধিতে অভিহিত করা হয়েছে তাকে Ruler of the Nile এবং Daughter of Gods হিসাবে ডাকা হয়। দীর্ঘ এবং হাসের মত গলার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি গ্যালেনা উদ্ভিদ ব্যাবহার করে তার রূপসজ্জা করতেন। প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসে নেফারতিতিকে খুশি, আনন্দ বা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিছু মানুষের কাছে নেফারতিতি ছিলেন ধর্মত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক। আর কারও কাছে তিনি ছিলেন একজন জীবিত দেবী যিনি তার সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছিলেন তার দেশের জন্য। তিনি ছিলেন একাধারে রহস্যের রাণী, যাদুর রাণী, ভালোবাসার রাণী কিংবা হিংসাপরায়ণতা এবং প্রতিশোধের রাণী। একটি খণ্ডিত পাথরের লিপি উদ্ধার হলে দেখা যায়, সেখানে নেফারতিতির নাম রয়েছে। যেখানে তার নামের পাশে উৎকীর্ণ রয়েছে “গ্রেট রয়্যাল ওয়াইফ” শব্দটি যা তার সামাজিক মর্যাদা প্রকাশ করছে। এমন বেশ কিছু পাথর চিত্রে দেখা যায় নেফারতিতি যুদ্ধরথে চড়ে একটি দণ্ড উঁচিয়ে আছেন । এ থেকে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন তিনি ছিলেন “সুপ্রিম অথরিটি অব দ্য স্টেট”। অন্য চিত্রে তাকে দেখা যায় তরবারি হাতে মিশরের শত্রুদের নিধনে ব্যস্ত।এছাড়াও রয়েছে সভ্রান্তদের মাঝে স্বর্ণপদক বিতরণের চিত্র। সব মিলিয়ে এসকল “ফ্রেসকো” থেকে যে ছবি পাওয়া যায় তা নেফারতিতিকে চিত্রিত করেছে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা মিশর অধীশ্বরী হিসেবে। এ পর্যন্ত মিশরের প্রাচীন ইতিহাসে আর কোনও রাজকীয় মহিলার এমন ছবি পাওয়া যায়নি। অথচ ১৯১২ সালের আগে নেফারতিতিকে মানুষ চিনতোই না। তার মমিটি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই সবচেয়ে রহস্যময় মমি হিসেবে নেফারতিতির মমিটিকেই গণ্য করা হয়।
বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মমিকরণ:
মিশরীয়দের মতো বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও মমিকরণের ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মৃত্যুর পর মমি হতে চাইতেন বলে মত গবেষকদের। তারা তিব্বত ও চীনের বরফাচ্ছাদিত এলাকার ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ধ্যানরত অবস্থায় থাকতেন। এই অবস্থায় প্রাণত্যাগের পর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তাদের দেহ প্রাকৃতিকভাবেই মমিতে পরিণত হতো। এসব সন্ন্যাসীর মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখা হতো বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে। স্থানীয় মানুষের কাছে তারা ঈশ্বরের মতো পূজা পেয়ে থাকেন।
অন্যান্য সভ্যতায় মমিকরণের ইতিহাস:
পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতায় মমি করে রাখার পদ্ধতির প্রচলণ ছিল। মায়ান সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা, আমেরিকা ও মেক্সিকোর রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যেও মমিকরণের ইতিহাস রয়েছে। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউগিনির আদিবাসীদের ভেতর মমি করে মৃতদেহ সংরক্ষণ করার প্রচলন আছে। ইন্দোনেশিয়ার একটি গ্রামে এখনও মৃত্যুর পর গ্রামবাসী তাদের পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ সংরক্ষণ করে থাকে।
শেষ কথা:
মমি তৈরির ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না। মমি যেমনই রহস্যময় তেমনি ঐতিহাসিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণও। তাই গবেষকরা এখনও মমি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। এতে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। কোন একদিন হয়তো আমরা মমির সকল রহস্য উন্মোচন করে ফেলবো। সে’দিন গোটা মানবজাতি স্পর্ষ করবে এক অনন্য মাইলফলক। ততদিন পর্যন্ত আমরা কেবলই অপেক্ষা করে যেতে পারি এই অনাবিষ্কৃত সব রহস্যের সমাধানের আশায়।