জাতীয়সন্দেশস্বাস্থ্যস্বাস্থ্য ও লাইফস্টাইল

দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩৭ মৃত শিশুর জন্ম হচ্ছে!

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি হতে জুলাই মাস অবধি ৭ মাসে সরকারি ৫৮৬টি হাসপাতালে দিনে গড়ে ৩৭টি মৃতশিশু জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ নবজাতক মৃত্যুর দুই–আড়াই গুণের বেশি জন্ম হচ্ছে মৃত শিশু। মৃতজন্ম বা মৃত প্রসব বলতে সাধারণত বোঝায়, গর্ভবতী নারীর গর্ভে ২৮ সপ্তাহ পূর্ণ করার পর যদি কোনো শিশু মারা যায় তাকে। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে ২৪ সপ্তাহ অবধি গর্ভে থাকার পর মৃত শিশুর জন্ম হলে তাকেও মৃতজন্ম বলে।

মৃত শিশুর জন্মের কারণ কী?

মৃত শিশু জন্মের কারণ সম্পর্কে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি ফেরদৌসী বেগম বলেন— যদি প্রসূতি মায়ের বয়স ১৬ বছরের কম এবং ৩৫ বছরের ওপরে হয় তবে মৃত শিশু জন্মাতে পারে। এছাড়াও প্রসূতি মায়ের স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কোনো সংক্রমণ থাকলে, ৪২ সপ্তাহের অধিক গর্ভধারণ হলে, প্রসবের পূর্বের সেবায় অবহেলা, গর্ভকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টি ও যত্নের অভাব এবং প্রসবের সময় পর্যাপ্ত সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করকে মৃত শিশু জন্মানোর ঝুঁকি থাকে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে মৃত শিশু জন্মের হার বেশ বেশি। যদি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় বর্তমানের তুলনায় ৬-৮ গুণ বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে প্রত্যাশিত হারে কমবে এই মৃত শিশু জন্ম, নবজাতক ও প্রসূতি মায়ের মৃত্যু। এছাড়াও এখনো অনেকে সন্তান প্রসবের সময় প্রসূতিকে হাসপাতালে আনেন না অথবা হাসপাতাল আনার পর নিরাপদ প্রসবের যথাযথ ব্যবহার গ্রহণ করেন না, ফলে এই প্রসব প্রক্রিয়ার একদম শেষ পর্যায়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মৃতজন্মের ঘটনা ঘটে।

তাছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন পরিচালক ( মা, নবজাতক শিশু এবং কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য) বলেন—‘মৃতজন্মের হার আমাদের দেশে কিছুটা বেশি। তবে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। মৃতজন্মের কারণগুলো বের করা হয়েছে। মৃতজন্ম, মাতৃমৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত। ফলে প্রসবপূর্ব ও গর্ভকালীন সেবা ও নিরাপদ প্রসব প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন জোরদারের মাধ্যমে এসব মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। সরকার ‘দ্য এভরি নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে।’

আরও পড়ুন# ‘ভুল চিকিৎসায়’ মৃত্যু গর্ভবর্তী নারীর, হাসপাতাল ঘেরাও করলেন স্বজনরা!

প্রতি হাজারে ৩৩ মৃতজন্ম

চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ৭ মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত দেশেগুলোর ৪৩০ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৩৩টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেলা পর্যায়ে ১০ থেকে ২৫০ শয্যার ১২৩টি হাসপাতালসহ মোট ৫৮৬টি সরকারি হাসপাতালে ৭ হাজার ৭৯৫টি মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে। এছাড়াও এই সংখ্যা সাত মাসে নবজাতক মৃত্যুর দ্বিগুণেরও বেশি। এই ৭ মাসে জন্ম নেওয়া মোট শিশুর সাথে তুলনা করলে দেখা যায় প্রতি হাজারে জন্ম নিচ্ছে ৩৩ টি মৃত শিশু।

এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করেলে দেখা যায়, মোট মৃতজন্মের মধ্যে ৩ হাজার ৭৩৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, ২ হাজার ৪১৩টি জেলা হাসপাতালে এবং ১ হাজার ৬৪৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৯ সালে ১৫ হাজার ৭৫৩টি, ২০২০ সালে ১৪ হাজার ২৫৫টি এবং ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৯৫৯টি মৃত শিশু জন্ম হয়েছে। যা ৫৮৬ টি সরকারি হাসপাতালের চিত্র।

এসব হাসপাতালের বাইরে বাড়িতে ও বেসরকারি হাসপাতালে সন্তান সবচেয়ে বেশি প্রসব হয়। আর ওইসব সেসব স্থানে কত মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে। তার সঠিক হিসাব নেই।

সরকারি তিনটি বড়ো জরিপ হলো, বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্যজরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭–১৮, মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ এবং বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০। এই জরিপের প্রতিবেদনে মৃত শিশুর জন্মের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি।

তবে, বিডিএইচএস বা বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্যজরিপের সর্বশেষ ( ২০১৭–১৮) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসপাতালে মাত্র ৫০ শতাংশ সন্তানের জন্ম হয়। আর এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালের হয় ১৪ শতাংশ।

মৃত শিশু জন্মে বাংলাদেশ সপ্তম

২০২০ সালে ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘অ্যা নেগলেকটেড ট্র্যাজেডি: দ্য গ্লোবাল বার্ডেন অব স্টিলবার্থ’ এর প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মৃত শিশু জন্মের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও তিনটি সংস্থা ‘দ্য এভরি নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশে মৃতজন্ম প্রতি হাজারে ১২–এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে মৃত শিশু জন্মের হার প্রতি হাজারে প্রায় ১৪৷

তাছাড়াও ২০১৬ সালে মেডিকেল সাময়িকী ল্যানসেট–এ ‘এন্ডিং প্রিভেনটেবল স্টিলবার্থ’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশে ৮৩ হাজার মৃত শিশু জন্ম নেয়। যা সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে ১০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে আছে। আর প্রথম ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। আর বাকি ৭ টি দেশের মধ্যে আছে ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকার ৬ টি দেশ। আর প্রতি হাজারে মৃত শিশুর জন্মের তালিকায় শীর্যে ১০ টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তান এবং বাকি নয়টি দেশ হলো আফ্রিকার।

অন্যদিকে, বিএমসি প্রেগন্যান্সি অ্যান্ড চাইল্ডবার্থ সাময়িকীতে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মৃত শিশু জন্মের ওপর প্রকাশিত ‘স্টিলবার্থ সার্ভিল্যান্স অ্যান্ড রিভিউ ইন রুলাল ডিস্ট্রিক্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন মতে, দেশের গ্রামে বাড়িতে প্রায় ৫৪ শতাংশ মৃত শিশু জন্ম। আর এই মৃত শিশু জন্মের ১৫ শতাংশ হলো মাতৃত্বকালীন উচ্চ রক্তচাপ, ১৪শতাংশ রক্তক্ষরণ, ১১ শতাংশ অক্সিজেন স্বল্পতা এবং ৯ শতাংশ মাতৃত্বকালীন সংক্রমণ থাকার জন্য হয়েছে। এছাড়া বাকি মৃত শিশু জন্মের সঠিক কারণ জানা যায়নি। আবার, ৪৮ শতাংশ মা উচ্চ প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কাছ থেকে গর্ভকালীন সেবা নিয়েও মৃত শিশু জন্ম দিয়েছেন।

এই বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্যবিদ ইশতিয়াক মান্নান বলেন— বর্তমানে বাংলাদেশে দবিদ্যমান মাতৃসেবা কর্মসূচিগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বছরে ৮৩ হাজার শিশুর অধিকাংশই পৃথিবীর বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারত। কমত মৃত শিশু জন্মের হার। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য। আর এইজন্য মৃত শিশু জন্মের হিসাব পাওয়া বেশ কষ্টকর ও কঠিন। যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই হিসাব রাখলে, মৃতজন্ম প্রতিরোধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্ভব।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।