ফিচারবিজ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

রঙিন প্রজাপতি,দের অজানা সব তথ্য!

প্রজাপতি এমনই এক পতঙ্গ প্রাণী, যারা মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। তাদের রঙিন মাখার মোহে মানুষ বহু যুগ ধরেই পড়ে এসেছে। এইজন্য গানে, কবিতায়, ছন্দে বা বিভিন্ন উপমায় খুব সহজেই স্থান করে নিয়েছে প্রজাপতি শব্দটি। প্রজাপতি ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়, যা প্রকৃতির সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে তোলে। যদিও প্রজাপ্রতিদের জীবন চক্র মাত্র অল্প দিনের। কিন্তু, এই অপরুপ সুন্দর প্রাণীটির সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। তাই আজকের আর্টিকেলে এই অপূর্ব রঙিন প্রজাপতিদের অজানা সব তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

•পা দিয়ে প্রজাপতির স্বাদ গ্রহণ—আমরা তো মুখ দিয়ে খাবার খাই, জিভ দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু অবাক করা বিষয়, প্রজাপতিরা খাবার খোঁজা ও স্বাদ গ্রহণের কাজে পা ব্যবহার করে। বেশ আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এটাই, স্বাদ পরীক্ষা করার জন্য যে রিসেপ্টর থাকে, তা প্রজাপতিদের পায়ে অবস্থিত। এছাড়াও নারী প্রজাপতিরা এক গাছ হতে আরেক গাছে ঘুরে বেড়ায় এবং তাদের পা দিয়ে গাছের নির্দিষ্ট স্থানে আঘাত করতে থাকে। তারপর ওই গাছ হতে নিঃসৃত রস তাদের পায়ের কেমোরিসেপ্টরের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখে যে তা ডিম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা। উপযুক্ত হলে তারা সেই স্থানে ডিম দেয়। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রজাপতির লার্ভা জন্মানোর পর সেই গাছ বা গাছের পাতা হতেই প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান পেতে থাকে। তাই প্রজাপতিরা পায়ের মাধ্যমে এমন আর্দশ জায়গা খুঁজে থাকে খাবার বা ডিম দেওয়ার জন্য। যদিও প্রকৃতিতে একমাত্র পতঙ্গ প্রজাপতিই নয়, যে পায়ের মাধ্যমে খাবার সংগ্রহ করে। এমন আরও অনেক পতঙ্গ রয়েছে। যেমন: ঝিঝিঁ পোকা, পঙ্গপাল, ইত্যাদি।

•প্রজাপতিরা কেবল তরল খাবারের উপর নির্ভরশীল—আমাদের মতো প্রজাপতিদের মুখে চিবানোর মতো কোনো দাঁত বা শক্ত অংশ থাকে না। এইজন্য প্রজাপতিরা শক্ত খাবার একদমই খেতে পারে না। প্রজাপতির মুখে নলের মতো একটি প্রোবসিস বা শুঁড় থাকে। যেই শুঁড় দিয়ে এরা কেবলমাত্র তরল খাবার খেতে পারে৷ তরল খাবারের মধ্যে এদের প্রধান খাদ্য হলো ফুলের মধু। এছাড়াও এরা নরম ফল বা গাছ হলেও তরল রস খাবার হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। তবে, একটা মজার বিষয় হলো, প্রাপ্ত বয়স প্রজাপতিদের মুখে চিবানোর মতো কোনো অংশ না থাকলেও, তাদের লার্ভা বা ক্যাটারপিলারদের মুখে চিবানোর জন্য ম্যান্ডিবলস নামক অংশ থাকে। যার মাধ্যমে লার্ভারা অবশ্য শক্ত খাবার খেতে পারে। লার্ভাদের এই ম্যান্ডিবলস থাকার কারণ হলো, লার্ভারা তাদের জন্মস্থান হতে প্রাথমিক অবস্থায় অন্য কোথাও যেতে পারে না। যার জন্য জন্মস্থানের গাছের পাতা খেয়ে প্রাথমিক অবস্থায় এদের জীবন ধারণ করতে হয়।

•প্রজাপতিদের স্বচ্ছ ডানা— আমাদের চারপাশে যত পতঙ্গ রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে রঙিন পতঙ্গ হলো প্রজাপতি। বাহারি রঙে রাঙানোর থাকে প্রজাপতির ডানা, যেই ডানাই তাদের সৌন্দর্য মূল হোতা। তাদের এই রঙিন ডানাগুলো কাইটিন নামক এক রকমের প্রোটিবের স্তর দিয়ে তৈরি। যা অত্যন্ত পাতলা৷ আর এই কাইটিনের ডানার উপর থাকে বিভিন্ন ধরনের তন্তু বা আঁশ। যেখানে আলোর প্রভাবে আমরা শত রঙের প্রজাপতি দেখি। কিন্তু, বয়স বাড়ার সাথে সাথে এসব তন্তু বা আঁশ ঝরে যায়, তখন কেবল থেকে যায় কাইটিনের ডানা। একটু মনোযোগ সহকারে খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রজাপতির ডানাগুলো একদম স্বচ্ছ। যার এক পাশ হতে অন্য পাশ অনায়াসে দেখা যায়। তবে প্রজাপতির জন্য কাইটিনের তৈরি স্বচ্ছ ডানার উপরে থাকা তন্তু বা আঁশের আবরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই আঁশই ডানাগুলোকে করে মজবুত এবং উড়ার সময় দুই পাশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সহায়তা প্রদান করে। প্রজাপতিরা সাধারণত খাদ্য গ্রহণ, মিলনের সময়, উড়তে গিয়ে কিছু কিছু আঁশ হারিয়ে ফেলে। তবে, এতে তাদের উড়তে তেমন একটা ক্ষতি হয় না। কিন্তু যদি প্রজাপতিরা অধিক হারে এই আঁশ হারায়, তবে তা তাদের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কেননা, প্রজাপতিরা নতুন করে আঁশ সৃষ্টি করতে অক্ষম।

• প্রজাপতির কয়েক সপ্তাহের জীবন— অন্যতম সুন্দর এই পতঙ্গ খুব বেশিদিন পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারে না। এদের জীবন কাল খুবই কম। একটি পূর্নবয়স্ক প্রজাপতির জীবনকাল মাত্র ১-২ সপ্তাহ। এদের জীবন চক্রের রয়েছে চারটি ধাপ। যেমন—ডিম, লার্ভা, পিউপা বা ক্রিসালিস এবং প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতি। প্রজাপতিরা ক্রিসালিস ধাপ হতে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। এরপর এরা এদের জীবনের সব সময় ব্যয় করে খাদ্য সংগ্রহ, খাওয়া ও বংশবিস্তারের ওপর। যদিও বেশিরভাগ প্রজাপতিই বেঁচে থাকে মাত্র ১-২ সপ্তাহ, তবে অল্প কিছু প্রজাপতির প্রজাতি রয়েছে যারা ১৮ মাস অবধি বেঁচে থাকে। •প্রজাপতির কর্দমাক্ত ডোবা থেকে পানি পানের রহস্য—আমরা জেনেছি, প্রজাপতিরা তরল খাবার খেয়ে বাঁচে এবং মধুই তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু, কেবলমাত্র মধু খেয়ে প্রজাপতিরা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে না। যখন পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তখন এরা কর্দমাক্ত ডোমা বা ভেজা বালি হতে পানি পান করে। এসব পানি খনিজ সমৃদ্ধ হওয়ায় প্রজাপতিদের লবণের চাহিদা পূর্ন হয়। তবে এই কর্দমাক্ত ডোবা হতে পানি পান করার বৈশিষ্ট্য পুরুষ প্রজাপতিদের নারী প্রজাপতির তুলনায় বেশি থাকে। যা সাধারণত পুডলিং নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, এই খনিজযুক্ত পানি পুরুষ প্রজাপতিদের বংশ বিস্তার করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

আরো পড়ুন: ঠোঁটের কালচে ভাব দূর করার একদম সহজ উপায় তাও আবার ঘরে বসেই

•ঠাণ্ডায় প্রজাপতি উড়তে অক্ষম—প্রজাপতির অন্য প্রাণীদের মতো নিজের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা উৎপন্ন করতে অক্ষম। কেননা, প্রজাপতিরা শীতল রক্তবিশিষ্ট পতঙ্গ। এইজন্য, এদের জীবনচক্রের উপর চারপাশের পরিবেশের তাপমাত্রার প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাপতিদের বাসস্থানের তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে, এদের শরীরের তাপমাত্রাও কমে যেতে থাকে। ফলে এক পর্যায়ে প্রজাপতিরা আর ডানা মেলে উড়তে পারে না। প্রজাপতিরা সাধারণত ৬০-১০৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট অবধি তাপমাত্রায় উড়তে পারে। তবে এদের উড়ার জন্য আর্দশ তাপমাত্রা ধরা হয় ৮২-১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। এরা অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় উড়তে না পারলে পাথর, গাছ বা পাতার উপরে আশ্রয় নিয়ে থাকে এবং এই আশ্রয়ের সময়টাতেই এরা শিকারে বেশি পরিণত হয়।
•প্রজাপতির দৃষ্টিশক্তি খুব একটা প্রখর নয়—প্রজাপতিরা সাধারণত ১০-১২ ফুটের বেশি দূরুত্বের বেশি কোনো বস্তু তেমন দেখতে পায় না। তবে, এদের এত কম দৃষ্টিশক্তি হলেও মানুষের না দেখা অতিবেগুনি রশ্মি এরা ঠিকই দেখতে পায়। এদের খাবার সংগ্রহের জন্য ফুল যাচাই, সঙ্গী নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে এই দৃষ্টিশক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখে। গবেষকরা গবেষণা করে দেখেছেন, প্রজাপতিদের কমপক্ষে ১৫ টি আলাদা ধরনের ফটোরিসেপ্টর রয়েছে এবং প্রত্যেকটি রিসেপ্টর আলাদা আলাদা রঙে উদ্দীপিত হয়।
•ছদ্মবেশী প্রজাপতি—শিকারির খাবারে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচতে প্রজাপতিরা ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। এরা খাদ্য শৃঙ্খলার নিচের দিকের প্রাণী হওয়াতে বিভিন্ন পাখি, মাকড়শা, টিকটিকি ও অন্যান্য আরও অনেক প্রাণীর খাদ্য তালিকাতেই প্রজাপতির স্থান রয়েছে। অন্যান্য প্রাণীদের মতো প্রজাপতিদের তেমন কোনো শক্তিশালী আত্মরক্ষার উপায় না থাকলেও এরা ক্ষুধার্ত শিকারীর হাত হতে নিজেদের বাঁচাতে ছদ্মবেশ ধারণ করে। যেটি এদের সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। এরা ডানার রঙ ও নকশার সাথে মিলিয়ে আশ্রয়স্থল নির্ণয় করতে পারলেই অতি সহজে এরা শিকারীর নজর এড়িয়ে যায়৷

তবে অবশ্য কিছু প্রজাপতি এই ছদ্মবেশের ঠিক বিপরীত পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এদের অত্যন্ত কড়া রঙের নকশার মাধ্যমে প্রজাপতিরা নিজেদের উপস্থিতি সগৌরবে জানান দিয়ে থাকে। কেননা, অনেক খুব বেশ রঙিন পতঙ্গরা বিষাক্ত হয়ে থাকে, তাই শিকারিরা খুব বেশি রঙিন পতঙ্গ খাওয়া হতে বিরত থাকে। এসব রঙ্গিন পতঙ্গ এড়িয়েও চলে শিকারি প্রাণীরা। আর এই সুযোগটাই কাছে লাগায় প্রজাপতিরা। তবে প্রজাপতিরা বিষক্ত নয়, বিষাক্ত পতঙ্গের নকশার গড়নে কিছু প্রজাপতির ডানা রাঙানো থাকলে তা আত্মরক্ষায় বেশ কাজে দেয়।
যাই হোক, আজকের মতো এখানেই শেষ করছি প্রজাপতিদের অজানা গল্প। আর যদি এই আর্টিকেলটি ভালো লাগে তবে অবশ্যই শেয়ার করবেন এবং এই ধরনের আরও নিত্যনতুন অজানা তথ্য জানতে অনুলিপির সাথেই থাকুন।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।