ফিচারলাইফস্টাইলস্বাস্থ্য ও লাইফস্টাইল

খাবার টেবিলে মেনে চলুন কিছু ভদ্রতা ও আদব-কায়দা!

কিছু ভদ্রতা , একজন মানুষ ভদ্র বা মার্জিত কিনা তা মূলত তার কিছু আচরণই প্রকাশ করে। কথা বলার ভঙ্গি, ব্যক্তির চালচলন তো ভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ বটেই। তবে, যদি খাবার টেবিলে ব্যক্তি হুরমুর করে সবার সামনে গোগ্রাসে খাবার খায়, কিংবা পা তুলে শব্দ করে, কারো দিকে না তাকিয়ে সসম্পূর্ণ খাবার খায়, তবে সে ব্যক্তির আচরণ যতই মার্জিত হোক। তাকে ঠিক ভদ্রতার তকমা দেওয়া যায় না। যদিও একেক দেশে একেক রকম খাওয়ার প্রচলন থাকে। কোথাও হয়তো চামচ দিয়ে,কোথাও হাত, আবার কোথাও চপস্টিক। এইজন্য দেশ, জাতি ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে খাবার টেবিলের ভদ্রতা। তবে, কিছু নিয়ম সব দেশেই একই থাকে, সেগুলো একজন ব্যক্তির মেনে চলা উচিত। তাতে আপনি গেস্ট বা হোস্ট যাই হোক, মাথায় কিছু বিষয় রাখতেই হবে। আজকের আর্টিকেলটি এই খাবার টেবিলের ভদ্রতা নিয়েই। চলুন জেনে নেই—খাবার টেবিলে কী কী নিয়ম মেনে চলা উচিত!
যদি প্রশ্ন করা হয়, একজন ব্যক্তির ঠিক কোন বিষয়গুলো দেখে আমরা বলে দিতে পারি, অমুক খুব ভদ্র বা মার্জিত, কিংবা কোন আচরণগুলো দেখলে আমাদের মনে হয় যে অমুক খুব সুন্দর আদব-কায়দা জানে? উত্তর হবে, ব্যক্তির চালচলন কিংবা কথা বলার ভঙ্গি।

•হোস্ট বা আপ্যায়ককে অনুসরণ করুন— আপনি যদি অতিথি হন, তবে আপনার আপ্যায়ক বা হোস্টকে অনুসরণ করুন। হুট করে গিয়েই চেয়ার টেনে বসে না পড়ে, দেখুন হোস্ট আপনাকে কোথায় বসতে বপছে! সেই অনুসারে বসুন এবং আপনার আপ্যায়ক চেয়ারে বসা না অবধি তার জন্য অপেক্ষা করুন। আর অবশ্যই চেয়ার টেনে বসার সময় খুব শব্দ করে চেয়ার টানবেন না, এটা এক প্রকার খারাপ ম্যানার। তাই আস্তে আস্তে চেয়ার সরান যাতে আওয়াজ না হয় এবং চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসার চেষ্টা করুন। যদিও পারিবারিক খাবার টেবিলে অনেকেরই অভ্যাস থাকে কনুই, হাত পা ওঠিয়ে বসার, তবে এটা কোনো অনুষ্ঠানে বা প্রোগ্রামে করা যাবে না। এছাড়াও জেনে রাখুন, প্রধান অতিথি সব সময় বসে থাকেন হোস্টের ডান পাশে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনি যদি কোনো অনুষ্ঠানে কারো দিকে তা তাকিয়ে বা কারো প্রতি মনোযোগ না দিয়ে কেবল নিজেই একমনে আস্তে বা জোরে খেতে থাকেন। তবে সেটা আপনাকে অভদ্র হিসাবে চিহ্নিত করবে। একটি খাবার টেবিলে সবার সাথে গতি রক্ষা করে খেতে হবে৷

•খাবার পরিবেশন করুন সঠিক নিয়মে—খাবার টেবিলে ভদ্রতার অন্যতম আরেকটি বহিঃপ্রকাশ হলো পরিবেশনের নিয়ম। সবসময় খাবার টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে হবে হোস্টের বামপাশ হতে এবং বামপাশ হতে খাবার নেওয়া হলে ডানপাশে সরিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু যদি খাবার টেবিলে হোস্ট উপস্থিত না থাকে, তবে একজন খাবার নিয়ে পরের জনমে দিয়ে দেবেন এবং এটা খাবারের প্রতিটি পদের বেলাতেই। এছাড়াও তরল বা পানীয় খাবারগুলো প্রধান খাবারের পদের বামে রাখতে হয় এবং অন্য পাশে অর্থাৎ ডানে বাকি খাবারগুলো রাখতে হয়।
আমরা অনেকেই আছি, যারা বিয়ে বা কোনো দাওয়াতে গেলে এমন ভাবে খাওয়া শুরু করি, যেন খাবারের প্রতিযোগিতা চলছে। এটা অত্যন্ত অভদ্রতা। আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে যে, ওই অনুষ্ঠান বা দাওয়াতে ঠিক আপনার জন্য কতটুকু খাবার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ততটুকু নিজে নিয়ে এরপর সবাইকে নিতে দিন। টেবিলের সবার নেওয়া শেষ হলে, পরে আবার নিতে পারেন।
আর আপনি হোস্ট হলে টেবিলের সকল অতিথিকে সমান গুরুত্ব দিন এবং সবাইকে সমান খাবার দিন। খাবার দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করুন, যাতে অতিথির গায়ে বা প্লেটের বাইরে খাবার না পড়ে। এছাড়াও বিনয়ের সাথে তার পছন্দের পদটি জেনে, সেটি বেশি দিতে পারেন।

•খাবার চিবোনোর নিয়ম—খাবার খাওয়ার সময় অনেকে শব্দ করে খায়, যা একদমই উচিত নয়। কারণ এতে করে পাশের ব্যক্তির খাবারের রুচিটাই হারিয়ে ফেলেন। আর খাবার টেবিলে সবার সাথে খাবার খেলে, শব্দ না করে খাওয়াটাই ভদ্রতার পরিচয়। হয়তো আপনি অনেক তৃপ্তি নিয়ে মনের আনন্দে শব্দ করে খাচ্ছেন, তবে অনেকেই এই শব্দ পছন্দ করেন না। এক্ষেত্রে শব্দ না করে খেতে মুখ বন্ধ রেখে খাবার খান। কারণ মুখ অনবরত খোলা ও বন্ধ রাখার জন্যই শব্দ হয়।

•হাঁচি-কাশি — স্বাভাবিক সময়ে অন্যের সামনে হাঁচি-কাশি দিলে মুখ ঢেকে দেওয়া উচিত। কারণ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নানা ধরনের রোগ ছড়াতে পারে। আর খাবার টেবিলে যদি খাবারের দিকে মুখ করে হাঁচি দেওয়া হয়, তা অত্যন্ত অভদ্রতা, সেই সাথে অস্বাস্থ্যকর। যদি খাবার টেবিলে বসার পর হাঁচি-কাশি আসে, তবে খাবারে দিকে না দিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁচি-কাশি দিন এবং অবশ্যই রুমাল বা টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে নেবেন৷

•ভরা মুখে কথা না বলা—পরিবারের সবাই সারাদিনের কর্মব্যস্ততা রেখে খাবার টেবিলেই মূলত একে অপরের সাথে আড্ডা দেয়। আর কোনো অনুষ্ঠান হলে সেখানেও আড্ডা জমে। সারা দিনের নানা গল্পই একে অপরের সাথে শেয়ার করে থাকেন৷ তবে, অনেকেই খাবার মুখে নিয়ে কথা বলে থাকেন, সেই কথা শুনতে অনেক বিশ্রী লাগে বটে৷ এছাড়াও কোনো অনুষ্ঠানে এমন করা হলে তাকে অভদ্রতা বলে এবং খাবার মুখে নিয়ে কথা বললে তা ছিটকে যাবার ভয় থাকে। এইজন্য কোনো কথা বলতে হলে মুখের খাবার শেষ করে কথা বলুন।

•ন্যাপকিনের ব্যবহার করা— খাবার টেবিলে ন্যাপকিন বা টিস্যু ব্যবহার করা অত্যন্ত ভদ্র কাজ। তবে, ন্যাপকিন কোলের ওপর বিছিয়ে নিতে হবে খাবার পূর্বে এবং খাওয়ার মধ্যে খাবার মুখে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ন্যাপকিন বা টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলতে হবে। কেননা, একজনের মুখে লেগে থাকা খাবার অন্য জনের অরুচির কারণ হতে পারে। এছাড়াও খাওয়ার মাঝে কোথাও গেলে ন্যাপকিন চেয়ারে ওপর রাখা উচিত। খাওয়া শেষে ময়লা টিস্যু বা ন্যাপকিন নিজ দায়িত্বে ডাস্টবিনে বা ওয়াশ করতে হবে।
•দাঁত-মুখ এবং হাত-পায়ের অবস্থান—অনেকেই আছেন চামচ দিয়ে খাবার তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হলে তখন হাতের আঙুল দিয়ে ঠেলে খাবার ওঠানো শুরু করে, যা অন্যদের সামনে নিজের ব্যক্তিত্বকে দুর্বল করে এবং সেই সাথে এটা একটা অভদ্রতাও বটে। এইজন্য এই বিষয়টি এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়াও কেউ কেউ খাবার দাঁতে আটকালে সবার সামনেই দাঁত খুঁচতে শুরু করে দেয়, এটি অত্যন্ত বিব্রতকর বিষয়। খাবার দাঁতে আটকাতেই পারে, তবে তা একটু আড়ালে গিয়ে বের করুন। এছাড়াও সবার সামনে ঢেঁকুর তোলা উচিতবনয়, এটিও বেশ আপত্তিকর আচরণ।
আর একসাথে বেশি খাবার মুখে না নিয়ে অল্প অল্প খাবার খান এবং হাড্ডি বা কাঁটা চামচ বা হাত দিয়ে ফেলুন, সরাসরি মুখ দিয়ে ফেলা বাজে অভ্যাস।

•অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ—খাবার টেবিলে প্লেট, বা বাটি নিতে গিয়ে অনেকেই শব্দ করে ফেলেন। এছাড়াও চুমুক দিয়ে খাও, হাত না ধুয়ে খেতে বসা, এসব বেশ অশোভনীয়। আবার অনেকে খাওয়া শেষে প্লেটে হাত ধউয়ে ফেলে আবার হাত ধোয়ার পর পরনের কাপড়ে মুছে ফেলে। এসব কাজ খাবার টেবিলে করা যাবে না।

•খাওয়া শেষে—খাবার টেবিলে সকল নিয়ম মানলেও খাওয়া শেষ হবার পর নির্দিষ্ট স্থানে অনেকেই হাত ধোয় না, আবার ধোয়ার পর তোয়ালে বা টিস্যু দিয়ে হাত মুছেও না। এসব একদম করা যাবে না এবং খাবার টেবিল থেকে ওঠার সময় পাশের জনকে বলে টেবিল থেকে ওঠুন। এতে করে বরং আপনার ভদ্রতা ফুটে ওঠবে।

•এবার চলুন ছুরি-চামচের ব্যবহার সম্পর্কে জানি—খাবার টেবিলে ছুরি,চামচভবা প্লেটের অবস্থানই নির্দেশ করে কে কতটা ওয়েল ম্যানার্ড। আর এইজন্য খাবার টেবিলে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য ছুরি চামচের ব্যবহার জানা অত্যন্ত জরুরি।
১| ছুরি-চামচ যদি প্লেটেএ মাঝে কোনোকুনি রাখা হয়, এর অর্থ হচ্ছে আপনি বিশ্রাম নিতে যাচ্ছেন।
২|ছুরি-চামচ প্লেটে যোগ চিহ্নের মতো করে রাখলে বোঝায় আপনার প্লেট খাওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং সেই অনুসারে পরিবেশক আপনাকে খাদ্য পরিবেশন করে।
৩| যদি আড়াআড়ি সমান্তরাল করে পাশাপাশি রাখা হয় তবে তার অর্থ আপনি খাওয়া খুবই পছন্দ করছেন।
৪|উল্লম্বভাবে সমান্তরাল করে বা পাশাপাশি লম্বালম্বি করে যদি ছুরি-চামচ প্লেটে রাখা হয় তবে বোঝায় খাওয়া শেষ। পরিবেশক আপনার প্লেটটি নিয়ে যেতে পারেন।
৫|ছুরি-চামচ একটির ভেতর অপরটি, মূলত কাঁটা চামচের ভেতর ছুরি গেঁথে কোণ তৈরি করে রাখার অর্থ আপনার খাওয়া শেষ, কিন্তু খাবার একেবারেই পছন্দ হয়নি।

আরো পড়ুন: ১৫০ টাকা কেজি দরে মুরগির মাংস বিক্রি, পরে জানা গেল মরা ব্রয়লার

এছাড়াও ছুরি-চামচ দিয়ে খাওয়ার বিশেষ নিয়ম আছে। কীভাবে কাটতে হয়, কীভাবে ধরতে হয়, ইত্যাদি। সেটা হলো—কন্টিনেন্টাল পদ্ধতিতে ডান হাতে থাকবে ছুরি আর বাম হাতে থাকবে কাঁটা চামচ এবং ডান হাতের ছুরি প্লেটের কাছে ধরে রাখতে হবে। আর বাম হাতের কাঁটা চামচ দিয়ে খাবার মুখে পুরে দিতে হবে। এ সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, কাঁটা চামচটি যেন প্লেটের দিকে ঘোরানোই থাকে। আমেরিকান পদ্ধতিতে অবশ্য বাম হাতের কাঁটা চামচ ডান হাতে নিয়ে খেতে হবে।

আর খাবার মধ্যে যদি বিরতি নেন তবে কন্টিনেন্টাল পদ্ধতিতে ছুরির ধারালো দিকটি প্লেটের দিকে মুখ করে রেখে যাবেন এবং কাঁটা চামচ উল্টিয়ে আড়াআড়িভাবে ছুরির উপরে রেখে যাবেন, যাতে ছুরি ও কাঁটা চামচ ক্রস আকৃতির হয়ে থাকে। এছাড়াও আমেরিকান পদ্ধতিতে চামচ আর ছুরির অবস্থান অবশ্য একটু আলাদা। এক্ষেত্রে চামচের কাঁটা অংশ (না উল্টিয়ে) উপরের দিকে মুখ করে আর ছুরির ধারালো প্রান্তটি নিজের দিকে মুখ করে রাখতে হবে। ছুরি আর চামচের অবস্থান হবে কোণাকৃতির।

খাওয়ার সময় বা খাবার টেবিলের উপরের বিষয়গুলো আপনার ব্যক্তিত্বকে করে তুলতে পারে রুচিসম্মত এবং মার্জিত। তাই আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো দাওয়াতে এসব আদব-কায়দাগুলো মাথায় রেখে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।