ফিচারবিখ্যাত ব্যক্তিশিক্ষা

কাদম্বিনী দেবী : বাংলার প্রথম নারী চিকিৎসক!

আজ থেকে ঠিক দেড়শ বছর আগের কথা চিন্তা করুন তো? ব্রিটিশ শাসনামলের সেই সময় বাংলার মেয়েরা ছিল চরম অবহেলিত। সেই সময়ে মেয়েদের স্কুলে যাওয়াকেই বাঁকা চোখে দেখত আমাদের সমাজ। তখনকার সময়ে সংসার সামলানোই ছিল বাংলার নারীদের একমাত্র কাজ। ভাবুন তো, সেই সময়ে যদি একজন নারী ডাক্তার হতে চেয়ে বসেন তাহলে ঠিক কী পরিস্থিতি তৈরি হবে? হ্যাঁ, বলছি কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। যিনি কাদম্বিনী দেবী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনিই এই বাংলা ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক। চলুন আজ জেনে নিই এই মহীয়সী নারীর জীবনের গল্প!

কাদম্বিনী দেবী

জন্ম ও পরিচয়: 

কাদম্বিনী দেবী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬১ সালের ১৮ জুলাই বিহারের ভাগলপুরে। তাদের মূল বাড়ি বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদশিতে। তার পিতার নাম ব্রজকিশোর বসু। ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন একজন ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক। তিনি নারী শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রগণ্য ও সচেতন হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ব্রজকিশোর বাবু উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি তার মেয়ে কাদম্বিনীকে ভাগলপুর থেকে কোলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন।

শিক্ষাজীবন: 

পিসতুতো দাদা মনমোহনের হাত ধরে কাদম্বিনীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। স্কুলজীবনে পড়াশোনা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ ছিল কাদম্বিনীর। স্কুলে পড়ার সময় ১৮৭৮ সালে প্রথম মহিলা হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। মাত্র এক নম্বরের জন্যে তিনি প্রথম বিভাগ পাননি। তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেথুন কলেজ প্রথম এফ এ এবং অন্যান্য স্নাতক শ্রেণি আরম্ভ করে। কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজের প্রথম গ্র‍্যাজুয়েট হয়েছিলেন ১৮৮৩ সালে। তারা ছিলেন সে সময়কার অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা গ্র‍্যাজুয়েট। সে সময় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই দুই নারীর ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এতটাই ভীড় জমে গিয়েছিল যে সেই ভিড় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ট্রামলাইন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন# হুমায়ূন আহমেদ : বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র

গ্র‍্যাজুয়েট হওয়ার পর কাদম্বিনী সিদ্ধান্ত নেন তিনি ডাক্তারি পড়বেন। কিন্তু সেসময় তিনি অনেক বাঁধার সম্মুখীন হন। তখন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি মেনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও নারীদের ভর্তি করতো না। কিন্তু কাদম্বিনী দেবী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রমাণ করেন যে বিশ্ববিলয়ের আইনে নারীরা ভর্তি হতে পারবেন না এমন কোন নিয়ম নেই। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভর্তি করতে বাধ্য হয়।

মেডিকেল কলেজে প্রবেশের পরপরই তিনি তার শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেন। দ্বারকানাথ বিখ্যাত সমাজসংস্কারক ও মানবদরদী সাংবাদিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। যখন তিনি বিয়ে করে তখন ৩৯ বছর বয়েসের বিপত্নীক, কাদম্বিনীর বয়স তখন ছিল একুশ।

দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ও কাদম্বিনী দেবী
দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ও কাদম্বিনী দেবী

মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর অনেক বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হন কাদম্বিনী দেবী। শিক্ষক ও সহপাঠীদের দ্বারা তিনি নিগৃহীত হন। তাকে নানানভাবে সবাই উপহাস করতে থাকে। কাদম্বিনী ফাইন্যাল পরীক্ষায় সমস্ত লিখিত বিষয়ে পাস করলেও প্র্যাকটিক্যালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অকৃতকার্য হন। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে জিবিএমসি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি দেওয়া ডাহয়। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসারীতিতে চিকিৎসা করার অনুমতি পান। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন তিনি সরকারের স্কলারশিপ পান যা ছিল মাসে ২০ টাকা। তিনি পাঁচ বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করার পর বিলেত যাবার আগে ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কিছুদিন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করেছিলেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রাজমাতার চিকিৎসার্থে নেপাল যান। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বাই শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছয় জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন কাদম্বিনী ছিলেন তাদের অন্যতম একজন। পরের বছর তিনি কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। কাদম্বিনী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। কাদম্বিনী গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রানসভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি এবং ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য ছিলেন।

সমাজ সংস্কারক কাদম্বিনী দেবী:

১৯১৪ সালে তিনি কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই অধিবেশন মহাত্মা গান্ধীর সম্মানের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। কাদম্বিনী চা বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং তিনি তার স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন যিনি আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির নিন্দা করেছিলেন। কবি কামিনী রায়ের সাথে কাদম্বিনী দেবী ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বিহার এবং ওড়িশার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি নারী শিক্ষায় ও নারীদের স্কুলমুখী করতে আজীবন অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন।

সাংসারিক জীবনে কাদম্বিনী দেবী:

আট সন্তানের মা হওয়ার কারণে সংসারের জন্যও তাকে বেশ সময় দিতে হতো। তিনি সূচিশিল্পেও নিপুণা ছিলেন। বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড লিখেছেন, “গাঙ্গুলির স্ত্রী কাদম্বিনী ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে সফল এবং স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। সকল বাধার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে নিজেকে জানার তার এই ক্ষমতা তাঁকে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা জনগোষ্ঠীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করে।

কাদম্বিনী দেবী'র বাড়ি
কাদম্বিনী দেবী’র বাড়ি

ডাক্তারিতে বাঁধা:

তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ মহিলা হিসেবে তার ডাক্তারী পড়া নিয়ে এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা তাকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করে। যাতে দেখানো হয়েছিল কাদম্বিনী তার স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে নাকে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তার নিচে লেখা ছিল কাদম্বিনীকে নিয়ে অনেক কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ চন্দ্র পালের এই অসভ্যতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেননি কাদম্বিনী ও তার স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তারা আদালতে অভিযোগ জানান। তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন ডাক্তার নীলরতন সরকার ও শিবনাথ শাস্ত্রীর  মতো মানুষরা। বিচারে মহেশ চন্দ্র পালের ছয় মাসের জেল হয়। তাকে ১০০ টাকা জরিমানাও দিতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন# শিনজো আবের বর্ণাঢ্য জীবন: উত্থান, বিতর্ক ও মৃত্যু

শুধু তাই নয়, তার শিক্ষকরাও তার প্রচন্ড বিরোধিতা করেছিলেন। তারা কাদম্বিনীর উপর এতই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, মেটেরিয়া মেডিকা ও তুলনামূলক শরীরবিদ্যা এই দু’টি বিষয়ে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ তার এমবি পরীক্ষায় পাস করা হয়নি। তাকে জিএমসিবি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। সে সময় তার প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

মৃত্যু: 

১৯২৩ সালের ৩রা অক্টোবর একটি অপারেশন শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন কাদম্বিনী দেবী। এমন সময় হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। এর মাধ্যমে নিভে যায় এক মহীয়সী নারীর জীবন।

শেষ কথা: 

বর্তমানে মেয়েরা পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে গেছে। তারা এখন অহরহ গ্রাজুয়েট হচ্ছে ডাক্তার হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে এমনকি কল্পনা চাওলার মতো মানুষ মহাশূন্যেও পাড়ি জমিয়েছে। তবুও এই কাদম্বিনী দেবীর কথা মানুষ আজীবন স্মরণ রাখবে। কারণ তার হাত ধরে এই উপমহাদেশে প্রোথিত হয়েছিল নারীদের উচ্চ শিক্ষার প্রথম বীজ!

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।