ঐতিহ্যফিচারবিখ্যাত জায়গালোকসংস্কৃতি

গোরু-ছাগলের হাট : আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে!

লোকায়ত বাংলায় হাটের প্রচলন বেশ আগে থেকেই। হাট বলতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের স্থান। হাট বিভিন্ন প্রকার ও ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- দৈনন্দিন হাট, সবজির হাট, পানের হাট, ফলের হাট, গোরু-ছাগলের হাট প্রভৃতি। সাপ্তাহিক হাটগুলো সপ্তাহে ২-৩ দিন বসে আর নির্দিষ্ট পণ্যের হাট নির্দিষ্ট সময় পর পর বসে। তেমনি কোরবানির ইদ আসলে প্রতিটি এলাকায় বিশাল গোরু-ছাগলের হাট বসে। এই হাট বাঙালির কাছে বেশ জনপ্রিয়। এই হাটকে কেন্দ্র করেই চলে গোরু-ছাগল বিকিকিনির বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রতি সপ্তাহে একদিন বা মাসে বা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ কোরবানির ইদের আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জমজমাট গোরু-ছাগলের হাট বসে। যা বাংলার ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে।

ঐতিহ্যবাহী গোরু-ছাগলের হাট সমূহ:

খামারিরা প্রতি বছর অপেক্ষা করে থাকে কোরবানির ইদের জন্য। কারণ বছরের এই সময়টায় তারা গোরু-ছাগল কেনাবেচা করে থাকে। আর কোরবানির ইদ উপলক্ষ্য তারা গোরু-ছাগলকে সুন্দর করে সাজিয়ে হাটে নিয়ে যায়। গরুর আকার-আকৃতি, ওজন, উচ্চতা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে দাম নির্ধারণ করা হয়। যে গোরু যত ভালো তার দামও তত বেশি। সবচেয়ে বড়ো গোরু থাকে হাটের মূল আকর্ষণ। একটু চড়া দামেই এবং বহু দরদাম করেই হাটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গোরুটি বিক্রি করা হয়। আবার কোরবানির ইদকে কেন্দ্র করে সেই গোরু কিনতে পারায় খুশি হন ক্রেতা। মূলত সামর্থবান ও প্রভাবশালী ক্রেতারাই তা কিনে থাকেন। আর শুধুমাত্র ইদ উপলক্ষ্যে এসব গোরু আনা হয়।  বাংলায় দীর্ঘকাল ধরেই পশুর হাট প্রচলিত যা লোকায়ত মানুষ ও ঐতিহ্যের সাথে জুড়ে আছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বাংলার ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা বেশকিছু ঐতিহ্যবাহী গোরু-ছাগলের হাট সম্পর্কে:

মুক্তাগাছার গোরুর হাট:

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার পৌর এলাকার নতুন বাজারে বসে বিশাল গোরু-ছাগলের হাট বাজার। এই হাট শতশত বছরের পুরাতন একটি পশুর হাট। এই হাটটি জমিদার আমল থেকেই কালের ধারাবাহিকতায় চলে আসছে৷ ঐতিহ্যবাহী হাট হিসবে এটি সকলের কাছে সুপরিচিত। এই অঞ্চলের মানুষজন বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন- কোরবানির ইদ, খাতনা, আকিকা, ইদ-উল-ফিতর, বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এই হাট থেকে পশু ক্রয় করে থাকে। এই হাটে খামারি-ব্যবসায়ী-দালালরা অনেক গোরু আনে বিক্রির উদ্দেশ্যে। এখানে বিভিন্ন দামের গোরু ও ছাগল পাওয়া যায়। ৪০ হাজার থেকে শুরু করে তিন-সাড়ে তিন লক্ষ টাকার গোরুও এখানে পাওয়া যায়। আর ১০-২৫ হাজার টাকায় ছাগল পাওয়া যায়। কোরবানির ইদ উপলক্ষ্যে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় কোরবানির পশুর হাট বেশ জমে ওঠে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে গোরুকে সাজানো হয় যাতে গোরুকে দেখতে সুন্দর লাগে।

ঐতিহ্যবাহী পাঁচবিবির গোরুর হাট:

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ প্রচীন আমলের গোরুর হাট অবস্থিত জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি প্রাণ কেন্দ্রে। ঐতিহ্যবাহী এই হাটে সপ্তাহে মঙ্গলবার  গরু, মহিষ, ঘোড়া ও ছাগল কেনাবেচা হয়ে থাকে। ১৮১৯ সালে ব্যবসায়ীদের পানির জন্য ইংরেজরা হাটের মধ্যে একটা ইন্দ্রা বা পাতকুপ নির্মাণ করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওই ইন্দ্রায় পাকিস্থানি বাহিনী অনেক বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে কুপে ফেলে দিত। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে ময়লা-আর্বজনা ও মাটি দিয়ে কুপটি ভরাট করা হয়। ব্রিটিশ আমলেরও আগে থেকে এ হাটের যাত্রা শুরু হয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে খামারি ও পশু ব্যবসায়ীরা আসে এসব গবাদি পশু ক্রয়-বিক্রয় করতে। কোটি কোটি টাকার বেচাকেনা হয় এই হাটে। তবে হাটের জায়গা তুলনামুলকভাবে কম। হাটের পরিবেশ ভালো নয়, প্রায় স্থানেই ময়লা-আবর্জনার স্তপ রয়েছে। জাগয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ রয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিমত সরকার প্রতিবছর এ হাট থেকে অনেক টাকা রাজস্ব পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও জায়গা বৃদ্ধি করে না। হাটের জয়গা বাড়লে সবার জন্য ভালো হয়।

ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে গরু-ছাগলের হাট
কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে গোরুকে সাজানো

ঐতিহ্যবাহী বাড়াদি ছাগলের হাট:

মেহেরপুরের বাড়াদি বাজার সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী ছাগলের হাট বসে বছরজুড়ে। মেহেরপুর জেলায় পশুর হাট হিসাবে সর্বপ্রথম বাড়াদি ছাগলের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী এই হাটের বয়স শত বছর পেরিয়ে গেছে। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার ছাগলের হাট বসে। মূলত বাড়াদি ছাগল হাটের পর জেলায় মেহেরপুর, গাংনী ও বামুন্দিতে গরু-ছাগলের হাট হলেও এতদিন বাড়াদি ছাগল হাটের আবেদন একবিন্দুও কমেনি। সারা বছরজুড়েই সপ্তাহের শনি ও বুধবার ক্রেতা বিক্রেতায় জমজমাট থাকে হাটটি। মেহেরপুরের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের চাহিদা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের কাছে সবচেয়ে বেশি থাকে। আর এর চামড়ার খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। প্রতি বছর কোরবানির ঈদের সময়ে জেলার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল কিনতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, ফরিদপুর, রাজবাড়ি থেকে এসে ব্যাপারীরা ভীড় করে। তারা ট্রাক বোঝায় করে কিনে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন দেশের বিভিন্ন জেলা ও শহরে। মেহেরপুরের এই হাটে সব ধরনের খাসি পাওয়া যায়। খাসির উপর ভিত্তি করে দামের তারতম্য হয়ে থাকে। সাধারণত খাসির দাম ৭-৮ হাজার টাকা আবার ৪৫-৫০ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।

তালগাছির পশুর হাট:

১০০ বছরের প্রাচীন সিরাজগঞ্জের তালগাছির হাটের কথা বলার সময় সবাই-ই একে ‘উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ পশুর হাট’ বলে পরিচিতি দিয়ে থাকে। হাটটি জমিদার ঠাকুরদের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হতো। ১৯২০-এর দশকের দিকে উপজেলার প্রখ্যাত সমাজসেবী মরহুম আবু ইসহাক মিয়া হাটটির ইজারা নেন। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তালগাছিতে পশুর হাটে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে গরু, ছাগল, ভেড়া আসতে দেখা যায়। প্রতি সপ্তাহের রবিবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে এই হাট শুরু হয়। সকাল দশটা-এগারোটা থেকে পুরো হাট জমজমাট। আবার দুপুর দুইটার পর থেকে হাট ভাঙা যাওয়া শুরু হয়। বিকাল পাঁচটা-ছয়টার মধ্যে সম্পূর্ণ হাট ভেঙে যায়। হাটে বিভিন্ন সাইজের গরু, ছাগল, ভেড়া পাওয়া যায়। একটু লাভের আশায় মূলত গ্রামের প্রান্তিক চাষী ও খামারিরা বাছুর কিনে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে হাটে বিক্রি করতে আসে। আবার অনেক সময় খামারিদের বাড়ি থেকে ব্যাপারীরা গবাদিপশু কিনে নিয়ে যায়। তাারপর ছোট ব্যাপারীদের কাছ থেকে সেগুলো বড়ো ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যায়। হাটে বড়ো ব্যাপারীদের প্রত্যেকের নিজস্ব গরু বাঁধার জায়গা নির্দিষ্ট করা থাকে। সেই জায়গাগুলোকে বলা হয় ‘ডোগা’। বাঁশের খুঁটি পুঁতে বাঁশের ফালি চওড়াভাবে বেঁধে একেকটি ডোগা তৈরি করা হয়ে থাকে। শুধু শাহজাদপুর উপজেলা নয় আশে পাশের বগুড়া, নাটোর, পাবনা ও টাঙ্গাইল জেলাসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে এই হাটে আসে। হাটে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী ও দামের গরু-ছাগল আমদানি হয়ে থাকে। তালগাছির হাটে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়ে থাকে গরু এরপর ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও ঘোড়া। আবার গরুর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দুধেল ও গাভীন বা গর্ভবতী গরুর দাম বেশি হয়ে থাকে। এই হাটে খামার করার জন্য বা লালন-পালনের উদ্দেশ্যে গোরু কিনতে আসা ক্রেতার সংখ্যাই অধিক। খামারিদের প্রথম পছন্দ পছন্দ হলো ফ্রিজিয়ান জাতের গরু তারপর জার্সি, ক্রস বা হাইব্রিড, সবশেষে শাহীওয়াল। দেশি গরু আকারে ছোট হয়ে থাকে এবং কম দুধ দেয় বলে খামারিরা দেশি গরু কিনতে খুব একটা উৎসাহী নয়।

মূলত হাটের গবাদিপশুর একটা বড়ো অংশ কিনে নিয়ে যায় কসাইরা। তারা গবাদি পশুর দাম দেয় মাংসের দাম হিসাব করে। প্রতি কেজি গোরুর মাংসের দাম দেওয়া হয়ে থাকে ৫০০-৫৫০ টাকা। ছাগলের মাংসের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৭০০-৮০০ টাকা। হাটে কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্য সকল গোরু-ছাগলকে বিভিন্নভাবে সাজ সজ্জা করিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে গরু-ছাগলের মালিকেরা। হাটে গরু-ছাগলের ব্যাপক আমদানি লক্ষ্য করা হয়। দামও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়।

ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে গরু-ছাগলের হাট
সাপ্তাহিক গোরু-ছাগলের হাট

কাহারোলের ঐতিহ্যবাহী পশুর হাট:

উত্তরবঙ্গের সর্ব বৃহৎ দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলা চত্বরে পশুর হাট বসে। প্রতি সপ্তাহের শনিবার ঐতিহ্যবাহী এই পশুর হাট বসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খামারি, ব্যাপারী ও ব্যবসায়ীরা আসে এই পশুর হাটে পশু ক্রয়-বিক্রয় করার জন্য। সকাল ১১ টা থেকে এই হাট শুরু হয়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত পশু বেচাকেনা পুরোদমে জমজমাট হয়ে থাকে। তবে বিকাল ৩ টার পর থেকে গরুর হাট আস্তে আস্তে ভেঙ্গে যেতে শুরু করে আর বিকাল ৫ টার মধ্যেই পশুর হাট একেবারে পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। কাহারোল পশুর হাট ঐতিহ্যবাহী ও এর ব্যাপক সুনাম রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরুর ব্যাপারীরা এখানে গরু, মহিষ, ছাগল ক্রয় করতে আসেন। আশপাশের জেলা থেকে বিক্রেতারা গোরু বিক্রি করতে আসে এই হাটে। তবে কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে অধিক মানুষের আনাগোনা হয় আবার বেচাকেনা বেড়ে যায়। কোরবানির ঈদকে ঘিরে এখানকার পশুর হাট জমজমাট হয়ে উঠে। কোরবানির পশুর ক্রয় বিক্রয় উপলক্ষ্যে দিনাজপুর জেলার ১৩টি উপজেলাসহ রংপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও জেলা ও এর উপজেলার অর্ধলক্ষ মানুষের জামায়েত হয় এই হাটে।

ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে গরু-ছাগলের হাট
কোরবানির ঈদের গোরুর হাট

আরও পড়ুন:

বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের চিত্রকথা!

ধামরাইয়ের রথযাত্রা: বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকউৎসব

কুষ্টিয়ার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী তিলের খাজা

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে হাট মিশে আছে। পশুর হাটও বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। দীর্ঘদিনের পুরাতন হাটকে ঘিরে ঐতিহ্যের সম্পৃক্ততা থাকে। বছরে সব সময় গোরু-ছাগলের হাট বসলেও কোরবানির ইদকে ঘিরে প্রতিটি স্থানেই পশুর হাট আরও জমজমাট হয়ে ওঠে। হাটকে কেন্দ্র করে আশেপাশের এলাকায় উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিক্রির জন্য গোরুকে সাজিয়ে আনা হয় ও বিশাল হাঁকডাকিয়ে গোরু বিক্রি হয়। এভাবে চলে আসছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী গোরু-ছাগলের হাট।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।