ছনের ঘর: হারিয়ে যাচ্ছে এক শীতল ঐতিহ্য!
![ছনের ঘর: হারিয়ে যাচ্ছে এক শীতল ঐতিহ্য!](https://anolipi.com/wp-content/uploads/2022/07/ছনের-ঘর-হারিয়ে-যাচ্ছে-এক-শীতল-ঐতিহ্য-780x470.jpg)
একসময় গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন এলাকায় ঘরের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয় ছিল। যা ছিল বাংলার ঐতিহ্যের নিদর্শন। মাটির ঘর, টালির ঘর, ছনের ঘর প্রভৃতি৷ পরবর্তীতে এসেছে টিনের ঘর, কাঠের ঘর, আধা-পাকা ঘর, পাকা ঘর, দালান ঘর। কিন্তু ছনের ঘরের বেশ কদর ছিল একসময়। নিম্নবিত্তদের জন্য ছনের ঘর সাশ্রয়ীও বটে। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যের নিদর্শন হলো ছনের ঘর। একসময় বাংলার গ্রামীণ এলাকার গরিব-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল এই ছনের ঘর। সেসময় বাড়ির ঘরের ছাউনির একমাত্র অবলম্বন ছিল এই ছন। মাটি কিংবা বেড়ার ঘরের ছাউনি হিসেবে ছন ব্যবহৃত হতো সেসময়। তবে কালের আবর্তনে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। আবহমানকালের গ্রামীণ সমাজের এই চিরচেনা ঐতিহ্যের চিহ্নটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
ছন:
গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা এক প্রকার ঘাস জাতীয় উদ্ভিদই হলো ছন। এই ছনের পাতা বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। কোনোটা খাটো আবার কোনোটা আড়াআড়ি লম্বা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ছন খুবই একটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় ও পরিচিত বনজ উদ্ভিদ এবং ছন একটি অর্থকরী ফসলও বটে। সাধারণত ছন অনাবৃত পাহাড়ে জন্মে থাকে। ছনকে তাই পাহাড়ি অঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। তবে গুচ্ছভাবে পুকুর বা দিঘীর পাড়ে ছন দেখতে পাওয়া যায় অনেক স্থানেই। বীজ ও মূলের মাধ্যমে ছন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত নতুন নতুন পরিবেশে ছনের বীজ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বংশ বিস্তার করে থাকে। সুতরাং ছনে একবার ফলনই যথেষ্ট। একবার ফলনের সাহায্যে ঘাস মূলের মাধ্যমে দ্রুত বংশ বিস্তার করে থাকে। আশ্বিন থেকে চৈত্রমাস পর্যন্ত বছরের এই সময়টাতে ছন আহরণ করা হয়। ছনের চাষাবাদে তেমন কোনো পরিশ্রম নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র পাহাড়ের যে অংশে ছন চাষের জন্য নির্ধারণ করা হয় তা পরিষ্কার করতে হয়। প্রাকৃতিকভাবেই কিছুদিন পর ছনের কুঁড়ি জন্মায় এবং প্রাকৃতিকভাবেই তার প্রসার ঘটে। প্রায় দেড় থেকে দুই হাত লম্বা হলে ছনের সকল আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। একবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব হয়। অন্যদিকে ছনের বৃদ্ধিতে বড় কোনো গাছের ছায়া ও পাতা যেমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তেমনি ছনে পচন ধরে নষ্ট হয়। এর ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। তাই সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রায় ৬ থেকে ৭ ফুট লম্বা হলে ছন তার পূর্ণতা পায় এবং তা কাটার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। ছন কেটে ১৫ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ রোদে শুকিয়ে নিতে হয় এসময়ে। ছন উপযোগী করার জন্য সবুজ রং থেকে ঝনঝনে বাদামি রং ধারণ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
![ছনের ঘর: হারিয়ে যাচ্ছে এক শীতল ঐতিহ্য!](https://anolipi.com/wp-content/uploads/2022/07/ছনের-ঘর-হারিয়ে-যাচ্ছে-এক-শীতল-ঐতিহ্য-1.jpg)
তৎকালীন লোকসমাজে ছনের ঘর:
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে বাসস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই মৌলিক উপাদান এমন একটি উপাদান যা মানুষের আশ্রয়কে নির্দেশ করে। মানুষ চায় কাঁচা হোক, আর পাকা হোক, নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করতে। কারণ সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে একটা সময় মানুষ তার আপন ঠিকানায় ফেরে। মানুষের ঘরটা কেমন হবে, তা নির্ভর করে তার আয়-সঙ্গতির ওপর, এ বিষয়টি আগেও ছিল এখনও আছে। তৎকলীন সময়ে গ্রামীণ সমাজের মানুষের সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। একসময় বোয়ালমারী, সাতৈর, বনমালীপুর, সহস্রাইল, রুপাপাত, আলফাডাঙ্গা, বানা, গোপালপুর, জাটিগ্রাম, সালথা, ময়েনদিয়া, নগরকান্দা, চরভদ্রাসন, সদরপুর, মধুখালী, কামারখালী, বাগাট বাজারে ছন বিক্রির জন্য আনা হতো। আবার সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলেও ছনের আধিক্য ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছন সরবারাহ করা হতো। বাঁশের তরজা অথবা ইকর দিয়ে বেড়া দেওয়া ছনের ঘরই ছিল তাদের আপন ঠিকানা। তাই দেখা যেত ইকর বা বাঁশের তরজা দিয়ে তৈরি গ্রামের বেশির ভাগ দু-চালা ছনের ঘর নির্মাণ করা হতো। আবার কখনো কখনো মাটি দিয়ে তৈরি ছন দিয়ে ছাওয়া ঘরও নির্মাণ করা হতো। ঘরের দেয়াল তৈরি করা হতো মাটিকে বিশেষ কায়দায় কাদা করে। মাসখানেক সময় লেগে যেতো মাটির দেয়াল দিয়ে একটি ঘর তৈরি করতে। তবে তা ছিল একেবারেই সামান্য কারণ খরচের পাল্লা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি হতো বিধায় বেশির ভাগ মানুষের তা তৈরি করা সাধ্যের মধ্যে ছিলো না। মাটির ঘরের জন্য বৃষ্টির জমাটবদ্ধ পানি ছিল বিরাট হুমকিস্বরূপ। বর্ষা ও বন্যার সময় জমাটবদ্ধ পানিতে অনেক মাটির ঘর ভেঙে পড়তো বিধায় মাটির ঘর তৈরির আগ্রহ মানুষের তেমন ছিল না। কিন্তু ছনের ঘর সাশ্রয়ী হবার কারণে এ ঘর নির্মাণে মানুষের আগ্রহ ছিল। গ্রাম্য অনাবাদি পতিত জমি ও পাহাড়ি এলাকায় ছন কাটা উৎসব চলতো। ছন কেটে ধানের মতো মেলে দিয়ে কিছুদিন শুকানো হতো। এরপর হাটে নিয়ে যাওয়া হতো তা বিক্রির জন্য ভার বেঁধে।
আজ থেকে প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর আগেও গ্রাম বা শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছনের ছাউনির ঘরের প্রচলন ছিল। প্রচুর পরিমাণে ছন ব্যবহার করা হতো ঘরের ছাউনি ও পানের বরজের কাজে প্রচুর পরিমাণে ছন ব্যবহার করা হতো। নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ এই ছন দিয়ে ঘরের ছাউনি দিতো। ছন বিক্রি করে কাঠুরিয়ারদের সংসার চলতো। এই ছনের ছাউনির ঘর ঠান্ডা বিধায় উচ্চবিত্তরাও শখের বসে পাকা ঘরের চিলে কোটায় ছন ব্যবহার করতো। ছনের ছাউনির ঘর শীত ও গরম উভয় মওসুমে আরামদায়ক। ছনের ছাউনি ঘর তৈরির জন্য বেশ কিছু কারিগর ছিল যাদের কাজ ছিল ছনের ঘর নির্মাণ করা এবং তাদের মজুরি ছিল ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। চাষীরা প্রতি বোঝা ছন মাত্র ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করতো। তবে বর্ষা মৌসুমে ছনের চাহিদা বেশি থাকায় তখন প্রতি বোঝা ছন ১৪০-১৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হতো। বাংলা বর্ষের আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ছন আহরণ করার সময়। দামে তুলনামূলক কম হবার কারণে তৎকালীন এসময়ে ছনের ঘরের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ তৈরী হয়েছিল।
#আরও পড়ুন: মঙ্গলপুর: জন-মানবশূন্য এক গ্রামের গল্পকথা!
ঘর নির্মাণ:
একসময় ফাল্গুন-চৈত্রমাসে গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘরের ছাউনি হিসেবে ছনের ব্যবহারে ধুম পড়ে যেতো। ছনের ঘর নির্মাণের জন্য বিশেষ কায়দায় ছনকে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে ছাউনি দেয়া হতো। ছাউনির উপরে বাঁশ ও বেত দিয়ে শক্ত করে বেঁধে পানি ছিটানো হতো যাতে করে সহজে ছনগুলো বাঁশের উপর বসে যায়।
তৎকালীন সময়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের ঘরের ছানি বা চাল হিসেবে ছন ব্যবহৃত হতো। তাই ঘরের মূল অবকাঠামো অর্থাৎ বেড়া তৈরি হতো এক প্রকার বনজ উদ্ভিদ ‘ইকর’ বা এক প্রকার বাঁশকে খণ্ড খণ্ড করে জালিফলা করে তরজার মাধ্যমে। ঘরের চাল তৈরি করতে ব্যবহার করা হতো ছোট ছোট মুলিবাঁশ। মুলিবাঁশকে বিশেষ কায়দায় বাঁশের বেত অথবা জালিবেত দিয়ে শক্ত করে একে অপরটির সাথে বেঁধে দেয়া হতো। চালের ওপর বিশেষ কায়দায় ছনকে সাজিয়ে দিয়ে কয়েকটি ধাপে ছনগুলোকে বিন্যাস করে তার ওপরে বাঁশ দিয়ে বেতের মাধ্যমে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হতো। তখন স্থানীয় ভাষায় এটিকে ছাউনি বলা হতো। পরবর্তীতে এই ছাউনিকে লাঠিপেটা করা হতো এবং তার ওপর বেশি করে পানি ঢালা হতো যাতে ছনগুলো এলোমেলো না থেকে সোজা হয়ে বাঁশের ওপর ভালো করে বসে যেতে পারে ও ছাউনির কোন ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঘরের ভিতরে পানি প্রবেশ করে কি না সেটিও দেখা যায়। এভাবেই অন্তত প্রতি দু-এক বছর পর চাল ছাওয়া হতো। সে সময়কালে গ্রামবাংলার গৃহনির্মাণ রীতি খুবই সরল ছিল। সামনে ও পিছনে বারান্দা রেখে দুই কক্ষবিশিষ্ট দু’চালা ঘরেরই বেশি প্রচলন ছিল এসময়ে। আবার আলাদা করে রান্নাঘর রাখলেও মূল ঘরের সাথে এর সংযোগ থাকতো যেটিও ছনের দ্বারা নির্মিত।
সচ্ছল ব্যক্তিরা দিনমজুরকে দিয়েই ছাউনি বাঁধার কাজ সারতেন। আর সাধারণ মানুষের বেলায় সম্পূর্ণ এক আলাদা রীতি ছিল। কারো বাড়িতে চালা তৈরির সময় সমস্ত গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দেবার প্রচলন ছিল। লোকেরা দাওয়াত সানন্দে গ্রহণ করতো এবং চালা তৈরির কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য গ্রামের যুবক প্রৌঢ় এমনকি বৃদ্ধরাও তার বাড়িতে ভিড় করতেন। কাজের ফাঁকে কোরাসকণ্ঠের গান তার সাথে হাসি-তামাশা, হৈ-হুল্লোড়সহ এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতো। সকলে হেসে খেলে লোকেরা নিজ দায়িত্বে যৌথশ্রমে এবং বিনা পারিশ্রমিকে নিমিষেই ছাউনি তৈরির কাজ শেষ করতেন। গৃহকর্তার সাধ্য মতো খাবারের আয়োজন করা হতো ও তারপর শুরু হতো ভোজনপর্ব। ডাল, সবজি, বড় লাল মোরগের আয়োজনের মধ্যদিয়ে দুপুরের আহারের ব্যবস্থা করতেন গৃহকর্তা, এর সাথে ছিল পান-সুপারি আর তামাক। শ্রমের মূল্য সেসময় মূখ্য বিষয় ছিল না। এখানে টাকা-পয়সার কোনো বিষয় ছিল না। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আর সামাজিক সম্প্রীতি ছিল সবচেয়ে বড়। এ থেকেই বোঝা যায়, তৎকালীন গ্রামীণ বাংলার সম্প্রীতির বিষয়টি।
ঠান্ডা-গরমে কার্যকরী পরিবেশবান্ধব ছনের ঘর:
ছনের ঘর অত্যন্ত কার্যকরী কারণ অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরমে এটি আরামদায়ক। ছনের ঘর শুধু ঘরের ভেতরের তাপমাত্রাই নিয়ন্ত্রণ করে না এটি অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব। খর-তাপে ছনের ঘর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবার শীতকালে অত্যন্ত ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তাই এটিকে গরিবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলা যায়। একসময় অনেক ধনাঢ্য পরিবার গ্রীষ্মের দবদাহ ও খরতাপ থেকে রক্ষা পেতে এবং চৈত্রের দুপুরে বিশ্রামের জন্য ছনের তৈরি কাচারিঘরে আরাম-আয়েশ করতেন। কিন্তু গ্রামের হতদরিদ্র, দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রধান ঘর হিসেবেই ছনের ঘর ব্যবহার করতো। ছনের তৈরি ঘরে বাস করলে অত্যন্ত গরম থেকে যেমন রক্ষা পাওয়া যায় ঠিক তেমনি প্রচণ্ড শীতেও কনকনে ঠান্ডার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
#আরও পড়ুন: নকশি পাখা: সুতোয় গাঁথা স্বপ্ন যেন!
যে কারণে হারিয়ে যাচ্ছে ছনের ঘর:
কয়েক বছর আগেও ঘরের ছাউনিতে ছনের ব্যবহার করা হতো গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায়। গরীবের ছাউনির সেই ছনের ঘর কালক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে। আধুনিক সভ্যতায় ছনের তৈরি ঘর বিলুপ্তির পথে কারণ মানুষ এখন ছনের ঘরের পরিবর্তে টিনের তৈরি ঘর, পাকা ঘর, আধাপাকা ঘর, দালান বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। ঢেউটিন কম দামে ও সুলভমূল্যে পাওয়া যায় বলে শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই দিন দিন টিনের ঘর বাড়ছে। সম্পূর্ণ টিনের বাড়ি, আধা-পাকা বাড়িতে টিনের দোচালা ছাউনি, একচালা ছাউনিতে ছনের পরিবর্তে এসেছে টিনের ব্যবহার। আবার সামর্থ্য থাকলে অনেকে ছাদ দিয়ে নির্মাণ করেন পাকা বাড়ি, তলাবিশিষ্ট দালান বাড়ি। আধুনিকাতার উৎকর্ষতায় ছনের দেওয়ালের পরিবর্তে এসেছে ইটের দেওয়ালের ব্যবহার।
প্রতিবছর বা এক-দুই বছর পরপর ছনের ঘরের ছন পরিবর্তন করতে হয়। ফলে এটাকে অনেকেই ঝামেলা মনে করেন ফলে ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করছে টিনকে। অধিক ফসলের প্রয়োজনে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও জলবায়ু পরিবর্তনে কমে গেছে ছন চাষ। পাহাড়ে বড় গাছের কারণে ছনের বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় ফলে উৎপাদনও হ্রাস পায়। এখন গ্রাম ও শহরের মানুষ জ্বালানি হিসেবে এবং গরু-মহিষের খাদ্য হিসাবে ছন ব্যবহার করে। আবার ছন থেকে উন্নতমানের সুতা ও দড়ি উৎপন্ন হলেও এবং একসময় শহরেও ছন বিক্রি করতে দেখা গেলেও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ছনের ব্যবহার। সেখানে জায়গা করেছে ঢেউটিন, ইট, পাথর, রড, কংক্রিট।
টিন, ইটের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও অধিকাংশ ইট পোড়ানো ও টিন পরিবেশবান্ধব নয়। ছনের ছাউনির ঘর পরিবেশবান্ধব হলেও তা এখন বিলুপ্তির পথে। ঢেউটিনে ঘর অত্যাধিক গরম হয় এবং পরিবেশবান্ধব নয় জেনেও মানুষ টিনের ঘর নির্মাণ করছে কারণ টিনের ঘর বা চালা বারবার মেরামত করতে হয় না। প্রতিবছর ছন ক্রয় ও চাল মেরামতে শ্রমিকের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তাতে দুই বছর পর ঘরে টিন লাগানো যায়। যা টিনের ব্যবহার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাই এসব কারণেই মানুষ ছনের ঘর নির্মাণে মানুষের আগ্রহ কমছে।
নগরায়নে ছনের অন্যরকম ব্যবহার:
এখন আর ছনের ঘর নির্মাণ করা হয় না। তবে আধুনিক নগরায়নে ছনের ব্যবহারে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ছনের ব্যবহার হচ্ছে তাই ভিন্ন আঙ্গিকে। ইদানীং শহুরে যান্ত্রিক মানুষগুলো হাঁপিয়ে উঠেছে নগরায়নের অত্যাচারে। সবাই চায় যান্ত্রিকতা থেকে একটু আলাদাভাবে পরিবার-পরিজন বা প্রিয়জনকে নিয়ে সময় কাটাতে। সৌখিন মানুষ তাই সৌখিনতার অংশ হিসেবে কৃত্রিমতাকে পছন্দ না করে নির্জনতা আর প্রাকৃতিক সান্নিধ্যকে প্রাধান্য দেয়। তাই অনেক রেঁস্তোরা-রিসোর্টে ছনের ছাউনি দেখা যাচ্ছে। সৌখিন মানুষ প্রকৃতির টানে তাই ছনের ঘরের ছাউনির নিচে বাঁশের চেয়ার-টেবিলে বসে খাবারের স্বাদ গ্রহণ করে থাকে রুচিশীল মানুষ। অবকাশ যাপনে বিলাসী মানুষ বেছে নেয় ছনের ছাউনির চালযুক্ত মাটির ঘরকে। যেখানে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা মিলেমিশে একাকার।
![ছনের ঘর: হারিয়ে যাচ্ছে এক শীতল ঐতিহ্য!](https://anolipi.com/wp-content/uploads/2022/07/ছনের-ঘর-হারিয়ে-যাচ্ছে-এক-শীতল-ঐতিহ্য-2.jpg)
পরিশেষে বলা যায়, গ্রামীণ ঐতিহ্যে মোড়ানো ছনের ঘর এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। কালের অবলীলায় তা ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ধারন করা এই ছনের ঘরের পরিবর্তনে টিন, ইট জায়গা দখল করে নিয়েছে। মানুষ পরিবেশবান্ধব ছনের ঘরের পরিবর্তে ব্যবহার করছে টিনের ও পোড়া ইটের। তাছাড়া মানুষের সৌখিনতা, স্বচ্ছলতা, ছনের উৎপাদন হ্রাস ও নির্মাণ এবং বারবার মেরামত ব্যয়ের কারণেই মানুষ আসলে ছনের ঘর বিমুখ হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত পরিবেশবান্ধব এই ছন দিয়ে নানাবিধ ব্যবহার বাড়ানো। ছনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা গেলে হয়তো নাগরিক জীবনে তা সহায়ক ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে।