ফিচারলোকসংস্কৃতি

নকশি পাখা: সুতোয় গাঁথা স্বপ্ন যেন!

লোকশিল্প একটি সমাজের বা সম্প্রদায়ের জীবনের মূল ধারার সংস্কৃতি এবং জীবন চিত্রকে প্রতিফলিত করে। লোকশিল্প বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চিরায়ত রূপকে ধারণ করে। কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াই শুধুমাত্র বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে লোকায়ত মানুষ লোকশিল্পকে ধারণ করে আসছে। মৃৎশিল্প, নকশী কাঁথা, তাঁতশিল্প, কুটিরশিল্প, কাঁসাশিল্প প্রভৃতি লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত। লোকশিল্পের পরিধি অনেক বিস্তৃত। নকশি পাখা বা নকশা করা পাখা তার মধ্যে অন্যতম। গ্রীষ্মকালে গরমের দবদাহ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ হাতপাখা ব্যবহার করে থাকে। তবে এই পাখা কম-বেশি সকলেই ব্যবহার করে থাকে, খুব একটা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় না। সাধারণ হাত পাখার চল সবসময় থাকলেও নকশি পাখার চলও রয়েছে। নকশি পাখায় হাতের কারুকার্যের মাধ্যমে নকশি পাখাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। নকশি পাখা বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। 

নকশি পাখা

নকশি পাখা বা নকশা করা পাখা নকশি কাঁথার মতোই সুপরিচিত। নকশি কাঁথার মতোই নকশি হাত পাখার প্রচলনও বাংলার সর্বত্রই আছে। গ্রীষ্মে হাতপাখার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। এমনকি এখনও এর প্রচলন রয়েছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ও শহরে । এই হাতপাখাকেই আরও একটু আকর্ষণীয় করে যখন নানা নকশায় শোভিত করা হয়, তখন এটিকে নকশি পাখা বলে। নকশি পাখা  অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে নানা চিত্রে ও কারুকার্যে নয়নরঞ্জক নানা নকশায় শোভিত করা হয়। অর্থাৎ চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নানা নকশায় শোভিত করা হাতপাখাই হলো নকশি পাখা।

নকশি পাখা তৈরির উপকরণ:

নকশী পাখার মূল উপকরণ প্রধাণত পাঁচটি:
  • সুতা
  • বাঁশ
  • বেত
  • তালপাতা 
  • শন

এছাড়া ময়ূরের পালকের পাখা, চন্দন কাঠের পাখা প্রভৃতির প্রচলন আছে। ময়ূরের পালক দেখতে খুবই সুন্দর ও নান্দনিক, এতে মূলত অন্য কোনো নকশার প্রয়োজন হয় না। ঘর সাজানোর জন্য বিলাসী উপকরণ হিসেবে ময়ূর পাখা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আবার সুগন্ধী চন্দন পাখাতেও নকশা করার কোনো অবকাশ নেই। চন্দন কাঠের পাখা এদেশের নয় তবে বিত্তবান পরিবারের মেয়েরা আঠারো-উনিশ শতকে তা ব্যবহার করত। বর্তমানেও এই ধরণের পাখার  ব্যবহার রয়েছে। চন্দন পাখা সহজেই বহনযোগ্য হবার কারণে এর ব্যবহারও বেশি। চন্দনের ছোবড়াগুলোকে গুছিয়ে সুন্দর করে পাখার আকারে বাঁধা হয়। একটি বড় ও শুকনো তালপাতা বা নারিকেল পাতা খিল খিল করে ছাড়িয়ে নিয়ে যখন এটি বোনা হয়, তখন নকশা করার সুযোগ আসে। সুপারির খোল থেকেও নকশী পাখা তৈরি করা হয়। এছাড়া আবের পাখারও বেশ প্রচলন আছে।

নকশি পাখার নামকরণ:

নকশি পাখা হলো চিত্রজ্ঞাপক। আর এতে যে চিত্রটি সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয় তার ওপর ভিত্তি করেই মূলত এর নামকরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ- ভালোবাসা, কাঁকইর জালা, গুয়াপাতা, পালংপোষ, শুজনিফুল, বলদের চোখ, শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, ছিটাফুল, তারাফুল, মনবিলাসী, পাশার দান, মনবাহার, বাঘবন্দী, ষোলকুড়ির ঘর, মনসুন্দরী, লেখা, সাগরদীঘি, হাতি-ফুল-মানুষ, গম্বুজ তোলা, যুগলহাঁস, যুগল ময়ূর, পদ্মফুল, শতফুল, পাতা, নিশান কাঁটা, উনিশ কাঁটা, আয়না কোঠা, মাছ পাঙ্খা ইত্যাদি। 

নকশি পাখার বুনন:

সাধারণত সুতা, বাঁশ আর কাপড়- এই তিনটি পাখা তৈরীর মূল উপকরণ। পাখার জন্য সুতা কেনা হয় পাউন্ড হিসেবে। চাক আর ডাঁট বা হাতলের জন্য বাঁশ ব্যবহার করা হয়। আর পাখার ঝালরের জন্য চিকন সুতার লাল সুতি কাপড় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সব থেকে আগে বানাতে হয় বাঁশের গোল চাক। এই চাকের সঙ্গেই আড়াআড়ি করে সুতা বেঁধে বুনতে হয় পাখা। নারীরা  বুনন শেষ হলে চাকটাকে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হয়। এটির নাম মলাট। তারপর আবার মলাটের ওপর লাগাতে হয় ঝালর। পাখায় মলাট আর ঝালর লাগানোর পর লাগাতে হয় হাতল বা ডাঁট। আর এই ডাঁটের গোড়ায় লাগাতে হয় চুঙ্গি। চুঙ্গির কারণেই মূলত ডাঁটের সঙ্গে পাখা ঘুরতে পারে খুব সাবলীলভাবে। পাহাড়ি অঞ্চলের বিটালি বাঁশ দিয়েই চুঙ্গি বানানো হয়। একটি নকশি পাখা বানাতে একজন নারীর একটি দিন লেগে যায়। পাখার বাঁশ কেনা ছাড়া সম্পূর্ণ কাজটিই করেন নারীরা।

আবার অনেক সময় বাঁশের গোল চাকতির সাথে সাদা কাপড়ে মুড়ে দিয়ে তাতে সূচিকর্মের মাধ্যমে নানান ধরনের গাছ, ফুল ও লতাপাতা চিত্রিত করা হয়। এ ধরনের পাখার চারিদিকে থাকে লালসালুর ঝালর। এই ধরনের নকশি পাখা গ্রামাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। আবার তালপাতা থেকে একটি মাত্র পাখা তৈরি করার জন্য পাকা তালপাতা গোল করে কেটে নেওয়া হয়। তারপর চারিদিকে বাঁশের সরু চটি দিয়ে এটি বাঁধা হয়। সরু বেতির মাধ্যমে ছোট ছোট তিনকোণা নকশা তোলা হয় এই পাখায়। তাছাড়া তালপাতা সরু করে কেটে নিয়ে বুননের সাহায্যে তৈরি করা হয় নকশি পাখা। এ ধরনের পাখা নাটোর জেলায় বেশ জনপ্রিয়।

সুতার পাশাপাশি পাখার নকশায় রঙের স্থান আছে, কিন্তু সেটি তুলি দিয়ে আঁকা হয় না। নকশি পাখা যেসব উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয় সেগুলোকেই বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে নিয়ে বুনন কৌশলের মাধ্যমে ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। কাঁথায় যেমন সুতার এক একটি ফোঁড় দেওয়া হয়, পাখায় তেমনি সুতা বা বেতি দিয়ে এক একটি চেলা দেওয়া হয়। বুননকালে রঙিন খিল গুলো নিজের সুবিধা মতো পাল্টে নিতে হয়। আর ছোট-বড় চেলা দিয়ে পাখার নকশা তোলা হয়। নকশী পাখার চিত্র বা নকশার অন্যতম মূল আকর্ষণ হলো রঙের প্রয়োগ। নকশী পাখায় রঙের বৈচিত্র্য রয়েছে। তবে রঙের ব্যবহার সবসময় কাল্পনিক নয়। কোথাও কোথাও বাস্তবের সাথে মিল রাখার চেষ্টা করা হয়। যেমন- কোনো পাখায় হলুদ ও সবুজ রঙের বেত ব্যবহার করা হয়। এখানে গাছের সজীবতাকে সবুজ রঙের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। তবে সাধারণভাবে নকশি পাখায় রঙের ব্যবহার দ্বারা বস্তুকে বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়। নকশি পাখায় এসব রঙের ব্যবহারের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই, এটা শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ ও রুচির ওপর নির্ভর করে।

সুতোয় গাঁথা নকশি পাখা
নারীদের নকশি পাখা বুনন

নকশি পাখার আকার:

নকশি পাখা আকারে আর নকশায় বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। আর আকারে হয় বড়, ছোট আর মাঝারি। সাধারণত ৪০ ইঞ্চি ব্যাস হলো পাখার সাধারণ মাপ। আর মাঝারি ও ছোট পাখা বানানো হয় ছোট শিশুদের কথা চিন্তা করে। সব থেকে ছোট পাখাটা আকারে একটা পয়সার সমান। আর মাপে বড় পাখাটা দুই-আড়াই হাত ব্যাসের হয়। সাধারণত  বড় লাঠির সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই পাখার নাম রাজা পাখা। বড় পাখা আসলে আগের দিনের রাজাদের ব্যবহৃত চামর। আগে রাজসিংহাসনের দুই পাশে দাঁড়িয়ে দুই জন চামরি বড় পাখা দোলাতো রাজার গা শীতল করার জন্য। সুতার বুননে নিখুঁতভাবে পাখার বুকে ফুটে ওঠে প্রিয়জনের নামের অক্ষর। নাম ছাড়াও পাখায় পংক্তি লেখার প্রচলন রয়েছে। যেমন- দয়ামায়া যার ভালোবাসা তার, মনে রেখো, প্রিয়জন, শেষকথা প্রভৃতি সুঁই-সুতার ছোঁয়ায় পাখার গায়ে লেখা হয়।

নকশি পাখায় লোকসংস্কৃতি:

নকশি পাখায় লোকসংস্কৃতির ছাপ পাওয়া যায়। অনেক সময় নকশি পাখায় বুননের মাধ্যমে বিভিন্ন ছড়া ও প্রবাদ ফুটে ওঠে। যেমন: ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে’, ‘দিন যায় কথা থাকে, সময় যায় ফাঁকে ফাঁকে’ ইত্যাদি। আবার যুগলহাঁস ও যুগল ময়ূরের উল্লেখ পাওয়া যায় কিশোরগঞ্জের একটি মেয়েলী গীতে। সেটাতে উল্লেখ আছে: ‘সেই পাংখাত লেইখা গো থইছে আঁসাআঁসির জোড়া গো, সেইনা পাংখাত লেইখা গো থইছে মউরামউরীর জোড়া গো।’ 

নকশি পাখার দাম:

সুতার দামের ওপর এটা নির্ভর করে। আগে সুতার পাউন্ডের দাম ছিল ৬০-৭০ টাকা বর্তমানে ২৬০-৩০০ বা তার বেশি। নকশি পাখার দাম ছিল কম কিন্তু বর্তমানে ১৫০-২০০, ২৫০, ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গরমের কারণে পাখার বিক্রি কিছুটা বৃদ্ধি পায় তাই দামও বেশি থাকে। আবার পূজো-পার্বণে, মেলায় পাখার দাম খানিকটা বাড়ে।

নকশি পাখা শিল্পকে টিকিয়ে রাখার পদক্ষেপ:

নকশি পাখাকে টিকিয়ে রাখা সকলের কর্তব্য। পর্যাপ্ত তালগাছ রোপণ করা, অযথা গাছ কাটা রোধ করা এবং হাতপাখা ব্যবসায়ী ও এ কাজে নিয়োজিত শিল্পীদের সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও ভর্তুকী প্রদান এবং নায্যমূল্যে পণ্য বিপণন ব্যবস্থাই পারে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প নকশি পাখা শিল্পকে বাংলার বুকে বাঁচিয়ে রাখতে।

আরও পড়ুন:

বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের চিত্রকথা!

ধামরাইয়ের রথযাত্রা: বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকউৎসব 

কুষ্টিয়ার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী তিলের খাজা

পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রীষ্মকালে শরীর ঠান্ডা করার জন্য গ্রামবাংলায় নকশি পাখার প্রচলন আছে। গরমে একটু শীতল পরশ পেতে নকশি পাখার জুড়ি মেলা ভার। মানুষের সৌন্দর্যবোধ ফুটে ওঠে এই পাখার মাধ্যমে। যা বাংলার লোকশিল্পকে ধারণ করে। 

 

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।