বোবাকাহিনী বই রিভিউ

বোবাকাহিনী রিভিউ
লেখক: জসীমউদ্দিন
ধরন: চিরায়ত সামাজিক উপন্যাস
“এই কথা মনে রাইখ, তোমারে যে দুঃখ আমি দিয়া গেলাম তার চাইতে অনেক দুঃখ আমি আমার মনের মদ্দি ভইরা লয়া গেলাম।”
দরিদ্র কৃষক আজাহেরের একটা বউ একটা সংসারের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বললেই কি আর হয়? চাল-চুলোহীন লোককে কে বিয়ে করবে? তার উপর আবার নাই তার বাপ-মায়ের ঠিকানা। নিজের অতীত জানে না, জানেনা কন চাষার ঘরে তার জন্ম, কি তার পরিচয়।
তীব্র গরম ও তাপদাহ থাকবে আরও দুই দিন!
তবুও একদিন মেনাজদ্দি মাতব্বর দক্ষিণ ভাটপাড়া গ্রামের আলিমদ্দির মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে। শুধু বিয়ে ঠিক করলেই কি আর গ্রামের বিয়ে হয়? যার আগে-পিছে কেউ নেই তার বিয়ের বরযাত্রী হবে কে?
এবারেও সমস্যার সমাধান করে দিল মেনাজদ্দি মাতব্বর। ফরিদপুরের খলিফাপট্টি থেকে আনা পিরান পড়িয়ে, নিজের গায়ের চাদর দিয়ে পাগড়ি বেধে, বার্নিশের জুতা পড়িয়ে ‘নওশা’ সাজিয়ে নিয়ে চলল গ্রামেরই আরো পাচ-ছয়জন লোক সাথে নিয়ে।
হাসি-ঠাট্টায় রাতের নিভৃতে বিয়ে হয় আজাহেরের। একটা ছোট্ট ঘর হয়,যেই ঘরে তার বউ বিপদে আপদে তাকে আশ্রয় মনে করে। বউকে লাল-নীল মেশানো সোনালি পাড়ের একটা শাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখে। বউ এর আগমনে তার মনে নতুন রং ধরে, কাজ করার উৎসাহ বেড়ে যায়।
তারপর একদিন আজাহেরের ঘর আলো করে আসে বছির আর বড়ুর মতো মিষ্টি দুটো ছেলে মেয়ে। হেসেখেলে দিন কাটতে থাকে আজাহেরের।
কিন্তু সুখ যার কপালে নাই, সে কে আর চাইলেই জীবনভর সুখ ভোগ করতে পারে?
আজাহেরের সুখও টিকল না। বিয়ের সময় ধার করা টাকা তার গলায় ফাঁসের মতো জড়িয়ে পড়ল। ছোট একটুখানি সঞ্চয়, বাড়িঘর, জমি সব দখলে চলে যায় মহাজন শরৎ শাহার।
সেই ফাঁস থেকে মুক্তি পেতে ছাড়তে হল নিজের গ্রাম। তবুও সুখের নাগাল পেলো না। নতুন গ্রামে গিয়ে আজাহারের সাথে নামতে হল ছেলে বছিরকে এক নতুন যুদ্ধে। মৃত্যু যেখানে আঁধারে ঘাপটি মেরে থাকা হায়েনার মতো। এই যুদ্ধ টিকে থাকার যুদ্ধ, প্রতিশোধের যুদ্ধ।
নীরব প্রতিশোধ, সেই অন্যায়ের প্রতি যার জন্য বোন বড়ুকে সাজা ভোগ করতে হয়েছে অকালে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া :
ছোটবেলা থেকেই পল্লীকবির লেখা আমার ভীষণ ভালো লাগতো। উনার লেখায় একটা আদিম মায়া, শীতল পরশ থাকে।
একটা প্রতিযোগিতার সূত্রে কবির এই বইটির সাথে আমার পরিচয় ঘটে। এর আগে আমি জানতাম না কবি উপন্যাসও লিখেছেন। যদিও এটাই কবির একমাত্র উপন্যাস, এবং উনার কবিতাগুলোর মতোই চমৎকার লেখনী ছিল এটা।
পল্লীকবির লেখায় লোকজীবন ও গ্রাম-বাংলার ছাপ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই উপন্যাসে লেখক শুধু গ্রামের প্রকৃতি আর সেখানকার মানুষজনকেই তুলে ধরেননি, তুলে ধরেছেন তাদের কর্মময় ব্যস্ত আর সংগ্রামী জীবন, তাদের বিনোদন, উৎসবের আমেজকে।
রহিমদ্দীর গলায় ছন্দে ছন্দে তুলে ধরেছেন গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-আমেজের কথা।
উপন্যাসের শুরুতে আজাহেরকে মূল চরিত্র বসালেও কাহিনীর চাকা ঘুরিয়ে আজাহেরের ছেলে বছিরকে মূল চরিত্রে সার্থকভাবে স্থান দেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং আমার মতে সেটা পেরেছেন।
পুরো উপন্যাস জুড়ে দুটো আলাদা চরিত্রের ভিন্নরকম টিকে থাকার লড়াই যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে লেখকের লেখনীর পরিপক্বতার ও নিপুণতার পরিচয় বেশ ভালোভাবেই পাওয়া যায়। এটাকে থ্রিলার ধাচের গল্পের মতোই উত্তেজক মনে হয়েছে।
গল্পে আজাহের ও বছিরের কাহিনী সমান তালে চলেছে, যেটা চিরায়ত কাহিনীতে দেখা যায়না। এই দিক থেকে লেখকের উপন্যাস স্বতন্ত্রতা লাভ করেছে।
গল্পের নায়ক,খলনায়ক, পার্শ্বচরিত্র সবাইকেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। একটা সার্থক লেখার এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
আজাহেরের বিয়েতে যেসব রীতি, হাসি-আনন্দের ছবি তুলে ধরেছেন তা যেন আমাদের নানি-দাদিদের মুখে শুনে আসা গল্পেরই এক প্রতিচ্ছবি৷
বরযাত্রীর সাথে বুদ্ধির খেলা, বাড়িতে ঢোকার সময় বকশিস চাওয়া, বকশিস দেয়া নিয়ে দর-কষাকষি, বউয়ের লাজুকতা সব কিছুই যেন আমাকে সেই মুহূর্তে বিয়ে বাড়িতে থাকার অনুভূতি দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আজাহেরের বিয়েতে আমি নিজেও উপস্থিত বর-কনের সাথে।
গল্পে শুধু আবেগ দিয়েই লেখক বাস্তবতাকে তুলে ধরেননি। কিছু জায়গায় হাস্যরসও যোগ করেছেন। যেমন, ”
এখন বিবাহ-বাড়ির নিকটে আসিয়া জুতাজোড়া কাধেঁর গামছা দিয়া মুছিয়া তাহার মধ্যে অবাধ্য পা দুটি ঢুকাইয়া দিল। এই কার্যটি করিতে বলিষ্ঠ-দেহ মোড়লকেও সেই জুতোজোড়ার সঙ্গে প্রায় পনের মিনিট যুদ্ধ করিতে হইল।”
উপন্যাসটির খারাপ লাগা বলতে আমার কিছুই মনে লাগে নি। তবে পড়ার পর “সবচেয়ে ভালো লাগা”-র তারতম্য হয়েছে। যেমন, উপন্যাসের একদিকে আজাহেরের সুখী সংসারকে ভালো লেগেছে, আবার যখন বছির আর বড়ুর ছেলেবেলার খুনসুটি পড়ছিলাম তখন আজাহেরের সংসার জীবন থেকে বেশি ভালো লাগছিল।
আবার গ্রামান্তর হবার পর নতুন জীবনে টিকে থাকার চেষ্টা, সেখানে গ্রামবাসীর সমবেত জীবন আগের গ্রামের চেয়ে ভালো মনে হয়েছে।
নতুন গ্রামে মানুষরা যেভাবে আজাহেরের মতো অপরিচিতকে একজন দূর সম্পর্কের আত্নীয়ের কথায় আপন করে নিয়েছিল সেই ঘটনাটুকু পড়তে আসলে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করেছে৷
কত সহজেই মানুষকে আপন করে নেয়া যায় লেখক চোখে আঙুল দিয়ে তা যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন। আবার মহাজন শরৎ শাহার চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন দুর্বলের উপর সবলের জুলুমের চিত্র, গ্রামের মানুষের অপারগতার চিত্র।
নতুন গ্রামে বছির-বড়ুর সাথে ফুলীর বেড়ে উঠা, বছিরের প্রতি ফুলীর অন্যরকম ভালো লাগা সব যেন অপার্থিব, অকৃত্রিমতার এক ছাপ ফেলে দিচ্ছিল।
ফুলীর নিরব ভালোবাসার কথা জেনেও বছির যেভাবে তাকে দূরে করে দিচ্ছিল তাতে মনে হয়েছে লেখক একটু বেশি কঠোর হয়ে গেলেন বছিরের জীবনের যুদ্ধের জন্য।
তবে বছির-বড়ুর বেড়ে উঠার চিত্রের কিছু অংশে বিভূতিভূষণের ছাপ রয়েছে মনে হয়েছে। তবে কাহিনী পাঠকের মনে ধরলে এসব বিষয় উহ্য রাখা যায়।
উপন্যাসটা পড়ে আমার ফুলী আর বড়ুর জন্য খারাপ লাগতে শুরু করেছিল।
লেখক কি নিদারুণ কষ্ট দিয়ে লেখাটা শেষ করেছেন ভেবেই মন খারাপ হচ্ছিল। কি এক আকাঙ্ক্ষা, গভীর মমতায় উপন্যাসের সমাপ্তি টেনেছেন ভাবতেই মনে হয় এমন লেখনী শুধু পল্লিকবির হাত থেকেই পাওয়া সম্ভব৷
“…. আমারে মনের মতো কইরা কানতি দাও। কবরে যে ঘুমায়া আছে সেই একজন ক্যাবল আমার কান্দন শুনতি পায়।……বুকের বোবকাহিনী যাহার কহিবার ভাষা নাই, সে যদি কাঁদিয়া কিছুটা সান্ত্বনা পায়, তাহাকে কাঁদিতে দাও!”
ফারজানা রফিক (ফারিয়া)
বি. এসসি ( কৃষি), শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।