শিল্প ও সাহিত্য

ভালোবাসাময় পৃথিবী | সালসাবিলা নকি

ভালোবাসাময় পৃথিবী | সালসাবিলা নকি

পাশের রুম থেকে আব্বুর তীব্র চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। আম্মু বরাবরের মতোই নিশ্চুপ। আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি। অংক করছি, কিন্তু অংক মিলছে না। ৫ এর সাথে ৩ গুণ করতে বলা হয়েছে, আমি লিখলাম ৮। কিন্তু উত্তরে লেখা আছে ১৫। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না এমন কেন হচ্ছে। বারবার আঙ্গুলে গুণে যাচ্ছি, ৫ আর ৩, ৫ আর ৩… ৮ই তো হয়। ১৫ কেন দেখাচ্ছে! ভাইয়াকে বলব? মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম ভাইয়া খুব মনোযোগ নিয়ে কম্পিউটারে কী যেন করছে। আমি বুঝতে পারছি না আমার এখন কী করা উচিত। খাতা আর পেন্সিল নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলাম ঠিক তখনই পাশের রুম থেকে ‘ঠাশঠাশ’ শব্দ এল। চমকে উঠার কারণে হাত থেকে খাতা-পেন্সিল পড়ে গেছে। ভাইয়া কিন্তু একবারও চমকালো না। আমার দিকেও তাকালো না। একদম আগের মতোই কম্পিউটার চালাচ্ছে। আচ্ছা ভাইয়া কি শুনেনি শব্দগুলো! অথবা আমার হাত থেকে খাতা পড়ে যাওয়ার শব্দও কি শুনতে পায়নি?

আমার খুব রাগ হচ্ছে। কার ওপর জানি না। আব্বুর ওপর? ভাইয়ার ওপর? নাকি কম্পিউটারের ওপর? ওটা বাসায় আসার আগেও ভাইয়া অনেক ভালো ছিল। ভাইয়া আমার সাথে অনেক খেলত। পাজল গেম খেলতে শিখিয়েছে তো ভাইয়াই। আমাকে ড্রয়িং শেখাত। আমিও স্কুলে কী কী হয়েছে সব ওকেই বলতাম। স্কুলে কেউ আমার সাথে দুষ্টুমি করলে, আমার পেন্সিল, ইরেজার নিয়ে ফেললে, খাতায় আঁকাআঁকি করলে সেসব এসে ভাইয়াকেই বলতাম। ভাইয়া দারুণ সব বুদ্ধি দিত। এখন অনেকদিন ধরে ভাইয়াকে কিছু বলা হয় না। ভাইয়াও কিছু জানতে চায় না। আমার ডিজনি মুভির ক্যারেক্টারের নতুন পাজল বক্সটার ওপর ধুলো জমে জমে সাদা হয়ে গেছে। কত্তদিন খেলা হয় না!

আরও পড়ুন: একাকিত্ব | আবুল হাসনাত বাঁধন

হোমওয়ার্ক আর করা হবে না। অংকগুলো পারছি না আমি। কাল নিশ্চিত সুভাষ স্যার গণিত ক্লাসে আমাকে কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখবেন। আমার ভীষণ লজ্জা লাগবে। ভাবতেই খুব কান্না পাচ্ছে। পাশের রুম থেকে আর কোনো শব্দ আসছে না। আম্মুর ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়েছিলাম। এখন সেটাও বন্ধ। আম্মু কি রুম থেকে বের হবে না? ভাত খাইনি তো আমরা। খিদে পেয়েছে খুব। আচ্ছা ভাইয়ার কি খিদাও লাগে না?

আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এই রুমে দুটো খাট। একদম ওপাশের দেয়ালের সাথে লাগানো ভাইয়ার খাট। খাটের পাশে মাথার দিকে ওর পড়ার টেবিল। আর খাটের পায়ের দিকে কম্পিউটার টেবিল। ওর পড়ার টেবিলের পাশেই আমার খাট। মানে পড়ার টেবিলটা আমাদের দুজনের খাটের মাঝখানে। আর আমার খাটের পাশে আমার পড়ার টেবিলটা যেটা এপাশের দেয়ালের সাথে লাগানো। মাথার দিকে একটা জানালা আছে। এই রুমের একমাত্র জানালা। রাতে শুয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে। কালো আকাশে অনেকগুলো তারা ঝিকমিকি করে যখন জ্বলতে থাকে তখন আমার ভীষণ সুন্দর লাগে। আমাদের ক্লাস পার্টিতে চন্দ্রাময়ী ম্যাম একটা কালো শাড়ি পরেছিলেন। সেই শাড়িটাতেও ছোটো ছোটো তারার মতো ছিল। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রুচিকা বলেছিল ওগুলোকে নাকি স্টোন বলে। ওর আম্মুরও নাকি এরকম অনেক কালারের শাড়ি আছে। আমার আম্মুর তো এমন শাড়ি নেই। তাই আমি ওর মতো এতো কিছু জানি না। রাতে শুয়ে শুয়ে যখন আকাশ দেখি তখন আমার মনে হয়, ওটা আসলে চন্দ্রাময়ী ম্যামের শাড়ি। আমার খুব ইচ্ছে হয় আমার আম্মু এরকম একটা শাড়ি পরুক। কিন্তু আম্মুটা সবসময় ক্যামন পঁচা পঁচা শাড়ি পরে। আমার আম্মুটা অনেক বেশি সুন্দর। এজন্য আম্মুকে পঁচা শাড়িতেও সুন্দর লাগে।

আরও পড়ুন: সরলতা | আবুল হাসনাত বাঁধন

অভিমানে, নাকি ক্ষুধায়, নাকি আম্মুর সব পঁচা শাড়ির জন্য জানি না চোখ থেকে পানি পড়ছে আমার। এতো বেশি পানি যে বালিশটাও ভিজে গেছে। ভেজা বালিশ গালে লাগাতে কেমন বিচ্ছিরি ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে। বালিশটা উলটে দিয়ে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আজকের আকাশেও অনেক তারা। তারাগুলো দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখন বোধহয় অনেক রাত। ভাইয়া বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তবুও এতো অন্ধকার হওয়ার কথা তো না। আমাদের রুমের সিলিং এ অনেকগুলো তারা আর চাঁদ লাগানো আছে। রুম অন্ধকার হলেই সেগুলো সবুজ আলো ছড়ায়। ভাইয়া বলেছে ওগুলোকে রেডিয়াম বলে। এখন মাথার ওপরেও কুচকুচে কালো। জানালার বাইরে দেখতে চাইলাম। কিন্তু কোথায় জানালা কোথায় কী! সবই একই সমান- কালো কালো আর কালো। ভয়ে ভয়ে ভাইয়াকে ডাকলাম,
ভাইয়া… ভাইয়া…
‘ইনায়া, ভয় পাস নে। আমরা মহাশূন্যে অভিযানে যাচ্ছি।’

যেন অনেকদূর থেকে ভাইয়ার কণ্ঠ শুনতে পেলাম মনে হলো। ‘মহাশূন্য অভিযান মানে কী ভাইয়া?’ চিৎকার করে জানতে চাইলাম। ভাইয়ার কণ্ঠ আর শুনতে পাচ্ছি না। চারপাশে কালো দেখতে দেখতে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, এবার যখন ঘুম ভাঙল দেখলাম আমি আমার বিছানায় না, মাটিতে শুয়ে আছি। লাল রঙের মাটি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম যতদূর চোখ যায়, শুধু এই লাল মাটি আর কিছু পাথর ছড়িয়ে আছে। কোনো বাড়িঘর, গাছপালা কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তবে আশার কথা ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছি। মাটিতে বসে কী যেন দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে। আমি উঠে দৌড়ে গেলাম ভাইয়ার কাছে। কাছে গিয়েই জাপটে ধরলাম। ভাইয়া আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে তাকালো। আনন্দে ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু এতো আনন্দের কী হলো বুঝলাম না। সেও কি আমার মতো ভয় পেয়েছিল? আর এখন আমাকে দেখে খুশি হয়েছে?

আরও পড়ুন: যে কুয়াশা সকাল এনেছিল | আবুল হাসনাত বাঁধন

চারপাশে তাকিয়ে বললাম,
‘ভাইয়া আমরা কি রাঙামাটিতে চলে এসেছি? কখন আর কীভাবে আসলাম? আমি তো আমার বিছানায় ঘুমাচ্ছিলাম।’

ভাইয়া বলল,
‘না রে বোকা, আমরা এখন মঙ্গল গ্রহে। তোকে বলেছিলাম না আমরা মহাশূন্য অভিযানে এসেছি? এই এখনমাত্র আমরা মঙ্গলগ্রহে এসে পৌছালাম।’

ভাইয়ার কথা শুনে আমার কিছুতেই কিছু বিশ্বাস হয় না। কিন্তু অবিশ্বাসও করতে পারছি না। আমার ভাইয়া মিথ্যা বলে না। আর ভাইয়া খুবই জিনিয়াস। এটা কিন্তু আমি একদমই বাড়িয়ে বলছি না। স্কুলের টিচাররা বলেন, ‘শুকরানের বয়সী অন্য যেকোনো বাচ্চার চাইতেও নাকি শুকরান অনেক বেশি বোঝে।’ শুকরান আমার ভাইয়ারই নাম। ভাইয়া যে শুধু কম্পিউটার চালায় তা না, খুব পড়াশোনাও করে। কত কিছু জানে ও! ভাইয়া বলেছে, আমরা যে আকাশ দেখি সেটার নাকি আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। বিশাল এক শূন্যতাকে আমরা আকাশ নাম দিয়েছি। একে মহাশূন্যও বলা হয়। এই মহাশূন্যে সূর্য, চাঁদ, তারা, আর গ্রহগুলো ভাসতে থাকে। আমাদের পৃথিবীও একটা গ্রহ। পৃথিবী থেকে দেখতে পাওয়া এই মহাশূন্যকে আমরা আকাশ বলি। আলোর বিক্ষেপণের জন্য দিনের আলোয় আকাশকে নীল দেখায়। আর রাতের বেলায় আকাশকে কালো চাদরের মতো মনে হয়।

ভাইয়া বলেছে আমাদের পৃথিবীর মতো আরও অনেক গ্রহ আছে। মঙ্গলও তেমন একটা গ্রহ। ভাইয়া আমাকে আরও অনেক কিছু বলেছিল এসব নিয়ে। কিন্তু আমি তো অনেক ছোটো। মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ি। তাই সবকিছু বুঝি না। ভাইয়া পড়ে ক্লাস নাইনে। অনেক কিছু বোঝে ভাইয়া, অনেক কিছু জানে।

ভাইয়া আমাকে ছেড়ে মাটিতে ঝুঁকে কী যেন করছে। জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী করছ ভাইয়া?’
‘পরীক্ষা করছি?’
‘কী পরীক্ষা? অংক? তোমার তো শুধু অংকই পছন্দ। কিন্তু পরীক্ষা দিতে তোমার মঙ্গল গ্রহে আসতে হলো কেন?’

ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘পরীক্ষা দিচ্ছি না, পরীক্ষা করছি। আর শোন, আমরা আর পৃথিবীতে থাকব না। পৃথিবী খুবই পঁচা একটা জায়গা। পৃথিবীর মানুষগুলো বেশিরভাগই খারাপ। আমাদের আব্বুও পঁচা হয়ে যাচ্ছে। দেখিস না, রোজ রোজ আম্মুর সাথে ঝগড়া করে, আম্মুকে বকে। আমার মনে হয় আম্মুর গায়ে হাতও তোলে। আম্মু শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দেয় না। আমি তো আম্মুর ছেলে। আম্মুকে প্রটেক্ট করার, আম্মুকে সুখী রাখার দায়িত্ব আমার। তাই আমি ভাবছি আম্মুকে নিয়ে এখানে চলে আসব। তুই, আমি আর আম্মু এখানে একসাথে থাকব। তখন দেখব আব্বু একা একা ক্যামন করে থাকে। কিন্তু এখানে থাকা নিরাপদ হবে কিনা সেটাও তো দেখতে হবে। তাই আমি আগে চলে এসেছি পরীক্ষা করে দেখতে। কিন্তু তুই আমার সাথে এলি কেন? যা, এক্ষুণি চলে যা। আম্মু আমাদের দুজনকেই দেখতে না পেলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে।’

আরও পড়ুন: বাবার চিঠি | আবুল হাসনাত বাঁধন

ভাইয়ার সব কথা শুনলাম। অন্যসময় ওর কথা কঠিন মনে হলেও আজ একবারে বুঝে গেলাম। ভাইয়া এতদূরে মঙ্গলগ্রহে কীভাবে এসেছে জানি না। আশেপাশে কোনো গাড়িও দেখতে পাচ্ছি না। আমি কীভাবে এসেছি তাও বুঝতে পারছি না। খুব সম্ভবত ভাইয়া কোনো ম্যাজিক করে চলে এসেছে এখানে। ওর সেই ম্যাজিকে আমিও ঢুকে পড়েছি। আমি জোর গলায় ভাইয়াকে বললাম,

‘তুমি যেমন আম্মুর ছেলে আমিও আম্মুর মেয়ে। আমিও আম্মুকে প্রটেক্ট করব, হ্যাপি রাখব। তাই তোমার সাথে সাথে চলে এসেছি। তাড়াতাড়ি তোমার পরীক্ষা শেষ করো তো। তারপর আম্মুকে গিয়ে আমরা নিয়ে আসব।’

ভাইয়া খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকাল। ঠিক সে সময়েই পায়ের নিচে মাটিটা কেঁপে উঠল হালকা করে। আমি চোখ বড়ো বড়ো করে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। দেখলাম ভাইয়াও চোখ বড়ো করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পর মাটি আরও জোরে কেঁপে উঠল। এবং কাঁপতে থাকল। আব্বুর মোবাইলে কল আসলে যেমন বোঁ বোঁ শব্দ করে মোবাইলটা কাঁপতে থাকে তেমনিভাবে কাঁপছে। খেয়াল করলাম আমি আর ভাইয়াও কাঁপছি। আমার মনে হচ্ছে কাঁপুনির চোটে আমি পড়ে যাব। ভাইয়ার শার্টের কোনা চেপে ধরলাম শক্ত করে। ভাইয়া দুইহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কী হচ্ছে ভাইয়া?’

ভাইয়া কপাল কুঁচকে বলল,
‘মনে হয় ভূমিকম্প। আশ্চর্য তো! মঙ্গলগ্রহেও পৃথিবীর মতো ভূমিকম্প হয়!’

আমি বিজ্ঞের মতো বললাম,
‘তুমিই তো বলেছিলে, মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর মতোই। তাহলে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হলে মঙ্গলগ্রহে কেন হবে না?’

অন্য সময় হলে আমি যে চমৎকার একটা উত্তর দিয়েছি সেজন্য ভাইয়া খুশি হতো। কিন্তু এখন দেখলাম ভাইয়ার মুখে খুশির চিহ্নমাত্র নেই। উলটো ভয়ে ভয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। আমিও তাকালাম সেদিকে। দেখলাম অনেক দূর থেকে বিন্দুর মতো কিছু নড়াচড়া করছে। একটু পরেই মনে হলো, দলবেঁধে অনেকগুলো পিঁপড়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। খুব দ্রুতই কাছে আসছে ওগুলো। আর যতোই কাছে আসছে ততোই বড়ো হচ্ছে। বোঁ বোঁ শব্দটা বাড়ছে, মাটির কম্পনও বাড়ছে। একদম কাছে যখন এলো তখন দেখলাম, অনেকগুলো পালকি। কিন্তু সবগুলো পালকিতে গাড়ির মতো চাকা লাগানো। এর আগে কখনো সামনাসামনি পালকি দেখিনি। ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় পড়েছিলাম, ‘তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে…’ সেই কবিতার সাথে ছবি ছিল, পালকিতে মা বসা, আর পাশে ঘোড়ার ওপর তার ছেলে বসে আছে। আমাদের সামনে যেগুলো দেখতে পাচ্ছি সেগুলো আসলে পালকিই, শুধু গাড়ির মতো চারটা চাকা আছে। তাই কোনো মানুষকে কাঁধে নিতে হয়নি, নিজেরাই চলছে।

ভাইয়া আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম পালকি গাড়িগুলো থামতেই ভেতর থেকে পিলপিল করে নেমে আসছে কিছু অদ্ভুত ধরনের মানুষ। সবাই লাল রঙের জামা পড়েছে। জামাগুলো অনেকটা আমাদের রেইনকোটের মতো। মানুষগুলো সবাই একই সমান। কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ মোটা, কেউ চিকন এমন না। সবাই একই সমান। আর সবাই লম্বাতে আমার ভাইয়ার মতোই। ওদের একজন ভাইয়ার সামনে এসে হাত বাড়ালো। আমি ভাইয়াকে বললাম, ‘ভাইয়া প্লিজ হাত দিয়ো না। আমার খুব ভয় করছে।’

ভাইয়া বলল,
‘আম্মু কী বলেছিল মনে নেই? ভয় পেলে আল্লাহকে ডাকতে। তুই মনে মনে আল্লাহকে ডাক।’

বলেই ভাইয়া হাতটা বাড়িয়ে ওই অদ্ভুত মানুষের হাতের ওপর রাখল। দেখতে দেখতে ভাইয়ার হাতটা লাল হয়ে গেল। ভাইয়ার চোখের পলক পড়ছে না আর। ভুতের চোখের মতো লাল হয়ে গেল ওর চোখদুটো। আমি ভয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। কয়েক মিনিট পরই ওই অদ্ভুত লোকটা ভাইয়ার হাত ছেড়ে দিলো। তারপর বাকিদের মধ্যে ফিরে গেল লোকটা। মনে হচ্ছে লোকটা অন্যদের সাথে কথা বলছে। কিন্তু কথার আওয়াজ ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দের মতো। একটু পরেই লোকটা আবার ভাইয়ার কাছে ফিরে এলো। একটা লাল রঙের ছোট্ট কাপড়ের থলে দিলো ভাইয়াকে। আর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমার গালেও আলতো করে হাত রাখল। আমি কেঁপে উঠলাম, ইশ! কী ঠান্ডা হাতটা! আর স্যাঁতসেঁতে!

এরপর ওরা সবাই আবার ওদের পালকি গাড়িতে ঢুকে গেল। পরক্ষণেই গাড়িগুলো চলতে শুরু করল। একসময় সবকটা গাড়িই অনেক দূরে মিলিয়ে গেল। এরপর যেন ভাইয়ার হুশ ফিরেছে। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

‘আমাদের এখানে আসতে হবে না আর। আমরা পৃথিবীতেই থাকতে পারব। চল যাই।’

আমি বললাম,
‘নাহ, আগে বলো ওরা কারা? তোমার সাথে কী করেছে? আর তোমাকে এগুলো কী দিয়েছে?’

‘ওরা হচ্ছে  অ্যালিয়েন। অন্যগ্রহের প্রাণিদের অ্যালিয়েন বলে। আবার আমি আর তুইও কিন্তু ওদের কাছে অ্যালিয়েন। আমরাও ওদের জন্য ভিনগ্রহের প্রাণী। এরা এই মঙ্গলগ্রহেই থাকে, আমরা যেমন পৃথিবীতে থাকি। আমরা অন্যগ্রহ থেকে এসেছি এটা ওদের বিজ্ঞানীরা বুঝে ফেলেছে। আর আমাদের খুঁজে বের করেছে। আমার হাতে হাত রেখে জানতে চেয়েছে আমরা এখানে কেন এসেছি। ওরা তো আমাদের ভাষা বোঝে না। আমরাও বুঝব না। তাই হাতে হাত রেখে আমার চোখের মধ্যে তাকিয়ে আমার ব্রেইনের সাথে যোগাযোগ করেছে। আর এভাবেই জানতে পেরেছে, আমি কে, আমরা এখানে কেন এসেছি। আমার ব্রেইনে সিগন্যাল পাঠিয়ে বলেছে, আমাদের পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলগ্রহে আসার দরকার নেই। আমরা চাইলেই আমাদের পৃথিবীটাকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে ফেলতে পারি। আর আমাদের সেই চেষ্টাই করা উচিত। আর সবার শেষে উপহার হিসেবে এই থলেটা দিয়েছে।’

আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম,
‘দেখি কী আছে এখানে?’

‘উঁহু এখন না। বাসায় গিয়ে দেখব। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল চল তাড়াতাড়ি আগে বাসায় যাই।’

হঠাৎ প্রচণ্ড আলোয় চোখ ঝলসে গেল আমার। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলাম আমি আমার বিছানাতেই শুয়ে আছি। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে চোখে লাগছে। প্রতিদিন আম্মু এসে পর্দাটা টেনে দিয়ে যায়। আজ আম্মু কি আমাদের রুমে আসেনি? পাশে তাকিয়ে দেখলাম ভাইয়া ওর বিছানায় ঘুমাচ্ছে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে ওর কাছে গিয়ে ডাকলাম,

‘ভাইয়া ভাইয়া… উঠো না। এলিয়েনরা কী দিয়েছে দেখাবে না?’

ভাইয়া ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল,
‘ইনায়া ঘুমাতে দে। সারারাত ঘুমাইনি।’

আরও পড়ুন: ‘তরুন্বিতা, ফিরবে তো?’ | আবুল হাসনাত বাঁধন

অবাক হয়ে ভাবলাম, সারারাত তো আমিও ঘুমাইনি। দুজনে না মঙ্গলগ্রহে গেলাম! কিন্তু আমার তো এখন ঘুম পাচ্ছে না। বরং খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। রুম থেকে বেরিয়ে আম্মুর রুমের কাছে গেলাম। দরজা একটুখানি ফাঁক করা। কাল রাতে আব্বু-আম্মুর ঝগড়া হয়েছিল। এরপর আম্মুকে আর দেখিনি। খিদের চাইতেও বেশি আম্মুকে দেখার ইচ্ছে হলো। আমি দরজাটা আস্তে করে ঠেলে ভেতরে উঁকি দিলাম। অদ্ভুত একটা জিনিস দেখতে পেলাম। আব্বু আর আম্মু দুজন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মুর মাথাটা আব্বুর কাঁধে। আব্বু একহাতে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আছে। ওদেরকে এভাবে কখনো দেখিনি। দুজনের কথাবার্তা আমার কানে আসছে। আব্বু বলছে,

‘আমি খুবই সরি আইরিন। কাল একটু বেশিই করে ফেলেছিলাম। আসলে এতো কাজের চাপে থাকি মাথাটা নিজের কন্ট্রোলে থাকেই না।’

আম্মু বলল,
‘আমি বুঝতে পারি তুমি ইচ্ছে করে করো না। এমনিতে হাজারটা কাজের চাপ মাথায়, তার ওপর বাসায় কিছু ঠিক না থাকলে মেজাজ খারাপ তো হবেই। এর পেছনে কারণ থাকলেও সেগুলো তখন অজুহাত মনে হবে। কিন্তু শাহীন তোমার মনে রাখতে হবে আমাদের বাচ্চারা বড়ো হচ্ছে, ওরা সব বুঝতে পারে। এজন্য আমি তোমার সাথে কথা কাটাকাটি বা ঝগড়াতে যাই না। তোমারও বিষয়টা খেয়াল রাখা উচিত।’

‘ঠিক বলেছ। কাল শুকরান এসে যেভাবে বোঝাল! আমি অবাক হয়ে গেছি! এতো বড়ো আর ম্যাচিউর হয়েছে আমাদের ছেলেটা! কী সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা শিখেছে! সত্যি তো, আমি যা করছি সব তোমাদের জন্যই। আমার পৃথিবী তোমরা। তোমাদের ছাড়া আমি একমুহূর্তও থাকতে পারব না। সেই আমিই কীভাবে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি! আর এতে যে আমার কলিজার টুকরা বাচ্চাদুটো কষ্ট পায় তা ভেবেও দেখিনি। কাল শুকরানের কথাগুলো শুনে একদিকে আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছিল! অন্যদিকে নিজের কৃতকর্মে লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছিল।’

আমি দরজা থেকে সরে এলাম। বড়োদের ব্যাপার-স্যাপার আমি অনেক কিছু বুঝি না। আব্বু-আম্মুকে দেখে কি কেউ বলবে যে কালরাতে কী হয়েছিল! আমি না খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছিলাম। এখন ওরা কত্ত সুন্দর নিজেরা নিজেরা গল্প করছে! কীভাবে সব ঠিক হলো! ওহ! আব্বু বলল ভাইয়া নাকি কীসব বুঝিয়েছে! আচ্ছা, মঙ্গলগ্রহ থেকে এসে তাহলে ভাইয়া ওদের সাথে কথা বলেছিল! আর আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। একারণেই ভাইয়ার রাতে ঘুম হয়নি, এখনো তাই ঘুম থেকে উঠতে পারেনি।

যাক, আব্বু এখন থেকে আম্মুকে আর বকাবকি করবে না এটা ভেবেই খুশি লাগছে। কিন্তু আমার যে খুব খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরে গিয়ে চকোলেট কুকিজের টিন থেকে গুণে গুণে পাঁচটা কুকিজ নিলাম। কালরাতের অংকটা এখন মাথায় এল। ৫ এর সাথে ৩ গুণ করতে বলেছিল। আর আমি বারবার যোগ করছিলাম। কী বোকা আমি!

কুকিজ খেতে খেতে আমাদের রুমে চলে আসলাম। স্কুলে যাওয়ার আগে অংকটা কমপ্লিট করে ফেলতে হবে। ভাইয়ার কাছ থেকেও জিজ্ঞেস করতে হবে অ্যালিয়েনরা কী দিয়েছিল ওকে। রুমে এসে দেখতে পেলাম এখনো ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ ওর কম্পিউটার টেবিলে চোখ পড়ল, লাল রঙের একটা ছোট্ট থলে। আরে! এটাই তো অ্যালিয়েনরা দিয়েছিল ভাইয়াকে। আমি থলেটা হাতে নিয়ে খুলেই ফেললাম। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা কালো রঙের চামড়ার বেল্টের ঘড়ি আর একটা নীল রঙের পাথর বসানো গলার লকেট। অবাক হয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ভাইয়া, অ্যালিয়েনরা তোমাকে ঘড়ি আর লকেট দিলো কেন?’

আমার কথা শুনে ভাইয়ার ঘুম যেন এক সেকেন্ডে পালিয়ে গেছে। লাফ দিয়ে উঠে আমার হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে ফেলে চাপাস্বরে বলল,
‘গাধী, এগুলো আমাদের ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। আব্বু-আম্মুর জন্য। আগামীকাল ওদের অ্যানিভার্সারি না? এখন লুকিয়ে রাখব। আজকে রাত বারোটায় দেবো। বুঝেছিস? প্রমিস কর এর আগে কাউকে কিচ্ছু বলবি না।’

আমি কিছু বলতে পারলাম না। আবার কান্না পাচ্ছে। ভাইয়া অ্যালিয়েনদের দেওয়া জিনিসকে নিজের কেনা বলছে তাই, নাকি আমাদের টাকা জমানোর ব্যাংকটা ভেঙে ফেলেছে সেজন্য, ঠিক কোন কারণে জানি না আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে দেখে ভাইয়া বলল,

‘কাঁদছিস কেন পাগলি! আম্মুর জন্য? আম্মু-আব্বুর মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে তো। ওরা আমাকে প্রমিজ করেছে আর কক্ষনো ঝগড়া করবে না। আব্বুও আম্মুকে আর কক্ষনো বকবে না।’

ভাইয়া বলেই যাচ্ছে, আমি কেঁদেই যাচ্ছি। দুজনের কেউই খেয়াল করিনি আমাদের রুমের দরজার সামনে আম্মু-আব্বু কখন থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

~সমাপ্ত~

ভালোবাসাময় পৃথিবী’ | © সালসাবিলা নকি

চট্টগ্রাম।

সালসাবিলা নকি এর – ‘ভালোবাসাময় পৃথিবী’ গল্পের মতো আরও নতুন নতুন সায়েন্স ফিকশন গল্প পড়তে চাইলে অনুলিপিতে চোখ রাখুন! গল্পটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।