ইতিহাসঐতিহ্যফিচারবিখ্যাত জায়গালোকসংস্কৃতি

বিশ্ব সভ্যতায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান!

আদিম কালে মানুষের কৃষিকাজ জানা ছিল না। তারা বনে বনে ঘুরে ফলমূল সংগ্রহ করত যা ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। পরবর্তীতে মানুষ পাথর ভেঙ্গে অস্ত্র তৈরি করতে শেখে যা ছিল মূলত তাদের প্রধান হাতিয়ার। ধীরে ধীরে তারা দলবদ্ধভাবে পাথরের অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার করতে শেখে এবং আগুনের ব্যবহার শেখে। ফলে মানুষ কৃষিকাজে আগ্রহী হয় এবং ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দলবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে। এভাবেই সূচনা হয় মানব সভ্যতার। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে ওঠে যার মধ্যে মিশরীয় সভ্যতা অন্যতম। আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম হলো মিশরীয় সভ্যতা। উত্তর আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা হলো মিশরীয় সভ্যতা। মূলত নীল নদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। অর্থাৎ নীল নদকে কেন্দ্র করেই এই সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ঘটেছিল। মিশরীয় সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এবং পরিচিতির পেছনে নীল নদের অবদান রয়েছে যা আজও সমান গুরুত্ব বহন করে। তবে সমগ্র বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে মিশরীয় সভ্যতার অবদান আজও অপরিসীম।

মিশরীয় সভ্যতার পটভূমি ও ইতিহাস:

আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পূর্ব অংশে মিশর অবস্থিত। মিশরের ভৌগলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা মূলত তিনটি মহাদেশ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপকে ঘিরে আছে। প্রাচীন এই দেশটি ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত। যার মোট আয়তন ৪ লক্ষ বর্গ মাইল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদকে কেন্দ্র করে একটি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছে এবং মিশরীয় ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। এই সময় নারমার হন মিশরের প্রথম নরপতি এবং এরপর মিশর ফারাওদের অধীনে থেকে প্রাচীন সভ্যতায় অবদান রাখতে শুরু করে। প্রাচীন এই সভ্যতা ২৫০০ বছরের বেশি সময় স্থায়ী ছিল। ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য মিশর দখল করে নেয় ও সেই সাথে মিশরীয় সভ্যতার অবসান ঘটে।

বিশ্ব সভ্যতায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান:

প্রাচীন সভ্যতায় এবং বিশ্ব সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিটি স্তরে মিশরীয়রা তাদের কাজের স্পষ্ট ছাপ রেখেছিল। মিশরীয় সভ্যতা বিশ্ব সভ্যতার ব্যাপক পরিবর্তন আনে তা সত্যিই মানতে হবে।

নীল নদের অবদান:

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার পুরোটাই নীল নদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই নদের পানি একসময় কৃষি কাজে ব্যবহার করা হতো এবং পানীয় জল হিসেবে পান করা হতো। এছাড়া পিরামিড তৈরিতে নীল নদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। পিরামিড তৈরীর পাথর পরিবহন করে আনায়নের জন্য নীল নদকে তারা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। রোজেট্টা পাথর খন্ডে খোদাই করা লিপি থেকেই মিশরীয় সভ্যতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। এভাবেই নীল নদ মিশরীয় সভ্যতাকে দিয়েছে এক ঐতিহাসিক রূপ। নীল নদ মিশরীয় সভ্যতার একমাত্র ধারক ও বাহক।

বিশ্ব সভ্যতায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান!
নীল নদ

ধর্মীয় বিশ্বাস:

তখনকার সময়ে মিশরীয়দের মতো কোনো জাতি ধর্মীয় অনুশাসনে প্রভাবিত ছিল না। এজন্য অনেক আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় রীতি-নীতির উদ্ভব ও প্রচলন হয় প্রাচীন মিশর থেকেই। মূর্তি পূজা, জড়বস্তুর পূজা, জীবজন্তুর পূজা মূলত তারাই শুরু করে। তাদের ধারনা এবং বিশ্বাস ছিল সূর্য দেবতা রে, নীল নদের দেবতা, শস্য এবং প্রাকৃতিক শক্তির দেবতা ওসাইরিস একত্রিতভাবে সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করে। তাদের জীবনে সূর্যদেবতার প্রভাব ছিল তুলনামূলক অনেক বেশি।

প্রাচীন মিশরীয়রা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে বেশি বিশ্বাস করতো এবং তাদের ধারনা ছিল ও তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করতো মৃত্যুর পরও আত্মা বেঁচে থাকে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে সুন্দর ভাবে উপভোগ করার জন্যই তারা সর্বদা বিভোর থাকতো এবং সে কাজেই তারা অধিক ব্যস্ত থাকতো। ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে এ কাজে গুরুত্ব আরোপ করা হতো। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা চাইতেন বিশাল হোক তাদের সমাধিক্ষেত্র এজন্য তার মৃত্যুর আগে অনেকেই নিজেদের সমাধিক্ষেত্র প্রস্তুত করে যেতেন। এসব সমাধিক্ষেত্র আসলে মৃতের আত্মার ঘর হিসেবে নির্মিত হতো। মিশরীয়রা মনে করত, লাশ বা মৃতদেহ টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করে আত্মার বেঁচে থাকা নির্ভর করে। আসলে মিশরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ধারনা ছিল যে মৃতদেহ একদিন বেঁচে উঠবে এবং মৃত দেহকে তাজা রাখার জন্যই তারা মমি বানিয়ে রাখতো। আত্মার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস যেমন- নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিশেষ করে খাবার-দাবার মৃতদেহের সাথে দিয়ে দেবার রীতি ছিল। সমাধিস্তম্ভ প্রধানের দায়িত্ব ছিলো দস্যুদের হাত থেকে মৃতদেহ আর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষা করার। কিন্তু কবরে সমাধিত ব্যক্তিটি কত বিপুল পরিমাণ বিত্ত আর ক্ষমতাবান ছিল তা জাহিরের উদ্দেশ্যে ও মমিকে সুরক্ষিত করার জন্যই নির্মাণ করা হতো পিরামিড।

বিশ্ব সভ্যতায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান!
পিরামিড

প্রাচীন মিশর শাসন করতেন ফিরাউনরা। তাদেরকে কবর বা সমাধি দেয়ার জন্যই মূলত পিরামিড নির্মাণ করা হতো মিশরীয় সভ্যতায়। মিসরে ছোট-বড় মিলিয়ে সর্বমোট ৭৫ টি পিরামিড আছে। পিরামিড মূলত ইট-পাথরের বিশাল স্থাপনা যার কিছু কিছু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপনা হিসেবে পরিগণিত হয়। মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন ও পৃথিবীর বিখ্যাত পিরামিডগুলোর বেশিরভাগ মিশরেই অবস্থিত।

শিল্প:

মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিল্প। মিশরীয় চিত্রশিল্প ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই গুরুত্ব বহন করে এবং এই চিত্রশিল্প গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই। মূলত মন্দির ও সমাধির দেওয়ালকে সাজাতে গিয়েই চিত্রশিল্পের উদ্ভব ঘটে। মিশরীয়দের প্রিয় রং ছিল সাদা ও কালো। তাদের চিত্রশিল্পীরা মন্দির, সমাধি, দেওয়াল, প্রাসাদে অসাধারণ চিত্র অঙ্কন করতেন। যার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা হতো মিশরের সমসাময়িক চিত্র, যেমন- রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক।

এছাড়া প্রাচীন মিশরীয় কারুশিল্পীরা কারুশিল্পেও অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছিন। এছাড়া সোনা, রূপা, মূল্যবান পাথরের তৈজসপত্র, হাতির দাঁত, ধাতব দ্রব্যাদি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, আসবাবপত্র, মৃৎপাত্র, মমির মুখোশ, অলঙ্কার প্রভৃতি শিল্পে দক্ষ হাতের কাজের ছাপ ফুটে ওঠে।

ভাস্কর্য শিল্প:

ভাস্কর্য শিল্পের মিশরীয়দের অবদান অপরিসীম। তাদের মতো দক্ষতা ও প্রতিভার ছাপ আর কেউ রাখতে পারেনি। বৈচিত্র্য, ব্যাপকতা ও ধর্মীয় ভাবধারার মধ্য দিয়ে তারা বিশাল বিশাল পাথরকে খঁচিত করে মূতিতে রূপান্তরিত করেছে। ভাস্কর্যকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে যা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্ব বহন করে। প্রতিটি ভাস্কর্যই ধর্মীয় ভাবাবেগ, আচার, রীতিনীতি এবং মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
মিশরীয় ভাস্কর্য শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম শিল্প হচ্ছে গির্জার স্ফিংকস। মন্দিরগুলোতে মিশরীয় ভাস্কর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।

লিখন পদ্ধতি ও কাগজের আবিষ্কার:

মিশরীয় সভ্যতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল লিখন পদ্ধতি ও কাগজের আবিষ্কার। মূলত নগর সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথেই মিশরীয় লিখনপদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। প্রথমদিকে তারা ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করতো যা ছিল লিখন পদ্ধতি। আর এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল পবিত্র অক্ষর। প্রাচীন মিশরীয়রা নলখাগড়া থেকে কাগজ বানানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করে এবং তারা কাগজ বানানো ভালোভাবেই রপ্ত করে। পরবর্তীতে তারা এই কাগজেই লেখা শুরু করে। গ্রিকরা এই কাগজের নাম দেয় প্যাপিরাস, যা ইংরেজি শব্দ পেপার থেকে এসেছে। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মিশর জয়ের সময় একটা পাথর আবিষ্কার হয় যেটি রসেটা স্টোন নামে পরিচিত। যা থেকে পরবর্তীতে মিশরের অনেক তথ্য জানা যায়।

বিজ্ঞান:

মিশরীয় সভ্যতা মূলত ছিল কৃষিনির্ভর। নীল নদের প্লাবন, নাব্য, পানিপ্রবাহ, জোয়ার-ভাটা ইত্যাদি ছাড়াও জমিও মাপ তাদের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনের তাগিদেই তারা জ্যোতিষশাস্ত্র ও অঙ্কশাত্র শিখেছিল এবং এদুটি শাস্ত্রে তাদের ছিল গভীর মনোযোগী। সে সময় পাটিগণিত ও জ্যামিতির প্রচলন ছিল। এছাড়া তারা ভাগ, যোগ, বিয়োগের ব্যবহার জানতো। ৪২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তারা প্রথম সৌর পঞ্জিকা আবিষ্কার করে। ৩৬৫ দিনে বছরের হিসাব, সূর্যঘড়ি, জলঘড়ি, ছায়াঘড়ি তারাই প্রথম আবিষ্কার করে।

ধর্মীয় কারণে তারা বিজ্ঞানচর্চায় অধিক মনোযোগী ছিল। মূলত তারা পরলোকে বিশ্বাসী ছিল ও ফারাওরা পরবর্তী জন্মেও রাজা হবেন। তারা এজন্য মমি তৈরী করে এবং মৃতদেহকে সতেজ রাখার জন্য রাসায়নিক প্রক্রিয়া ব্যবহারে তারা সফল হয়।

চিকিৎসাশাস্ত্র:

চিকিৎসাশাস্ত্রে তারা অগ্রগতি লাভ করে। দাঁত, চোখ, পেটের রোগ নির্ণয় সহ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তারা চিকিৎসা করতো। এছাড়া হাড়ের জোড়া লাগানো, হৃৎপিণ্ডের গতি ও নাড়ীর স্পন্দন নির্ণয় করতে সক্ষম ছিল।

সাহিত্য চর্চা:

তারা সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় বেশ পারদর্শী ছিল। তাদের লেখায় কখনো হতাশা ছিল না বরং লেখায় তাদের আনন্দ ফুটে উঠতো।

আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী তিলের খাজা

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বসভ্যতায় মিশরীয় সভ্যতার অবদান অনস্বীকার্য। মিশরীয়রা তাদের প্রখর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন সবক্ষেত্রে। তাদের তৈরী পিরামিড আজও পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের ছাপ রেখেছে।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।