ঐতিহ্য-ইতিহাসে বাঙালি পোশাক-পরিচ্ছদ!
![ঐতিহ্য-ইতিহাসে বাঙালি পোশাক-পরিচ্ছদ](https://anolipi.com/wp-content/uploads/2022/09/ঐতিহ্য-ইতিহাসে-বাঙালি-পোশাক-পরিচ্ছদ-780x470.jpg)
মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে পোশাক। তাই পোশাকের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সৃষ্টির শুরু থেকেই। মানুষ গুহাবাসী থাকা অবস্থায় লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের ছাল-বাঁকল ব্যবহার করত। প্রাচীন গুহাবাসী মানুষ থেকে আজকের যুগের আধুনিক মানুষ সকলের কাছেই পোশাক-পরিচ্ছদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পোশাক শুধুমাত্র লজ্জা নিবারণই করে না, কোনো দেশ, অঞ্চল, জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সাথে অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া দেশ বা অঞ্চলের আবহাওয়া পোশাকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ার মানুষ বিভিন্ন সময়ে তাদের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পোশাক নির্বাচন করে এসেছে। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের মত উষ্ণ অঞ্চলের মানুষ রোদ থেকে শরীরকে বাঁচাতে যতটা সম্ভব লম্বা পোশাক বেছে নিয়েছে। আবার শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ প্রধান পোশাক হিসেবে আঁটসাঁট পোশাক বেছে নিয়েছে। এদিকে ভারত উপমহাদেশের মানুষ প্রাত্যহিক জীবনের নানা কর্মকাণ্ডে আরাম দেবে এমন এক বস্ত্র বেছে নিয়েছিল। ঐতিহ্য-ইতিহাসে বাঙালি পোশাক-পরিচ্ছদ সবসময় বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বহন করে। পোশাক বাঙালির জীবনধারায় একটি নতুন ধারা যোগ করে। বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি বহন করে বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদ।
আরও পড়ুন# এপিজে আবদুল কালাম : ভারতের মিসাইল ম্যান!
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পোশাক নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে সৌন্দর্যবোধের বিষয়। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়। পোশাকের মাধ্যমে চিরকালই শাসক-শোষিতের বিভেদ করা হয়। একই নকশার পোশাক হলেও ধনিক শ্রেণির মানুষের পোশাকে থাকতো ভিন্নতা। এইটা অবশ্যই শ্রেণি বিভাজনের জন্যই। যা পোশাকের ভিন্নতার কারণে হয়।
প্রাচীন যুগের পোশাক
প্রাচীন থেকে বর্তমান বিভিন্ন সময়ে বাঙালির পোশাকেও এসেছে পরিবর্তন। আদি বাঙালিদের পোশাকের সঙ্গে এ যুগের বাঙালিদের পোশাকে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কখনো শাসকের প্রভাবে, কখনো সামাজিক প্রভাবে, কখনো ধর্মের প্রভাবে বাঙালি তাদের পোশাকে পরিবর্তন এনেছে। বিভিন্ন প্রাচীন ভাস্কর্য ও সাহিত্য থেকে আমরা তার কিছুটা আঁচ করতে পারি মাত্র।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। কিন্তু চর্যাপদ থেকে সেকালের নারী ও পুরুষরা কি ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের যেসব ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক ও পাণ্ডুলিপির চিত্র পাওয়া যায় তা থেকে সে সময়ের তাদের পোশাক সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা করা যায়।
সেসময় তাদের বেশিরভাগ পোশাকই ছিল লজ্জা নিবারণ ও শীত-গ্রীষ্মসহ বিভিন্ন আবহাওয়ার রুক্ষতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। যা তাদের দরকারী পোশাক। সেজন্যই সে সময়ে নারী-পুরুষের পোশাকে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। আর এ যুগের মানুষের মত বাহারি ও রকমারি পোশাকও ছিল না তখন।
সে সময়ে নারী ও পুরুষ উভয়ই পরতেন একটি মাত্র বস্ত্র-শাড়ি অথবা ধুতি। যা এক প্যাঁচ দিয়ে পরা হত। তবে অভিজাত পুরুষরা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ধুতি পরত। আর সেসময়ের সাধারণ পুরুষরা অত্যন্ত খাটো ধুতি পরতেন।
সে সময়ের নারীরা শাড়ি পরতেন পায়ের কব্জি পর্যন্ত। আর নারী ও পুরুষরা ঊর্ধ্বাঙ্গে অলংকার ছাড়া আর কিছু পরতেন না। সে সময়ের উৎসবে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিজাত নারীদের মধ্যে কখনো কখনো ওড়না ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল। সেন আমলে ধনী নারীরা বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। নারীরা কানে কচি তালপাতার মাকড়ি এবং কোমরে সোনার তাগা পরতেন। প্রাচীন বাঙালি সমাজে জুতা পরার কোনো রীতি ছিল না।
মধ্য যুগের পোশাক
চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে উপমহাদেশের মানুষ পোশাক আস্তে আস্তে পরতে শুরু করেন। তবে পুরুষদের মধ্যে যাদের এত পোশাক কেনার সামর্থ্য ছিল না তারা অবশ্য শুধু ধুতিই পরতেন। সাধারণ নারীদের পোশাকের মধ্যে শাড়ি নামের পোশাকের প্রচলন ছিল। ধারণা করা হয়, আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই নাকি ‘শাটী’ শব্দটির অস্তিত্ব ছিল। তাই বলা যায়, শাড়ির ইতিহাস প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর কিংবা তারও বেশি পুরানো। মধ্যভারতীয় আর্য ভাষায় ‘শাড়ি’কে আরও বিভিন্ন শব্দে আখ্যায়িত করা হয়েছে যেমন-‘সাটক’, ‘সাটিকা’। আবার ‘মহাভারত’এ উল্লিখিত দ্রৌপদীর য ‘বস্ত্রহরণ’ করা হয়েছিল, সেটাও শাড়িই ছিল বলে অনুমান করা হয়। গুপ্ত যুগের বিখ্যাত কবি কালীদাসের ‘কুমারসম্ভব’ এ শাড়ির কথা উল্লেখ আছে।
সে আমলে মেয়েরা নিম্নাঙ্গে অর্থাৎ পায়ের গোড়ালি ও হাঁটুর মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত ঝুলিয়ে কাপড় পেঁচিয়ে পরিধান করত। সাথে এর বর্ধিত অংশ কোমর পেঁচিয়ে বক্ষকে আবরিত করে কাঁধ পর্যন্ত উঠিয়ে পরত। অবশ্য সেসময় ঘোমটার রেওয়াজ ছিল না। তবে কাজের সময়, শাড়ির বর্ধিত অংশ, যা আঁচল হিসেবে থাকতো তা কোমরে শক্ত করে পেঁচিয়ে বাঁধা হত। এই রীতি যা এখনও প্রচলিত আছে। বাংলার সাধারণ নারীদের জন্য পোশাকের এ ব্যবস্থা ছিল। তবে অভিজাত মেয়েরা বাড়তি কাপড় হিসেবে ভিতরে বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করত। সেকালের কাঁচুলি ছিল চওড়া, কারুকাজ করা নকশাযুক্ত।
সপ্তম শতকে হিউয়েন-সাঙের বর্ণনাতে যে পোশাকগুলির বিবরণ রয়েছে, সেগুলো সেলাই করা পোশাক নয়। অধিকাংশ মানুষই সাদা কাপড় পরত দীর্ঘ গ্রীষ্মকালের গরম থেকে বাঁচার জন্য। আর পুরুষরা একটা লম্বা কাপড় কটি বেষ্টন করে বাহুর নিচে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে শরীর পেঁচিয়ে ডান দিকে ঝুলিয়ে দিত।
পোশাকে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় ইন্দো-মুসলিম যুগে এসে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি ১২০৫ সালে গৌড় বিজয়ের পর থেকে বঙ্গদেশে মুসলমানি পোশাক প্রবেশ করে। এই পোশাকের বিশেষত্ব হচ্ছে সেলাই করা কাপড়। তবে সেটা যে খুব ব্যাপক অর্থে তা কিন্তু নয়। মূলত মুসলমানদের প্রভাবে পোশাকে আসে পরিবর্তন। তবে মধ্যযুগীয় শাসকরা যেসব রুক্ষ অঞ্চলের পোশাক নিয়ে এসেছিলেন, এদেশে এসে তা আর পরিবর্তন করেন নি তারা। প্রথমদিকে তারা বঙ্গে এসব পোশাক গ্রহণ করে না। এক্ষেত্রে প্রথমে বাদশাহের দরবারে, তারপর অভিজাতদের মধ্যে এবং পরে গ্রামের ধনীদের মধ্যে এসব পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয়। প্রাচীন যুগে নারী-পুরুষ উভয়েই একপ্রস্থ কাপড় পরলেও মধ্যযুগে এসে পোশাকে পরিবর্তন আসে। তারা ঊর্ধ্বাঙ্গ, নিম্নাঙ্গ ও মাথায়- মোট তিনটি বস্ত্র পরত। মুকুন্দরাম তাঁর ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’তে পাগড়ি পরার কথা উল্লেখ করেছেন। সেসময় এরকম মুসলমানী পোশাক দরবার ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি অন্য ধর্মের মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। শেখ জৈনুদ্দিনের আঁকা লেডি ইম্পের ছবিতে দেখা যায়- অভিজাতরা তো বটেই, চাকর-বাকররাও মাথায় পাগড়ি পরে আছে।
ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এখনাকার গুটি কয়েক স্থানীয়া বোধ হয় তাদের প্রভুদের অনুকরণে পোশাক পরা শুরু করেছিলেন। তবে বাংলার সাধারণ মানুষ সেসব থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল। আর তখন সনাতন হিন্দু ধর্মে সেলাই করা পোশাক পরা নিষিদ্ধ ছিল। ফলে পুরুষরা তিন টুকরা কাপড় ছাড়াও ধুতি ব্যবহার করতো।
বাংলার হোসেনশাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শাহ-র সমসাময়িক কবি বিজয়গুপ্তের রচিত ‘পদ্মপুরাণ’য়ে পাওয়া যায়, সিংহলরাজ চাঁদ সওদাগরের কাছে পট্টবস্ত্র পেয়ে বাঙালিভাবে বস্ত্র পরছেন। পরার ধরন হল ‘একখানি কাচিয়া পিন্ধে, আর একখানি মাথায় বান্ধে, আর একখানি দিল সর্বগায়।’
এ থেকে বুঝায় তখনও বঙ্গদেশের অভিজাত পুরুষেরাও তিন টুকরা কাপড় ব্যবহার করতেন। এর ভিতরে মাথায় বাঁধা কাপড়টি ছিল পাগড়ি। স্থানীয় লোকেরা এর নাম দিয়েছিল ‘পাগ’। গায়ের কাপড় ছিল চাদর আর পরনে ছিল ধুতি জাতীয় কৌপিন।
তবে কালক্রমে পরনের কৌপিন লম্বা করে পরার রীতি চালু হয়। সেইসঙ্গে কোচার ঝুলও বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি হয় ধুতি।
আরও পড়ুন# দোয়েল চত্বর: ঐতিহ্যের শৌখিন রাজ্য!
মুসলমানদের অনেকে ধুতির চেয়ে ছোট কাপড় পরত, যাকে এখন বলা হয় ‘লুঙ্গি’। পনাই ও পাদুকার উল্লেখ থাকলেও মধ্যযুগের বাংলায় চামড়ার জুতা পরার কথা সে যুগের কোনো সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়নি। ১৮২০ সালের দিকে আঁকা মহররমের মিছিল ও ঈদের ছবিতে সবাইকে ভালো পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা গেলেও তাদের পায়ে কোনো জুতা বা পাদুকা ছিল না। এ থেকে ধারণা করা যায়, সে যুগে জুতা পরার কোনো প্রচলন ছিল না।
মুঘলদের পতনের পরও অনেকদিন এদেশের হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীরাই মুঘলদের পোশাক পরিধান করতেন। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১৮৩৫ সালেও উল্লেখ করা হয় যে, বাবু, জমিদার, সেরেস্তাদার ও উকিল ইত্যাদি মহাশয়রা জামা, নিমা, কাবা, কোর্তা ইত্যাদি পোশাক পরতেন।
রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরদের ছবিতেও তাদের এ ধরনের পোশাক পরতে দেখা যায়। এসব পোশাকই ছিল মূলত অভিজাতদের পোশাক।
রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দসহ সেকালের সব অভিজাত ব্যক্তি তখনও তাঁরা মাথায় পাগড়ি পরতেন।
নবাবী আমলের পোশাক ইংরেজ আমলে এসে অক্ষুণ্ন থাকলেও সেখানে নতুন করে যুক্ত হয় চেইন আর ঘড়ি। কামিজ, রামজামা বা লম্বা জামা থেকেই সম্ভবত পরবর্তীতে পাঞ্জাবির উদ্ভব।
ইংরেজ আমলের পোশাক
ইংরেজরা বাংলায় আসার পর তাদের পোশাকের ছাপ পড়তে শুরু করে। ফলে এ দেশের মানুষের পোশাকে আসে পরিবর্তন। তবে মুঘলদের পোশাকের মত ইংরেজদের পোশাক দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারে নি। ইংরেজরা এই দেশে আসার পরও বহুদিন এই দেশের মানুষ তাদের পোশাক গ্রহণ করেনি বরং তাদের পোশাক বর্জন নিয়ে আন্দোলনও হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে। এ ধারায় প্রথমে অভিজাত শ্রেণি এবং পরে সাধারণ মানুষের মাঝে ইংরেজদের অনুকরণে পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয়। এ সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু কলেজসহ বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজদের মত পোশাক পরার প্রচলন দেখা যায়। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ইংরেজদের মতো পোশাক পরতেন।
বাঙালিদের মধ্যে শার্ট খুব জনপ্রিয়। তবে বিশ শতকের আগে বাঙালিরা শার্ট পরত না। এমনকি বিশ শতকেরও অর্ধেক সময়জুড়ে বাঙালিদের মধ্যে খুব একটা শার্ট পরার চল ছিল না। বাঙালি অভিজাত সমাজে আরেকটি জনপ্রিয় পোশাক হচ্ছে গলাবন্ধ কোট। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সেকালে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্রায় সমস্ত অভিজাত ব্যক্তির মধ্যে। অনেক অভিজাত পরিবারের বিলেত ফেরত সদস্যরা এদেশে এসেও পাকাপাকিভাবে বিলেতি পোশাক পরতে থাকেন। এদের দেখাদেখি অন্যরাও এসব বিলেতি পোশাকে আকৃষ্ট হয়। বিশেষ করে সমাজের উচ্চ শিক্ষিত মহল। অনেকের মধ্যে আবার কোট-ধুতি পরার প্রচলন ছিল যা একসময় খুব জনপ্রিয় পোশাক ছিল।
নারীদের পোশাক
বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের পোশাকে খুব একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। যদিও ধর্ম বিশ্বাসে বৈচিত্র্য রয়েছে। বিশেষত নারীদের পোশাকে খুব একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। কারণ তখম বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মাবলম্বীর মধ্যেই কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলা হত। নারীদের ব্যাপারে রক্ষণশীলতা এতটাই প্রকট ছিল যে বিভিন্ন সময়ে পুরুষদের পোশাক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও নারীরা সবসময় প্রায় একই পোশাক পরেছে আর তা হলো শাড়ি। ইংরেজ আমলে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েরাও শাড়ি পরত।
আগে বাঙালি সাধারণ নারীরা শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ বা পেটিকোট পরত না। তবে অভিজাত নারীদের ক্ষেত্রে অবশ্য সে কথা চলে না। ব্রিটিশ শাসনের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে এসে অভিজাত নারীদের পোশাকে পরিবর্তন আসে। তাদের ফুল-হাতা গলাবন্ধ ব্লাউজ পরতে দেখা যায়। অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীদের ব্রিটিশ সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য আলাদা করে পোশাক তৈরি করিয়ে নিতেন। অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে উর্দুভাষী নারীদের অনেকে সালোয়ার কামিজ পরলেও বাঙালি মুসলিম নারীরা তা পরতেন না। পরবর্তীতে মুসলিম নারীরা তো বটেই বাঙালি হিন্দু নারীরাও সালোয়ার-কামিজ পরতে শুরু করেন।
পুরুষদের পোশাক:
ইংরেজ আমলে অভিজাত শ্রেণির পোশাকে যতটা প্রবলভাবে ব্রিটিশদের ছোঁয়া লেগেছিল, সাধারণ মানুষের মধ্যে কিন্তু ততটা প্রবলভাবে লাগেনি। সাধারণ মানুষ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তখনও ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর, লুঙ্গি ইত্যাদি পোশাক পরতেন। আর হিন্দু-মুসলমান সবাই ধুতি পরতেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে কাজী মোতাহার হোসেন, প্রায় সবাই ধুতি পরতেন। তবে ধুতিকে ‘হিন্দুয়ানী পোশাক’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস দেখা যায় কিছু কট্টরপন্থিদের মাঝে।
তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষ ধুতির বদলে লুঙ্গি পরতে শুরু করে। দেশভাগের পর পূর্ববাংলা থেকে খুব দ্রুত ধুতি লোপ পেতে শুরু করে। হিন্দু-মুসলমান সবার মধ্যেই ব্যাপকভাবে লুঙ্গি পরার রীতি শুরু হয়। যা আজকের বর্তমান সমাজেও প্রচলিত।
পরিশেষে বলা যায়, পোশাক বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। পোশাক বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও সত্ত্বা বহন করে। সময় ও পরিস্থিতির উপর কেন্দ্র করে পোশাকে এসেছে পরিবর্তন। পোশাকে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিও বিদ্যমান। সময় পাল্টেছে আর এসেছে পোশাকে পরিবর্তন। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন ধরণের বাহারি পোশাক। যা বাঙালির ঐতিহ্য-ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।